মনোরোগ বিশেষজ্ঞ
ছোটবেলায় বাবা-মার কাছে চাইলেই সব পাওয়া যেত না। সন্তানকে দেয়া আর না দেয়ার ক্ষেত্রে বাবা-মার মধ্যে হিসেব নিকেশ চলত। আর না পেয়ে আমার মন হত ভারী। মনে মনে ভাবতাম খালি বড় হয়ে নেই, এরপর চাকুরি-বাকুরি করে সব স্বাদ মেটাবো। এখন অনেক বড় হয়েছি, নিজের স্বাদ মেটাই ঠিকই কিন্তু সবার আগে প্রাধান্য পায় সন্তান কিংবা পরিবারের ইচ্ছেপূরণে।
রবীন্দ্রনাথের সেই ইচ্ছেপূরণ ছোটগল্পটির মত এখন মনে হয় ছোটবেলার সেই জীবনটাই না কত ভালো ছিল। লেখাপড়া ছাড়া বড় কোন দায়িত্ব ছিল না। অথচ কত দায়িত্ব এখন নিজের উপর। এই দায়িত্ব পালনে আমার মত কত মানুষ কত পথ বেছে নেয়। কেউ বা পারি জমায় ভীনদেশে।
নিজে ভালো থাকা ও পরিবারকে ভালো রাখার উদ্দেশ্যে জমিজমা বিক্রি করে পরিবার পরিজন ছেড়ে দূরদেশে গিয়ে অর্থ উপার্জনকারী প্রবাসী এই মানুষগুলোই কিন্তু আজ দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। সব মিলিয়ে বিদেশে যাওয়া শ্রমিকদের পাঠানো ডলার যেন এখন অর্থনীতির বড় শক্তি হয়ে উঠেছে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও বড় হচ্ছে সেই অর্থে।
অথচ প্রবাসী যাদের শ্রমের টাকায় দেশের উন্নয়ন হয়, সে উন্নয়নের অংশীদারদের সঠিকভাবে সম্মান দিতে পারছি কি আমরা? শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা নিশ্চিতে কোননো ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কি এখনও?
পরিবারের মুখে এক চিলতে হাসি ফোটাতে দেশান্তরি এসব মানুষ প্রায়ই মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসকদের কাছে আসছেন চিকিৎসার জন্য। সুখের আশায় গেলেন সব শেষ করে অথচ ফিরে এলেন রোগী হয়ে। এমন দুঃখজনক ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। কিন্তু কেন?
একজন প্রবাসী যখন নিজের চেনা জগত ছেড়ে অচেনা জগতে পা বাড়ায় স্বভাবতই এটি তারজন্য একটি চাপ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ আপনজনকে ছেড়ে আসতে হয় তাদের একটি লম্বা সময়ের জন্য, যেখানে চাইলেই ছুটি মেলে না।
তাছাড়া অজানা পরিবেশ, নতুন নতুন মানুষ, ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন রীতিনীতি, খাবার দাবারের ভিন্নতা স্বভাবতই খাপ খাইয়ে নিতে কষ্ট হয়। এই কষ্ট থেকে অনেকে বের হতে পারলেও কেউ কেউ কিন্তু পারেন না। দেখা দিতে পারে এডজাস্টমেন্ট প্রবলেম কিংবা দুশ্চিন্তা, বিষণ্ণতা, ঘুমের সমস্যা ছাড়াও জটিল অন্যান্য মানসিক রোগ।
পরিবারের লোকজন মনে করে তারা কতই না সুখে আছে। মাস শেষে যখন একটা মোটা অঙ্কের টাকা হাতে আসে তখন এমন ভাবনা ভাবাটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু সে-ই জানে সে কতটা সুখে আছে। এখানে প্রতিটি সেকেন্ডের হিসাব কড়ায় গন্ডায় দিতে হয়। খেয়ে না খেয়ে আট ঘণ্টার ডিউটি পনের ঘণ্টা পার হয়ে যায়, তবেই না মাস শেষে এতগুলো টাকা পাওয়া যায়।
এভাবে বছরের পর বছর হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমম করে অর্থ উপার্জন করেন প্রবাসীরা। পরিবারের চাহিদা মেটাতে গিয়ে শরীর আর মনের দিকে খুব একটা খেয়াল রাখার সময় যেন হয়ে ওঠে না। ধীরে ধীরে নানাবিধ শারীরিক আর মানসিক বিপর্যয় দেখা দিতে থাকে। চাইলেই দেশে চলে আসা যায় না।
কারণ অধিকাংশরই ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে ঘুরে। তার ওপর দেশে এসে কী করবেন সেই চিন্তাও মাথায় থাকে। এই অতিরিক্ত চিন্তা তাকে ধীরে ধীরে মানসিকভাবে অশান্ত করে তোলে। এছাড়া আবার অনেকে নিয়মিত মজুরীও পান না। আয়ের চেয়ে চাহিদা বেশি থাকায় একসময় তারা হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়েন।
প্রতিদিন অনেকেই যেমন পাড়ি জমাচ্ছেন বিদেশে তেমনি অনেকে আবার ফিরেও আসছেন বিভিন্ন কারণে টিকতে না পেরে। এর মধ্যে একটি বড় কারণ নির্যাতনের স্বীকার হওয়া। এই ফেরার সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে বড় একটা অংশ হচ্ছে নারী। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ১ কোটি ৪৬ লাখ ৭৮৯ জন বাংলাদেশি শ্রম অভিবাসীর মধ্যে ৭ লাখ ২৭৮ জন নারী রয়েছেন।
