শিশুদের সুষ্ঠ মানসিক বিকাশের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বড়দের ভালোবাসা ও মনোযোগ। ধৈর্য্য সহকারে শিশুর অনুভূতির প্রতি ইতিবাচক সাড়া দিলে সে সুস্থ মানসিকতা নিয়ে বেড়ে উঠতে পারে। কিন্তু আমাদের সমাজে শিশুরা বিভিন্ন রকমের নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। শিশুদের উপর কোনো ধরনের নির্যাতনই কাম্য নয়। কারণ নির্যাতনের প্রভাব হয় অত্যন্ত ক্ষতিকর। শিশুদের প্রতি নির্যাতনের বিভিন্ন ধরন রয়েছে। যেমন- শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন। নানা উপায়ে শিশুদের এই ধরনের নির্যাতন করা হয়। যেমন-
ক) খুব বেশি নিয়ন্ত্রণ এবং খুব বেশি প্রশ্রয়দান
কোনো কোনো মা-বাবা বা অন্যান্যরা শিশুকে সবকিছুতেই বেশি বেশি নিয়ন্ত্রণ করেন। তার ইচ্ছামতো কিছুই করতে দেন না, নিজের ইচ্ছা শিশুর উপর চাপিয়ে দেন এবং শিশুর মতামতকে মূল্যায়ন করেন না। আবার অতিরিক্ত প্রশ্রয় দেয়াও শিশুর সুস্থ বিকাশের জন্য অন্তরায়। তাই এই দুটি অবস্থাই শিশুর জন্য মানসিক নির্যাতন।
খ) খুব বেশি মাত্রায় দাবী করা বা চাপ সৃষ্টি করা
নানাভাবেই শিশুর উপর বেশি দাবী করা বা চাপ সৃষ্টি করা হতে পারে। যেমনঃ ১- বাড়িতে অথবা কাজের জায়গায় বেশি কাজে বাধ্য করা। ২- কম বয়সে বিয়ে দেয়া। ৩- বৈষম্যমূলক মনোভাব প্রকাশ করা। ৪- প্রতিযোগিতামূলক খেলাধুলায় প্রথম হওয়ার জন্য চাপ দেয়া। ৫- বড়দের অতিরিক্ত কাজের দায়িত্ব ছোটদের উপর চাপিয়ে দেয়া। ৬- ছেলে ও মেয়ের মধ্যে পার্থক্য করা ইত্যাদি।
গ) পরোক্ষ বাঁধা
শিশুর সামগ্রিক বিকাশ বিভিন্ন পরোক্ষ কারণে বাঁধাপ্রাপ্ত হতে পারে। যেমন- মা-বাবার অনুপস্থিতি বা যত্নের অভাব (মা-বাবার মৃত্যু, শারীরিক অসুস্থতা বা কাজের জন্য), মা-বাবার পরিবর্তন অর্থাৎ নিজের মা-বাবার বধলে অন্য ব্যক্তিকে সেই আসনে বসানো (মা-বাবার ছাড়াছাড়ি বা আবার বিয়ে হওয়ার ফলে), বাড়ীতে যত্নকারীর ঘনঘন পরিবর্তন বা মা-বাবার ভাবমূর্তি শিশুর কাছে দূর্বল বা মলিন হওয়া এবং শিশুর প্রতি অবহেলাপূর্ণ মনোভাব ইত্যাদি।
ঘ) মারধর করা
শিশুদের থাপ্পর মারা, লাঠি দিয়ে মারা, কোনোকিছু পুড়ে মারা নানাভাবেই শারীরিক নির্যাতন করা হয়।
ঙ) বিভিন্ন ধরনের শারীরিক স্পর্শ
কামনাপ্রসূত বা যৌন আচরণ হিসেবে শিশুর শরীরের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে স্পর্শকাতর স্থানে স্পর্শ করা এসব আচরণ হলো যৌন নির্যাতন।
শিশু নির্যাতনের প্রভাব
শিশু নির্যাতনের প্রভাব অবশ্যই নেতিবাচক এবং এর প্রভাব হয় বহুমুখী ও সুদূরপ্রসারী। শিশু নির্যাতনের সাধারণ যেসব প্রভাব দেখা যায় তা হলো-
অমনোযোগী ও লেখাপড়ায় অকৃতকার্য হওয়া
ভয়ে ভয়ে থাকা, হঠাৎ ভেঙ্গে পড়া, নিরাপত্তার অভাব বোধ করা, হীনমন্যতায় ভোগা, অন্যের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হওয়া ইত্যাদি।
