‘মানসিক রোগ’ বা ‘মনোরোগ’–এ শব্দগুলো আমাদের চিন্তাজগতে এখনও যথেষ্ট নতুন; যদিও পাশ্চাত্যের দেশগুলোয় দেড়শ বছরেরও বেশি সময় আগে মনোরোগবিদ্যা চিকিৎসাবিদ্যার একটা স্বতন্ত্র শাখা হিসেবে পথচলা শুরু করেছে।
আমাদের সমাজে, আমাদের চিন্তা-চেতনায় ‘পাগল’, ‘পাগলামি’ শব্দগুলো বহুল পরিচিত এবং মানসিক রোগের প্রায় সমার্থক হিসেবে বহুল ব্যবহৃত। আমরা সেই সাথে শুনে থাকি আরও কিছু শব্দ বা শব্দগুচ্ছ; যেমন– ‘ব্রেইনে ডিস্টার্ব’, ‘মাথায় গণ্ডগোল’। রসিকতা বা তাচ্ছিল্য সহকারে বলি ‘স্ক্রু ঢিলা’, ‘ব্রেইনে শর্ট-সার্কিট হয়েছে’ এমন আরও অনেক কিছুই।
আরও আছে ‘জিনে ধরা’, ‘ভূতের আছর’, ‘বাণ মারা’, ‘তাবিজ করা’, ‘জাদু-টোনা করা’ প্রভৃতি ব্যাখ্যা। এভাবে, আর্থিক অবস্থান, শিক্ষা-দীক্ষা প্রভৃতি ভেদে মানসিক রোগ নিয়ে আমাদের চিন্তা-ভাবনার মধ্যে কিছুটা তারতম্য দেখা যায়। কিন্তু এ তারতম্য আসলে আমাদের না জানাকেই সমর্থন করে। আর সমর্থন করে মানসিক রোগ নিয়ে আমাদের বিভিন্ন প্রচলিত ধারণার অসারতা।
কারণ, এসব থেকে বোঝা যায়- আমরা মনে করি, মানসিক রোগ আসলে মস্তিষ্কের (Brain) সমস্যা। একটু ঘুরিয়ে বললে ব্যাপারটা দাঁড়ায় এমন, মস্তিষ্কের সমস্যা ছাড়া মানসিক রোগ হতে পারেনা। এ ধারণার আরও গভীরে গেলে উঠে আসে আরেকটি ভুল ধারণা, মন আসলে মস্তিষ্কের বাইরে অন্য কিছুই নয়। অথবা, মানসিক রোগ হল অতিপ্রাকৃত (Supernatural) শক্তির খারাপ প্রভাবের ফলাফল; অতএব, এসব অতিপ্রাকৃত শক্তির সন্তুষ্টি অর্জনই এর একমাত্র সমাধান।
এতো গেল একটা দিক। আরেকটা দিকে আছেন, আমাদের মধ্যেই আপাত সচেতন কিছু মানুষ, যারা মানসিক রোগ সম্পর্কে জানেন মোটামুটি, কিন্তু পুরোপুরি নয়। যে কারণে তারা বুঝতে পারেন, সিজোফ্রেনিয়ার মতো বিষণ্ণতাও একটি মানসিক রোগ। কিন্তু বুঝতে পারেন না, মনোরোগবিদ্যা (Psychiatry) আর মনোবিদ্যা (Psychology) আসলে ভিন্ন ব্যাপার এবং এদের মধ্যে পার্থক্য আছে। তারা গুলিয়ে ফেলেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের (Psychiatrist) সাথে মনোবিদের (Psychologist) বা চিকিৎসা মনোবিদের (Clinical Psychologist) ভূমিকার বা কর্ম-পরিধির ভিন্নতাকে।
মানসিক রোগের চিকিৎসা নিয়েও আছে আমাদের অনেক রকম ধারণা। অনেক রহস্যময়তা বা নাটকীয়তা দিয়ে ঘেরা আমাদের এসব ধারণা। মানসিক রোগের চিকিৎসা বলতেই সম্মোহন, বৈদ্যুতিক শক, ‘পাগল বানানোর ইনজেকশন’ এরকম বেশ কিছু ব্যাপার আমাদের চিন্তায় ঘুরপাক খায়। অনেকে আবার ভাবেন, মানসিক রোগের চিকিৎসা মানেই মনঃসমীক্ষণ (Psychotherapy) বা কাউন্সেলিং (Counseling)। অন্যদিকে, কিছু চিকিৎসকও আছেন, যারা মনোরোগ বিশেষজ্ঞ না হওয়া সত্ত্বেও ভাবেন, যেকোনো ধরনের মানসিক রোগের চিকিৎসা তারা করতে পারেন এবং সে চিন্তা থেকেই বিভিন্ন চিকিৎসাপত্র লিখে দেন।
আবার আছে মানসিক রোগ সম্পর্কিত শব্দের নেতিবাচক উপস্থাপনা। যেমন- প্রায়ই আমরা ব্যবহার করি ‘সাইকো’, ‘মেন্টাল’ প্রভৃতি শব্দ। আর কারো সত্যি সত্যি মানসিক রোগ হলে তো কথাই নেই; পারিবারিক বা সামাজিক সব ক্ষেত্রেই উপহাস আর অবহেলা হয়ে যায় তার নিত্যসঙ্গী।
এভাবে, মানসিক রোগ এবং এ সম্পর্কিত বিবিধ বিষয় চাপা পড়ে থাকে আমাদের সমাজে। যে কারণে, কারো মানসিক রোগ হলে তিনি এবং তার আশেপাশের লোকজন প্রথমে তা বুঝতে পারেন না, গ্রহণ করেন তাবিজ-কবচ, ছুটে যান কবিরাজের কাছে। অথবা বিভিন্ন রকমের চিকিৎসকের কাছে ঘুরে ফিরে জানতে পারে মানসিক রোগ সম্পর্কে। জানতে পেরে প্রথমেই চেষ্টা করেন তা গোপন করার, চেষ্টা করেন অন্য কোনোভাবে তা সমাধানের, অথবা শুধু সাইকোথেরাপির মাধ্যমে কাজ সারতে। অবশেষে এক প্রকার অপারগ হয়েই শরণাপন্ন হন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে। এখানেই শেষ নয়। চেষ্টা করেন ওষুধ না খেতে অথবা একটু ভালো বোধ করলেই ওষুধ খাওয়া ছেড়ে দিতে।
শুধু আমাদের সার্বিক ভুল ধারণার কারণে বা অসম্পূর্ণ ধারণার কারণে এভাবেই প্রতি পদে পদে ভুগতে থাকেন আমাদের চারপাশেই বসবাস করা একজন মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তি। সাধারণ মানসিক সমস্যা রূপ নেয় জটিল, দীর্ঘমেয়াদী অসুখে। ব্যক্তির সাথে সাথে ভুগতে থাকে পরিবার, ক্ষতিগ্রস্ত হয় সমাজ, রাষ্ট্র।
আর তাই প্রয়োজন মন, মানসিক রোগ বা মনোরোগ সম্পর্কে সচেতনতা বা সঠিক ধারণা সৃষ্টি।
লেখক
ডা. পঞ্চানন আচার্য্য
এম ডি (সাইকিয়াট্রি) ফেইজ-বি রেসিডেন্ট
মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।