নিত্যপ্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণের পাশাপাশি শখের বশে, প্রিয়জনদের আবদার রক্ষা করতে, সামাজিকতা রক্ষার্থে কমবেশি কেনাকাটা হরহামেশাই আমাদের করতে হয়। আর মাঝে মাঝে বেহিসেবী কেনাকাটাও আমরা অনেকেই করি। কিন্তু এই কেনাকাটা তখনই রোগের পর্যায়ে পড়ে যখন তা হয় অতিরিক্ত, অপ্রয়োজনীয়, আবেগ তাড়িত; যা কারো জীবনের করুণ পরিণতি ডেকে আনে। পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক জীবনকে বিপর্যস্ত করে, আবার কখনও কখনও তা মামলা মোকদ্দমা সম্মুখীনও করে। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলা হয় কম্পালসিভ বাইং ডিজঅর্ডার বা ওনিওম্যানিয়াবা শপাহোলিয়া।
বিগত কয়েক দশকে এ রোগটি বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিতি পেলেও মনোবিজ্ঞানে এর উল্লেখ রয়েছে বহু আগে থেকেই। জার্মান সাইকিয়াট্রিস্ট এমিল ক্রেপলিন ১৮১৫ সালে এবং সুইস সাইকিয়াট্রিস্ট ইউজেন ব্লুলার ১৯২৪ সালে এর বর্ণনা দেন। তারা উভয়েই এই রোগটিকে তাদের পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করেন।
আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশন ডায়াগনোস্টিক এন্ড স্ট্যাটিসটিক্যাল ম্যানুয়াল ৫ (ডিএসএম ৫) অনুযায়ী কম্পালসিভ বাইং ডিজঅর্ডার বা বাতিকগ্রস্ত কেনাকাটার রোগীদের বৈশিষ্ট্য হলো- এদের মাঝে অতিরিক্ত, অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটা করার জন্য এক ধরণের অপ্রতিরোধ্য, অদম্য ইচ্ছা জাগে, যা না করতে পারলে তারা প্রচণ্ড অস্বস্তিতে ভোগে, আর সারাক্ষণ এই চিন্তায় আচ্ছন্ন থেকে প্রচুর সময় ব্যয় করে। কাঙ্ক্ষিত কেনাকাটা করার পর তাদের মাঝে তাৎক্ষণিক আনন্দানুভূতি হয়, স্বস্তি পায়, শিথিল হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই আনন্দ স্বল্পস্থায়ী হয় এবং কিছু সময় পরেই বিষণ্ণতা, রাগ, হতাশা তাদেরকে ঘিরে থাকে। কৃত সামগ্রী ফিরিয়ে দেয়া, বিক্রি করা, অন্য কাউকে দিয়ে দেয়া ইত্যাদি আচরণ এদের মাঝে পরিলক্ষিত হয়।
সমাজের যে কোন স্তরের মানুষের এই সমস্যা হতে পারে। কমিউনিটি ভিত্তিক এবং ডাক্তারি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে এ ধরণের রোগীদের মাঝে শতকরা ৮০ থেক ৯৫ ভাগই মহিলা। সাধারণত কৈশোরের শেষ এবং যৌবনের শুরুতে এ রোগ দেখা দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে, যাদের এ রোগের পারিবারিক ইতিহাস থাকে, পরিবারের আবেগ এবং উদ্বেগ জনিত রোগ, শুচিবাই রোগ, জুয়া ও মাদকে আসক্তি, বিঞ্জ ইটিং থাকে তাদের মাঝে এর প্রবণতা বেশি থাকে এবং প্রায় ৬০ শতাংশের মাঝেই কোন না কোন ব্যক্তিত্বের সমস্যা রয়েছে।