বাড়ী থেকে পালিয়ে যাওয়া, আত্মহত্যার চেষ্টা করা, আক্রমনাত্মক হয়ে ওঠা, নেশাগ্রস্থ হওয়া, মাদকাসক্ত হওয়া ইত্যাদি।
অপরাধপ্রবণ হওয়া, সমাজের পক্ষে ক্ষতিকারক আচরণ করা, মিথ্যা কথা বলা, চুরি করা ইত্যাদি।
মানসিক সমস্যার শারীরিক প্রতিফলন হওয়া। এতে বিভিন্ন রকম শারীরিক উপসর্গ দেখা দেয়। যেমন- মাথাব্যথা, মূর্চা যাওয়া, ঘুমের অসুবিধা, জ্বর হওয়া, হজমের গন্ডগোল, সারা শরীরে ব্যথা। চর্মরোগ, হাঁপানি ইত্যাদি।
যৌন ব্যাপারে অহেতুক কৌতুহল, বয়সানুপাতে একটু বেশি পরিণত মনোভাব, বাছবিচারহীন যৌন সম্ভোগ, যৌন অত্যাচার ইত্যাদি।
আবেগের ভারসাম্যহীনতা, খামখেয়ালীপনা, গোঁয়ার্তুমি, ক্রোধোন্মত্ততা, বিষাদ, নিজেকে গুটিয়ে নেয়া, কথায় কথায় কেঁদে ফেলা, বিদ্রোহী মনোভাব, বিশৃঙ্খল আচরণ ইত্যাদি।
শিশু নির্যাতনের প্রভাব কতটা তীব্র, মারাত্মক ও স্থায়ী হবে তা নির্ভর করে কতগুলো শর্তের উপর। সেগুলো হলো-
নির্যাতিত হওয়ার বয়স
যত কম বয়সে শিশুর ওপর নির্যাতন হবে তত এর ফলাফল মারাত্মক হবে। আবার বয়ঃসন্ধিকালেও কিশোর কিশোরীরা খুবই সংবেদনশীল থাকে তাই এই বয়সে নির্যাতনের প্রভাব খুব বেশি হয়।
নির্যাতনকারীর সঙ্গে শিশুর সম্পর্ক
নির্যাতনকারী যদি শিশুর খুব নিকটাত্নীয় হয় তাহলে ফলাফল বেশি ক্ষতিকারক হবে। সাধারণভাবে দেখা যায় শতকরা আশি (৮০%) ভাগ নির্যাতনকারী হয় শিশুর মা-বাবা ও পরিবারভুক্ত কেউ।
অভিজ্ঞতার সংখ্যা
একজন শিশুর প্রতি নির্যাতনের সংখ্যা যত বেশি হবে ফল তত খারাপ হবে।
সময়কাল
যত বেশি সময় ধরে শিশুকে নির্যাতন করা হবে শিশুর ক্ষতি তত বেশি হবে।
যন্ত্রণাভোগের তীব্রতা
শিশুর যন্ত্রণাবোধ যতটা তীব্র হবে ক্ষতির পরিমাণ ততটাই তীব্র হবে।
বুদ্ধির তারমত্য
কম বুদ্ধি সম্পন্ন এবং শারীরিক দিক থেকে অক্ষম শিশু বেশি ভঙ্গুর হয় এবং তাদের যন্ত্রণাবোধও তীব্র হয়।
স্বাতন্ত্র্যতা
শিশুদের মধ্যে অনেকেই অন্যদের চেয়ে বেশি সংবেদনশীল এবং ভঙ্গুর হয়।
সময়ের দূরত্ব বা ব্যবধান
সময় পার হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে কোনো উপসর্গের তীব্রতা ও নিদারুণ পীড়ন কিছুটা কমে আসে।
নির্যাতন ও শাস্তি
শাস্তি
শিশুদের সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য শাস্তি প্রদান করা আমাদের সমাজের একটি পুরানো ও প্রচলিত পদ্ধতি। নানা উদ্দেশ্যে শিশুকে শাস্তি দেয়া হয়ে থাকে। যেমন- নেতিবাচক আচরণকে দূর করা বা কমানো, সুন্দর ও সুস্থ আচরণ শেখানো, শিশুদের পরিবারের ও বিদ্যালয়ের নিয়ম কানুন শেখানো, শৃঙ্খলা শেখানো ইত্যাদি। অর্থাৎ শিশুদের শুধুই শাস্তি দেয়া হয় না বরং কিছু ইতিবাচক উদ্দেশ্যকে লক্ষ্য করেই শাস্তির নিয়মটি চালু হয়েছে। শিশুদের সাধারণত তিনভাবে শাস্তি দেয়া হয়।
