সাদিকা রুমন প্রতিবেদক, মনের খবর : মানুষ নারী কিংবা মানুষ পুরুষ। মানুষ যখন জন্ম নেয় তখন তার লৈঙ্গিক পরিচয় নির্ধারিত হয় জৈবিকভাবে। কিন্তু বড় হতে হতে সে হয়ে ওঠে সামাজিক নারী এবং সামাজিক পুরুষ। সে নারী এবং পুরুষ হয়ে ওঠে সামাজিক মানদণ্ডগুলোকে আত্মস্থ করে।
সময়ের সাথে সাথে নারী ও পুরুষের নির্ণায়ক মানদণ্ডগুলোও ভিন্নতা পায়। বর্তমান সময়ে একজন মানুষকে ‘নারী’ ও ‘পুরুষ’ হিসেবে নির্মিতি দেয়ার ক্ষেত্রে মিডিয়া একটি শক্তিশালী প্রভাব রাখে। আর মিডিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে বিজ্ঞাপন।
বিজ্ঞাপনে নারীর উপস্থাপন প্রক্রিয়াগুলো পর্যালোচনা করলে মোটাদাগে কয়েকটি বিভাজন আমরা করে ফেলতে পারি :
- কেবল শারীরিক সৌন্দর্যই নারীকে বিচারের মাপকাঠি
- সৌন্দর্য বলতে বোঝায় ফর্সা ত্বক
- নারী প্রবলরকম ভোগলিপ্সা উৎপাদনকারী অনুষঙ্গ
- নারী গৃহিণী গৃহের যাবতীয় কর্ম, ভালো-মন্দ দেখভাল করার দায়িত্ব তার
- নারী ঈর্ষাকাতর প্রভৃতি
এখানে কোথাও নারীর মস্তিষ্কের উপস্থিতি নেই। একটা ব্লেডের বিজ্ঞাপনেও যখন অপ্রয়োজনীয়ভাবে খুব কমনীয় উপায়ে নারীকে উপাস্থাপন করা হয় কিংবা পুরুষদের পারফিউমের কার্যকারিতা বোঝানোর জন্য এক ঝাঁক নারীকে ব্যবহারকারী পুরুষটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার দৃশ্য তুলে ধরতে হয় তখন আমাদের মনোজগতে নারীর প্রতিকৃতিটা আর বিশ্লেষণ করে বুঝতে হয় না।
পড়ুন….
সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার হন বিবাহিত পুরুষরাও
ত্বক ফর্সা না হওয়ার কারণে নারীদের বিয়ে, ক্যারিয়ার আটকে যাওয়ার ধারণা সাপ্লাইকারী বিজ্ঞাপণগুলো তো ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে এখনো নির্মিত হয়। মাঝে কেউ এসে হয়তো বলতে চেষ্টা করেছেন, ‘সুন্দর মানে কি শুধুই ফর্সা?’ কিন্তু সেই বক্তব্যের খুব একটা বিস্তৃত প্রভাব লক্ষ্য করা যায় না।
এখনো বিজ্ঞাপন বলছে সাবানের সৌরভে পুরুষ আকুল হয়ে ছুটে আসবে, টুথপেস্টের সুগন্ধেও কাছে আসবে পুরুষ, ছুটে আসবে পাউডার, ভ্যাসলিনের চাপা সুরভিতে। আর পারফিউম হলে তো কথাই নেই।
মোদ্দাকথা হলো ভোগ; নারী এইসব পণ্য ব্যবহার করে পুরুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেবে ভোগের বাসনা। অর্থাৎ খুব সুনির্দিষ্টভাবে যদি এই বিজ্ঞাপনগুলোর বক্তব্য বুঝতে যাই তাহলে দাঁড়ায়- এই বিজ্ঞাপনগুলো নারীকে আরো মোহনীয়, আরো ভোগ্য হিসেবে উপস্থাপনে সহায়তা করবে।