ফাংশনাল ম্যাগনেটিক রেসোনান্স ইমেজিং (এফএমআরআই) পরীক্ষায় দেখা গেছে এদের মস্তিষ্কের ভেন্ট্রাল স্ট্রায়াটাম অঞ্চলের কার্যক্রম বেড়ে যায় এবং ইনসুলার কার্যক্রম কমে যায়। সাম্প্রতিককালে প্রমাণিত হয়েছে কিছু নিউরোট্রান্সমিটার এর তারতম্যের জন্যও এ সমস্যার সৃষ্টি হয়। কেনাকাটা করার পর যে আনন্দ হয় তা মস্তিষ্ক থেকে ডোপামিন এবং এন্ডরফিন এর নিঃসরণের ফলে হয় যা ব্যক্তিকে আরও কেনাকাটা করতে উৎসাহিত করে এবং এক সময় তাদের আসক্ত করে ফেলে। মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা অনুযায়ী যারা অন্যের কাছ থেকে বেশি বেশি অনুমোদন বা স্বীকৃতি পেতে চায়, যাদের আত্মমর্যদাবোধ বেশি, যারা কল্পনার রাজ্যে বাস করে এবং নিজেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে দেখতে চায়, অথবা যারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকে, হতাশা দূর করতে চায় তাদের মাঝে এই রোগ দেখা যায়। কেউ কেউ আবার খুব আত্ম সচেতন হওয়ার কারণে ফ্যাশন ভিকটিম হয়ে যার আর অত্যধিক কেনাকাটার চক্রে ঢুকে পড়ে। অনলাইনে কেনাকাটা, পণ্যের চমক লাগানো বিজ্ঞাপন, ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে কেনাকাটার সুযোগ, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ইত্যাদি বিভিন্ন উপাদান (যেমন- ঈদ, পূজা-পার্বণ, বড়দিনের মতো গুরুত্বপূর্ণ উৎসব, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী) বস্তুবাদী ও ভোক্তা চালিত সমাজব্যবস্থা এতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
মহিলাদের মাঝে সাধারণত পোশাক, জুতা, গহনাদি, গৃহস্থালির সামগ্রী ইত্যাদি আর পুরুষদের ইলেক্ট্রনিক্স, স্বয়ংচালিত যন্ত্রপাতি, হার্ডওয়্যার ইত্যাদি কেনার প্রবণতা লক্ষণীয়। কারও কারও কোন নির্দিষ্ট জিনিষের প্রতি আগ্রহ থাকে আর বিভিন্ন মডেলের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ঐ জিনিষ বেশি বেশি ক্রয় করতে থাকে। এরা সাধারণত একা কেনাকাটা করে অথবা তাদের মত একই সমস্যায় ভুগছে এরকম কাউকে সঙ্গী করে কেনাকাটা করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।
বিভিন্ন ধরণের কম্পালসিভ বাইয়ার/শপাহলিক/ বাতিকগ্রস্ত ক্রেতা/ কেনাকাটায় আসক্ত ব্যক্তি রয়েছে। যেমন-
ট্রফি বাইয়ার: মানসিক বিপর্যয়, হতাশা দূর করতে যারা অতিরিক্ত কেনাকাটা করে।
বুলিমিক বাইয়ার: কেনার পর যারা জিনিষ ফেরত দেয়।
বারগেইন বাইয়ার: মূল্যহ্রাসের সময় যারা কেনাকাটা করে।
পারফেকসনিস্ট বাইয়ার: যারা নিখুঁত জিনিষ পাওয়ার জন্য কেনাকাটা করে
কালেক্টর: যারা কোন সেট এর প্রতি আইটেম বা প্রতিটি রঙ সংগ্রহে রাখতে চায়।
অনেকে কম্পালসিভ বাইংকে ততক্ষণ পর্যন্ত রোগ হিসেবে দেখেন না যতক্ষণ পর্যন্ত না সে দেউলিয়া হয়ে যায়। কারণ, কেনাকাটা করতে মোটামুটি সবাই পছন্দ করে। নিচের বৈশিষ্ট্যগুলোর মাঝে ৪টি বা তার বেশি লক্ষণ থাকলে বুঝতে হবে কার মাঝে কম্পালসিভ বাইং এর সমস্যা রয়েছে।