মানসিক শাস্তি
শাস্তি স্বরূপ বকাঝকা করা, সমালোচনা করা, অন্য শিশুদের সাথে তুলনা করা, শিশুর নামে অন্যের কাছে বিচার দেয়া প্রভৃতি।
বঞ্চিত করা
শাস্তি স্বরূপ একবেলা বা কয়েকবেলা খাবার না দেয়া, কোনো ঘরে আটকে রাখা, কথা ভঙ্গ করা, বন্ধুদের সাথে মিশতে না দেয়া, পছন্দের খেলা খেলতে না দেয়া, পছন্দের গল্পের বই পড়তে না দেয়া, বেড়াতে নিয়ে না যাওয়া ইত্যাদি।
শারীরিক শাস্তি
শাস্তি স্বরূপ থাপ্পর মারা, লাঠি দিয়ে মারা, বেঁধে পেটানো, হাতে ভারী বস্তু (যেমন-ইট) রেখে এক পায়ে দাঁড় করিয়ে রাখা, কান ধরে উঠবস করানো প্রভৃতি।
প্রকৃতপক্ষে শাস্তি যেমনই হোক না কেন মানসিক কষ্টের বিষয়টি সব ধরনের শাস্তির বেলায়ই প্রযোজ্য। অর্থাৎ কোনো শিশুকে শারীরিক শাস্তি প্রদান করলে সে শরীরে ব্যথা পাওয়ার পাশাপাশি মানসিকভাবেও কষ্ট পায়। আবার শিশুকে একবেলা খাবার না দিলে ক্ষুধার কষ্টের সাথে সাথে মনের কষ্টেও ভোগে।
নির্যাতন
নানাভাবে শিশুদের নির্যাতন করা হয়। যেমন- শারীরিক নির্যাতন, মানসিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন প্রভৃতি। সাধারণ ভাবে বলা যায় নির্যাতনকারী কোনো ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে এ কাজটি করে না বরং নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য, রাগ/জেদ প্রকাশের জন্য এবং ভোগের তাড়না থেকেই শিশুদের নানাভাবে নির্যাতন করে।
কাজেই শিশু নির্যাতন ও শিশুকে শাস্তি প্রদান এই দুটির মধ্যে পার্থক্য বের করতে হলে সাধারণ ভাবে তিন ধরনের পার্থক্য দেখা যায়। যেমন-
শিশু নির্যাতনের ক্ষেত্রে কোনো ভালো উদ্দেশ্য থাকে না আর শাস্তি প্রদান করার ক্ষেত্রে শিশুর জন্য ভালো চিন্তা করা হয়।
শিশু নির্যাতনকারী নিজের হীন ইচ্ছা/আবেগ পূরণের বা প্রকাশের জন্য নির্যাতন করে। শাস্তি প্রদানকারীর নিজের কোনো নেতিবাচক উদ্দেশ্য থাকে না। বরং অনেক সময় শিশুকে শাস্তি দিয়ে মা-বাবা নিজেই কষ্ট পান।
শিশু নির্যাতনকারী শিশুকে কষ্ট দেয়ার সময় এর মাত্রা নিয়ে ভাবে না কিন্তু শাস্তি প্রদানকারী একটা সীমার মধ্যে থাকে এবং সাধারণত সীমা অতিক্রম করে না।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে শাস্তি ও নির্যাতনের প্রভাব বিচার করলে এই দুটির মধ্যে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য পার্থক্য দেখা যায় না। তাই শাস্তি ও নির্যাতনের নেতিবাচক প্রভাবকে বিবেচনা করে এই দুটির ক্ষতিকর দিক থেকে শিশুদের রক্ষা করতে হবে। আর শাস্তি যে উদ্দেশ্যে দেয়া হয় সে উদ্দেশ্য পূরণের জন্য আচরণ ব্যবস্থাপনা শিখতে হবে ও তা সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে হবে।
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।