বিভিন্ন পত্রিকাসূত্রে জানা যায়, বর্তমানে নারী শ্রম-অভিবাসী ১ লাখ ২১ হাজার ৯৮৫ জন। প্রবাসী নারী শ্রমিকদের ফিরে আসার ভিন্ন ভিন্ন কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো চাহিদামতো খাবার না পাওয়া, পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারা, গৃহকর্তার যৌন নিপিড়ন, পরিবারের অন্যন্যদের দ্বারা শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন, দীর্ঘ কর্মঘণ্টা এবং পারিবারিক দুশ্চিন্তা।
নির্যাতিত হয়ে ঋণের বোঝা নিয়ে যখন একজন কর্মী দেশে আসে তখন তার মানসিক অবস্থা কেমন হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। আর যারা নির্যাতন সহ্য করে সেই দেশে থেকে যায় সে এক সময় বিভিন্ন রকম চাপজনিত রোগ ছাড়াও দীর্ঘমেয়াদি দুশ্চিন্তা কিংবা বিষণ্ণতায় ভুগতে পারেন। যা তাকে এক সময় মাদকের দিকে টেনে নিয়ে যেতে পারে।
বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের তথ্য মতে, চলতি বছর এ পর্যন্ত শারীরিক, মানসিক, যৌন নির্যাতনসহ বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন দেশ থেকে ৮১৯ জন নারী শ্রমিক ফেরত এসেছেন। এর মধ্যে তিনজন নারী শ্রমিক দেশে ফিরেছেন মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায়। আর ২০১৮ সালের জুন মাস থেকে মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় দেশে ফেরা নারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭৯ জন। তবে এ সংখ্যা আরও বেশী হবে এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
সম্প্রতি ব্র্যাকের একটি জরিপে দেখো গেছে, ৭৪ শতাংশ অভিবাসী কর্মী মানসিক সমস্যায় থাকেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিষয়ক সচেতনতাও কম। যার ফলে, অনেকে হতাশাগ্রস্থ হয়েও মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। এমনকি আত্মহত্যার পথও বেছে নেন।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য মতে, বিশ্বের ১৬৮টি দেশে বাংলাদেশী কর্মীরা কাজ করতে যায়। অথচ তাদের অধিকার সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশ মিশনে শ্রম কল্যাণ উইং আছে মাত্র ২৯টি।
অথচ কর্মীদের যথার্থ সেবা, সুরক্ষা এবং অধিকার নিশ্চিত করতে আরও শ্রম কল্যাণ উইং প্রয়োজন। স্থানীয় ভাষাজ্ঞানের অভাব, দোভাষী এবং আইনি পরামর্শক নিয়োগের জন্য অপ্রতুল অর্থায়ন সেসব দেশে অভিবাসীদের ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।
প্রবাসীদের ভালো রাখতে হবে নিজেদের স্বার্থেই। তারা ভালো না থাকলে দেশের অর্থনীতি ভালো থাকবে না। শারীরিকভাবে তো বটেই মানসিকভাবে ভালো থাকাটাও অত্যন্ত প্রয়োজন। তারা যেন মানসিকভাবে ভালো থাকেন এরজন্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে।
যেমন, কর্মঘণ্টা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী করতে হবে, পর্যাপ্ত বিশ্রামের সুযোগ রাখতে হবে, আর্থিক নিপীড়ন বন্ধে বাংলাদেশি কর্মচারীদের যুক্তিসংগত মজুরি নিশ্চিত করতে সরকারকে ভ‚মিকা রাখতে হবে। অবশ্যই অভিবাসী কর্মীদের নিজ নিজ কাজের ওপর প্রশিক্ষণ দিয়ে পাঠাতে হবে।
নির্যাতন বন্ধে দূতাবাসগুলোকে জোড়াল ভূমিকা রাখতে হবে, নিয়মিত পরিবারের সাথে যোগাযোগ যেন সহজ হয় সে ব্যবস্থা নিতে হবে। মানসিক চাপ কমাতে অভিবাসন ব্যয় নিয়ন্ত্রণ এবং প্রবাসী শ্রমিকদের মানসিক বিকাশের জন্য পর্যাপ্ত বিনোদনের ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে এবং সেই সাথে অসুস্থতাজনিত কারনে দেশে ফিরে এলে তারজন্য আর্থিক প্রণোদনা কিংবা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
এছাড়াও প্রবাস জীবনে একাকিত্ব এড়ানোর জন্য বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া, ছুটিতে বেড়াতে যাওয়া ও সুস্থ বিনোদনে অংশ নেয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। মোদ্দাকথা, প্রবাসীদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হলে মানসিক স্বাস্থ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। এতে কাজের প্রতি উৎসাহ বৃদ্ধি পাবে এবং দেশের অর্থনীতির গতি সচল থাকবে।
লেখক :
সহকারী অধ্যাপক
মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ, সিরাজগঞ্জ
সূত্র : মাসিক ‘মনের খবর’ আগস্ট ২০২২ সংখ্যা
- মাসিক মনের খবর প্রিন্ট ম্যাগাজিন সংগ্রহ করতে চাইলে কল করুন : 01797296216 এই নাম্বারে। অথবা মেসেজ করুন পেজের ইনবক্সে। লেখা পাঠাতে পারেন monerkhaboronline@gmail.com বা এই 01844618497 হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বারে।
/এসএস/মনেরখবর/