অন্যদিকে, আর এক গোত্রীয় বিজ্ঞাপন বলতে চায় নারীর কাজ ঘরকন্যা, রান্না-বান্না, হাড়িপাতিল ধোয়া, ঘর মোছা, বাথরুম পরিষ্কার করা। কালেভদ্রে একটা দুটো বিজ্ঞাপনে ভিন্নদৃশ্য পেলেও সার্বিকভাবে আমরা একই জায়গাতে আটকে আছি।
বাথরুম পরিষ্কারক একটা পণ্যের বিজ্ঞাপনের উদাহরণ টেনেই বলছি; বিজ্ঞাপন চিত্রটিতে চল্লিশ বছরের একটি ধারাবাহিক চিত্র তলে ধরা হয়েছে। মা থেকে মেয়ে এভাবে পরম্পরায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে পণ্যটি।
এই সময়ে দাঁড়িয়ে যখন সমাজের চিত্রটি আগের জায়গায় স্থির নেই অনেক গৃহেই রান্না-ঘর পরিষ্কার-কাপড় ধোয়া বা হাড়িপাতিল ধোয়ার মতো গৃহস্থালি কাজগুলো নারীর পাশাপাশি পুরুষও সম্পাদন করছেন। গৃহকর্তা নামক রাশভারি চরিত্রটি ধীরে এবং স্বল্প মাত্রায় হলেও স্বরূপ বদলাচ্ছে।
- নির্দ্বিধায় আমরা আকাঙ্খা করি সর্বোতভাবে এই পরিবর্তন ঘটুক তখন বিজ্ঞাপনটি দেখার পর প্রশ্ন জাগে চল্লিশ বছর ধরে কি নারীরাই বাথরুম পরিষ্কার করছে? কিংবা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম এই ধারাই অব্যাহত থাকবে? ধীরে হলেও সামাজিকভাবে কিন্তু এই দৃশ্যের পরিবর্তন ঘটছে। তাহলে বিজ্ঞাপনে সেই পরিবর্তন কেন উপস্থাপিত হচ্ছে না?
এবার আসি বিজ্ঞাপনে উপস্থাপিত নারীর চরিত্র নির্মাণের সাধারণ প্রবণতায়। হালের একটা বিজ্ঞাপন দৃশ্যের উল্লেখ করছি; দু’জন নারী একে অন্যকে মুখোমুখি হেঁটে অতিক্রম করছে। একজনের পোশাক অনুজ্জ্বল সাদা, আরেক জনের ধবধবে সাদা। অনুজ্জ্বল সাদা সে অপর জনের দিকে ঈর্ষাকাতর বাঁকা চোখে তাকিয়ে ভাবছে ওর কাপড় এত সাদা হলো কী করে! কিংবা একজন নারী পড়শির ঘরের দরজার ফুটো দিয়ে দেখছে তার ঘরের বিশেষ ফার্নিচার।
প্রশ্ন হতে পারে নারী কি এমনই ভোগ উপযোগী, সৌন্দর্যসর্বস্ব, ঈর্ষাকাতর, গৃহস্থালি কাজের কর্মী ‘সুপারমম’? নাকি আমরা নারীকে এভাবেই দেখতে চাই? সমাজের পুরুষতান্ত্রিক মনোজগত নারীকে যেভাবে দেখতে স্বচ্ছন্দ বোধ করে বিজ্ঞাপনে নারী সেভাবেই উপস্থাপিত হয়ে আসছে দিনের পর দিন।
বাথরুম পরিষ্কারক বিজ্ঞাপনটির মতই প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম প্রবাহিত করে দেয়া হচ্ছে মনোজাগতিক এই দৈন্যতা। মেয়েশিশু জানছে এইসব পণ্য তাকে মনোহরী করে তুলবে, বড় হয়ে সে বাথরুম পরিষ্কার করবে, রান্না করবে, ছেলেমেয়ের যত্ন করবে; সুপারমম হয়ে উঠবে।