– নির্দিষ্ট বাজেটের অতিরিক্ত কেনাকাটা করা।
– প্রয়োজন নেই এমন জিনিষ কেনা।
– পরিবার বা বন্ধুদের কাছে সমস্যার কথা গোপন করা।
– কেনার পর জিনিষ ফিরিয়ে দেয়া।
– কেনাকাটার চিন্তায় মগ্ন থাকায় সম্পর্কের অবনতি হওয়া।
– রাগ, দুঃখ, একাকীত্ব থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য কেনাকাটা করা।
– ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে কেনাকাটা করতে পছন্দ করা।
– কেনাকাটার পর অপরাধ বোধে ভোগে।
– সমাজের চোখে নিজেকে খুব খরুচে ব্যক্তি হিসেবে জাহির করতে কেনাকাটা করা।
কম্পালসিভ বাইং ডিজঅর্ডার রোগের কোন নিরাময়যোগ্য চিকিৎসা নেই। রোগীকে এ ব্যাপারে সচেতন করা এবং তাদের এ সমস্যা থেকে বের হতে উদ্বুদ্ধ করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া কিছু থেরাপি এবং কিছু ঔষধ এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে কার্যকরী ভূমিকা রাখে। যেমন-
I. মাইন্ডফুলনেস ট্রেইনিং- এর মাধ্যমে রোগী তাঁর ইম্পালস কন্ট্রোল করতে আর মানসিক বিপর্যয়কে মেনে নিতে শিখে।
II. কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি- গ্রুপ সেটিং এ ইহা অধিক কার্যকর। এতে রোগীকে তার অস্বাভাবিক চিন্তা এবং আচরণ সনাক্তকরণে এবং সংশোধনে সহায়তা করা হয়। তার ক্ষণস্থায়ী আনন্দের জন্য দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতিকর পরিণতির ব্যাপারে সচেতন করা হয়। আনন্দের উৎস হিসেবে বিকল্প বিভিন্ন কাজে উৎসাহিত করা হয়।
III. রিলেশনশিপ কাউন্সেলিং
IV. ফিনান্সিয়াল কাউন্সেলিং
V. প্যারেন্টাল কাউন্সেলিং- কৈশোর বয়সের রোগীদের জন্য প্রয়োজন।
VI. এন্টিডিপ্রেসেন্টস- সিলেক্টিভ সেরোটোনিন রিআপটেক ইনহিবিটর (SSRI), সিটালোপ্রাম
VII. এনজিওলাইটিক- স্বল্পমাত্রায় বেনজেডায়েজেপাইন রোগীকে শিথিল রাখতে সাহায্য করে।
VIII. অপিওয়েড এন্টাগনিস্ট- নেলট্রেক্সুন , নিমিফিন, ইত্যাদি কার্যকর।
এবং সাধারণ কিছু পরামর্শ
– সমস্যা সনাক্তকরণ এবং স্বীকার করতে হবে যে সমস্যা রয়েছ।
– মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এর সাথে আলোচনা করতে হবে।
– নির্দিষ্ট বাজেটে কেনাকাটার পরিকল্পনা এবং শপিং লিস্ট এবং চেক লিস্ট রাখতে হবে।
– পরিবার এবং বন্ধুদের সাথে সমস্যাটি শেয়ার করতে হবে।
– কাউকে সাথে নিয়ে শপিং করতে হবে।
– ক্রেডিট কার্ড পরিহার করতে হবে।
– ইন্টারনেট শপিং সাইট এবং টেলিভিশন চ্যানেল যেখানে শপিং এর বিজ্ঞাপন দেয় সেগুলো পরিহার করতে হবে।
– মন ভালো করতে বিকল্প ব্যবস্থা যেমন ব্যায়াম করা, সাঁতার কাটা, বই পড়া, গান শোনা ইত্যাদি করতে হবে।
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।