মূলত আমি এইসব তিক্ত অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়েই পৃথিবীর কদর্যতাকে জেনেছি

0
51

চলার পথে, কর্মক্ষেত্রে বা অন্যত্র – ঘরে-বাইরে যেকোনো জায়গায় লাঞ্ছনার শিকার হয় নারী। কোথাও-ই তার বিচরণ নিঃশঙ্ক নয়। শিশু বয়স থেকেই লাঞ্ছনার শিকার হতে হতে একটা সময় অভ্যস্ততায় পরিণত হয়ে যায় বিষয়গুলো। যেমন – রাস্তায় বেরুলে অস্বস্তিকর চাহনি, স্পর্শ কিংবা মন্তব্য এসবের সাথে মানিয়ে নিয়েই পথে বেরোয় এদেশের নারীরা। যেন এটাই স্বাভাবিকতা। শুধু বাইরে নয়, ঘরেও নারী লাঞ্ছিত হয় নীরবে নিঃশব্দে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিকটজনের হাতেই আক্রান্ত হয় নারীর শৈশব। যে আক্রান্ত হয় সে হয়তো নিজেকেই অপরাধী ভাবতে শুরু করে; লোকে তাকে মন্দ ভাববে – এরকম ধারণায় কারো কাছে নিজের লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনা প্রকাশ করা থেকেও বিরত থাকে। যে কারণে এসব নিঃশব্দ-অপরাধের প্রতিকারের নজির আমাদের চোখে পড়ে না। বিষয়গুলোতে সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যেই মনের খবরের ধারাবাহিক এ উদ্যোগ। নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে এবারে মনের খবরের মুখোমুখি হয়েছেন তন্বী (ছদ্মনাম)।
কেমন আছেন?
ভালো।
এখন কী করছেন?
একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করি।
আপনি তো একজন কর্মজীবী নারী, কাজের প্রয়োজনে কিংবা পড়াশুনার জন্য ঘর ছেড়ে বেরুতে হয়েছে- নারী হিসেবে কি কখনো আপনাকে বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়েছে?
সেটা কি বলার অপেক্ষা রাখে! শিশুকাল থেকেই তো অজস্রবার বিড়ম্বিত হতে হয়েছে।
দু’একটি অভিজ্ঞতার কথা কি বলা যায়?
যখন আমি শৈশব ছেড়ে কৈশোরে পা রেখেছি। বড় হওয়ার চিহ্নগুলো ফুটে উঠতে শুরু করেছে। তখন একবার চাচার বাসায় বেড়াতে যাই। দুজন কাজিনের সাথে বসে গল্প করছিলাম। একজন বয়সে বড়। আরেকজন আমারই সমান। হঠাৎ বড় যে ভাই সে আমাকে জাপটে ধরে চুমু দেয়। তখন আমার বয়স তের-চৌদ্দ হলেও আমি খুব বেশি কিছু বুঝতাম না। কী ভেবে আমি বিষয়টাকে হালকা করার চেষ্টা করি – যেন কিছুই হয়নি। এরপর সে নানাছলে আমাদেরকে নিয়ে ভেতরের ঘরে যায়। আমার সমবয়সী ভাইটির সামনেই সে আমাকে বিছানার দিকে ঠেলতে থাকে। আমি হয়তো তখন এ বিষয়গুলো তেমনভাবে জানিই না। কিন্তু তারপরও নিজের ভেতর থেকে একরকম আত্মরক্ষার প্ররোচনা তৈরি হয়। আমি বসে পড়ি এবং তার দু’পায়ের ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে যাই।
এই ঘটনাটা কি আপনার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছিল?
হ্যাঁ অবশ্যই। আমি কাউকে বলতে পারিনি। সেদিন রাতে সারারাত আমার ঘুম হয়নি। শুধু মনে হয়েছে আমিই বুঝি খারাপ। তাই আমার সাথে এরকম হলো!
কাউকে বলতে পারেননি কেন?
আসলে আমাদের সময়ে বাবা-মায়ের সাথে যেকোনো কিছু শেয়ার করার মত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হত না। যে কারণে এধরনের কথাগুলো কখনোই তাদের বলার কথা ভাবতে পারতাম না। তারা আমাদেরকে আদেশ-উপদেশ দিয়েছেন কিন্তু আমাদের জগৎ সম্পর্কে খুব একটা জানতে চাননি।
এতে কি আপনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে মনে করেন?