ছেলেশিশু জানছে ওই পারফিউম মাখলে মেয়েরা তার দিকে ঝাঁক বেঁধে ছুটে আসবে। ওই মোটরবাইকে চড়ে ঘুরে বেড়ালে মেয়েরা লালায়িত হয়ে দৌঁড়ে আসবে পিছু পিছু; তার আছে পেশি, বড় হয়ে সে হবে গৃহকর্তা, ঘরে ফিরলে তার জন্য প্রস্তুত থাকবে গরম চা, তার বউ রাঁধবে এবং রান্না মজা না হলে সে মুখ ফিরিয়ে নেবে।
এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে নারীর মেধাকে, যোগ্যতাকে, প্রতিভাকে পাশ কাটিয়ে তার শরীরী সৌন্দর্য এবং ‘মেয়েলি’ গুণপণাকে বিচার্যের মাপকাঠি হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিকতা দিয়ে রেখেছে বিজ্ঞাপন।
‘সুন্দর মানেই যেমন ফর্সা ত্বক’ নয়; তেমনি নারীর গুণ মানেই কাপড়কে ধবধবে সাদা করে ফেলা, মেঝে-বাথরুম বা শরীরকে জীবানুমুক্ত রেখে পরিবারকে সুরক্ষিত রাখা, ভালো রান্না করা কিংবা ঘর-বাইরের সমস্ত কাজ একা সামলে সুপারউইম্যান হয়ে ওঠা নয়।
- গৃহস্থালিতে অদক্ষ কিংবা অসুন্দর (সামাজিক সংজ্ঞায়) মেয়েটির থাকতে পারে অন্য কোনো দক্ষতা অথবা প্রতিভা। কিন্তু সেই প্রতিভাকে সমাজ কি গ্রহণ করতে, লালন করতে প্রস্তুত? না, প্রস্তুত নয়। বিয়ে-সংসার-গৃহস্থালির টবে রোপিত নারী সমাজ অনুমোদিত আকারেই বেড়ে ওঠে কিংবা বেঁচে থাকে।
- ‘প্রতিভা’ বা বাড়তি কোনো ‘যোগ্যতা’র মত বাড়তি কোনো ডালপালা গজিয়ে উঠলে সমাজ বা সমাজপদ্ধতি স্বয়ংক্রিয় উপায়ে সেগুলো ছেটে ফেলে। অনেক কিছু বদলালেও সমাজের হাড়মজ্জায় মিশে থাকা এই চরিত্রবৈশিষ্ট্য কিন্তু বদলায়নি। বরং নতুন নতুন মোড়কে আবর্তিত রয়েছে।
যেসব মাধ্যম এই প্রক্রিয়াকে সচল রাখতে সহায়তা করে বিজ্ঞাপন তার মধ্যে অন্যতম। যদি কেউ আপত্তি তুলে বলতে চান যে সমাজ থেকেই এইসব ভাবনা আহরিত; তাহলে উল্টোভাবে বলা যায় সমাজের নাড়িনক্ষত্র পর্যালোচনা করেই তো বিজ্ঞাপন নির্মিত হয়। কোনো জিনিসটা কীভাবে উপস্থাপন করলে ভোক্তা লুফে নেবে সেই স্পর্শকাতর জায়গাটিকে নির্মাতা বুঝে নেন বলেই দর্শক এত সহজে আকৃষ্ট হয়ে পড়ে।
সেক্ষেত্রে প্রশ্ন আসতেই পারে, মানুষকে প্রভাবিত করার এত শক্তিশালী একটা মাধ্যম পশ্চাৎপদ একটা জায়গায় কেন আবদ্ধ রেখেছে নিজেকে? এটি কি চাইলেই পারে না পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে? হয়তো পারে না। কারণ এখনো আমাদের পারিবারিক এবং সামাজিক জীবনে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় রয়েছে পুরুষ এবং পুরুষতন্ত্র। এই পুরুষতন্ত্রের ধারক বাহক শুধু পুরুষই নয়, নারীও। এমনকি পারিবারিক গণ্ডিতে পুরুষতন্ত্রকে সচল রাখতে পুরুষের চেয়ে নারীই সক্রিয় ভূমিকা রাখছে।
আরো পড়ুন….
যৌন স্বাস্থ্য বা দাম্পত্য সম্পর্কে অতি চঞ্চলতার প্রভাব
অতি চঞ্চল ও অমনোযোগী শিশু : ভবিষ্যত কী?
হয়তো মা-ই কন্যাকে পাত্রস্থ করার জন্য নানা পণ্য মেখে তাকে আকর্ষণীয় করে তুলতে চাইছেন। অথবা পুত্রবধূ হিসেবে পরিপাটি পটের বিবির খোঁজ করছেন ছেলের মা। আর এভাবে পুরুষ এবং পুরুষতন্ত্রের পাতে উপস্থাপিত হওয়ার জন্য নারীর প্রয়োজন পড়ছে বারো রকমের পণ্যের।
- যার খোঁজ নিয়ে তার সামনে হাজির হচ্ছে বিজ্ঞাপন। আর সেই বিজ্ঞাপনে এমন ভাবনাই উস্কে দিচ্ছে যে, নিখুঁত সুন্দর কেতাদুরস্ত সুগৃহিণী নারীর বিপুল চাহিদা আমাদের সমাজে। শুধু ঘরেই কেন, পথে-ঘাটে, অফিস-আদালতেও সুরভিযুক্ত, উজ্জ্বল রঙের অধিকারী, আবেদনময়ী, কমনীয় নারীর তুমুল চাহিদা।
এসব বিজ্ঞাপন আমাদের মানসিকতায় গেঁথে দিচ্ছে যে, নারীর যোগ্যতা শুধু তার মেয়েলি সৌন্দর্যে এবং সমাজ নির্মিত মেয়েলি কার্যদক্ষতায়। এমনকি নারী নিজেও জড়িয়ে যায় এই ফাদে। চাইলেও সে এখান থেকে বেরোতে পারে না, প্রত্যাখ্যান করতে পারে না তাকে মোড়কে মুড়িয়ে জড় বানিয়ে রাখার চকচকে আয়োজন। কারণ বিজ্ঞাপন-সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি- নারীর মনোজগত সবই পরস্পরনির্ভর।
যারা এর বাইরে সমাজে তাদের অবস্থান এখনো সংখ্যালঘু। বৃহত্তর পরিসরে নারীর অবস্থানের পরিবর্তন চাইলে সার্বজনীন মনোজাগতিক পরিবর্তন প্রয়োজন। নইলে নারীরা পরশ্রীকাতর সুসজ্জিত পৌত্তলিকা-চরিত্রের ভেতরই আবদ্ধ থেকে যাবে চিরকাল।
আধুনিকতার চূড়ান্তে এসেও এটাই যদি হয় নারীর ভবিতব্য, তবে সেটা পরিতাপের। নারীর এই অবস্থানের পেছনে যেমন বিজ্ঞাপনের দায় রয়েছে তেমনি এর থেকে বেরিয়ে আসার জন্যও বিজ্ঞাপন গুরুত্বপর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
সাদিকা রুমন- প্রতিবেদক মনের খবর।
সূত্র : ‘মাসিক মনের খবর’ মার্চ ১৮’ সংখ্যা। মাসিক মনের খবর ম্যাগাজিন সংগ্রহ করতে চাইলে কল করুন : 01797296216 এই নাম্বারে। অথবা মেসেজ করুন ফেসবুক পেজের ইনবক্সে।
দাম বাড়ছে মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনের
/এসএস/মনেরখবর/