অবশ্যই মনে করি। কারণ ছোটবেলা থেকে শুধু শুনে এসেছি এভাবে চলবে না, ওভাবে চলবে না। তাতে কিন্তু বাইরের পৃথিবী সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা হয়নি। আমাকে শেখানো হয়েছে নিচের দিকে তাকিয়ে হাঁটবে, কেউ কিছু হাতে দিলে নিবে না ইত্যাদি। কিন্তু শেখানো হয়নি ঘরের বাইরেটা কেমন, সেখানে কেমন করে যুদ্ধ করতে হয়। নিচের দিকে তাকিয়ে হেঁটে আমি যুদ্ধ করতে শিখিনি। ছেলেদের সঙ্গে মেশায় আমার বারণ ছিল। এমন একটা ধারণা আমার মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে যে ছেলেদের সঙ্গ মানেই শয়তানের আনাগোনা। তাতে আমি প্রভাবিত হইনি। বরং ভেতরে ভেতরে বিরুদ্ধতা তৈরি হয়েছে। আর ছেলেদের সঙ্গে মেশায় এত বাধ্যকতা দিয়েও কোনো লাভ হয়নি। যেখানে আমি বিপদে পড়ার পড়েছি। যেহেতু আমি যুদ্ধ করতে শিখিনি তাই না বুঝেই ঘটনার শিকার হয়েছি। কাউকে বলতেও পারিনি। মূলত আমি এইসব তিক্ত অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়েই পৃথিবীর কদর্যতাকে জেনেছি এবং নিজেকে নতুন করে তৈরি করতে চেষ্টা করেছি।
আপনার জীবনের অভিজ্ঞতা কি আপনার নিজের সন্তানের প্রতিপালনে ভূমিকা রাখবে?
অবশ্যই। ছেলে বা মেয়ে যে সন্তানেরই আমি অভিভাবক হই না কেন তার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বন্ধু হতে চেষ্টা করব। শুধু নিষেধাজ্ঞা জারি করে কি আর কাউকে বিপদ থেকে রক্ষা করা যায়! মেয়ে সন্তানকে অন্তত এমন বলবো না যে তুমি নিচের দিকে তাকিয়ে হাঁটো। বরং আমি বলতে চাই, তুমি পৃথিবীর মুখোমুখি হও। আরেকটা বিষয় আমার মনে হয় – আমাদের পরিবারগুলোই শিশুদেরকে নারী ও পুরুষ হিসেবে তৈরি করে। খুব ছোটবেলা থেকেই মেয়েদেরকে শ্বশুরবাড়ির জন্য তৈরি করা হয় আর ছেলেদেরকে কর্তৃত্ব করার জন্য। যেমন কোনো মেয়ে বাচ্চা যদি রাগী, জেদী হয় ছোটবেলাতেই তাকে শুনতে হয় ‘শ্বশুরবাড়ি যেয়ে কী করবে!’ আবার ছেলেদের শেখানো হয় ‘পুরুষদের কাঁদতে নেই’ জাতীয় নানা বিষয়। এতে করে মেয়েরা প্রতিবাদ না করা, তার ওপর ঘটা অন্যায়কে চেপে যাওয়া, সীমাহীন নম্রতা, সমঝোতা ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য আয়ত্ত্ব করে বেড়ে ওঠাকে কর্তব্য মনে করে। বিপরীতে ছেলেরা ভোগের ধারণাকে প্রাধান্য দিয়ে কর্তৃত্বের মনোভাব নিয়ে বেড়ে ওঠে। আমি অভিভাবক হলে সন্তানদেরকে এইসব বিষয় থেকে মুক্ত রাখতে চেষ্টা করব। আমার মনে হয় মেয়েরা বলতে শিখলে, প্রতিবাদ করতে শিখলে আর ছেলেরা কর্তৃত্ব আর ভোগের মনোভাব থেকে মুক্ত হলে লোকচক্ষুর অন্তরালের এইসব লাঞ্ছনার ঘটনা হ্রাস পেতে পারে।
নিজের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে অন্যদের জন্য কোনো পরামর্শ?
কৈশোরে যখন আমি অমন কুৎসিত অভিজ্ঞতা অর্জন করি তখন শুধু মনে হত আমিই খারাপ আর আমার সাথেই শুধু এরকম হল। কিন্তু একটা সময় এসে দেখলাম আমার বন্ধুদেরও এমন অভিজ্ঞতা আছে। বুঝলাম আমি একা নই, সব মেয়েই এরকম কিছু দুর্বিষহ স্মৃতি চেপে রাখে। এসব ঘটনা এড়ানোর জন্য জানা এবং জানানোর কোনো বিকল্প নেই বলেই আমার মনে হয়। শিশুসন্তানটি কার সংস্পর্শে নিরাপদ সেটা বিচারের দায়িত্ব প্রথমত পরিবারেরই। এরপর তার নিজের ভেতরেই তৈরি করে দিতে হবে বিচারক্ষমতা।
তন্বীর মত অনেকেই হয়তো শিশু বয়সে লাঞ্ছনার শিকার হয়ে নিজেকে খারাপ ভাবতে শুরু করেন, ভোগেন দীর্ঘস্থায়ী মানসিক পীড়নে। তন্বীর পরামর্শ মেনেই বলা যায় আপনার শিশুসন্তানটি কার সংস্পর্শে নিরাপদ সেটা বিচারের দায়িত্ব প্রথমত পরিবারেরই। একইসাথে মনে রাখতে হবে – যে নিপীড়িত হয় অসম্মান তার নয়, অসম্মান নিপীড়কের এবং নিপীড়নের ঘটনা চেপে যেয়ে এর থেকে সমাজকে মুক্ত করা সম্ভব নয়।
সাদিকা রুমন, বিশেষ প্রতিবেদক
মনেরখবর.কম

Previous articleহঠাৎ করে অামার পড়াশোনার প্রতি টান কমে যায়
Next articleজাপানে আত্মহত্যার হার আরও বেড়েছে!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here