আজকের শিশুই আগামীর ভবিষ্যৎ। তাই শিশুদের সুন্দর বিকাশ নিশ্চিতকরণ আমাদের সকলের অন্যতম প্রধান একটি কর্তব্য। আজকের আলোচ্য বিষয় আট থেকে এগারো বছর বয়সী শিশুদের যত্ন। শিশুদের জীবনের এই সময়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কেননা এই সময় তারা বয়ঃসন্ধি কালের দিকে যেতে থাকে এবং তাদের আত্মবিশ্বাস তৈরি হতে থাকে। এই বয়সটাতে শিশুর প্রতি বিশেষ যত্নবান হওয়া খুব জরুরি।
আট থেকে এগারো বছর বয়সী শিশুদের যা পারা উচিত:
√ নিজের সমস্ত প্রয়োজনীয় ও পছন্দনীয় কাজ করতে পারা। যেমন- দাঁত মাজা, গোসল করা, খাওয়া, পড়া, গান করা, নাচা, খেলা ইত্যাদি।
√ পছন্দসই যেকোনো কাজ নিজে নিজে করতে পারে। যেমন- গান গাওয়া, ছবি আঁকা, খেলা, বই পড়া ইত্যাদি।
√ দৈনন্দিন রুটিন কাজ স্বনির্ভরতার সাথে সঠিক ভাবে করতে পারে।
√ পারিবারিক সামাজিক রীতি-নীতি বুঝে এবং নিয়ম মাফিক চলতে পারে।
√ নিজের সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং নিজের সম্মান অনুযায়ী চলতে পারে।
√ ভালো-মন্দ বুঝতে পারে।
√ বেশি সময় ধরে কোনো কাজ সঠিক ভাবে করতে পারে।
√ ভালোভাবে বন্ধুত্ব বুঝে এবং বন্ধুত্ব বজায় রেখে চলতে পারে। বন্ধু ও সহপাঠীর পার্থক্য বুঝে। সাধারণতঃ ছেলেরা ছেলে ও মেয়েরা মেয়েদের সাথে বন্ধুত্ব করে।
√ এ বয়সী শিশুরা তাদের চাহিদা বুঝে এবং চাহিদা অনুযায়ী ইচ্ছা পূরণ করতে চায়।
√ তারা তার জিনিষ এবং অন্যের জিনিষের পার্থক্য বুঝে। কখন কোনটা দরকার এবং কোনটা কোথায় প্রযোজ্য তা ভালোভাবে বুঝে।
√ জটিল ও কুটিল চিন্তা করতে পারে, তবে সবসময় সব ব্যাপার পারে না।
√ তারা অন্যদের থেকে প্রশংসা পেতে পছন্দ করে এবং তা পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় কাজ ও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে।
√ তারা তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী চিন্তা করতে পারে ও সে অনুযায়ী চলতে পারে।
√ পরিবারের লোক ও অন্যদের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে এবং প্রত্যেকের চালচলন ও অভিব্যক্তি পার্থক্য করতে পারে।
√ নির্দিষ্ট লক্ষ্য ঠিক করতে পারে এবং তা পূরণের জন্য প্রতিটি পদক্ষেপ চিন্তা করতে পারে ও নিতে পারে।
√ ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিটি সম্পর্কের ক্ষেত্রে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত হয়।
√ কিছু কিছু ক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
√ একা একা কাজ করতে বা সমষ্ঠিগত ভাবে কাজ করতে পারে।
√ পরিচিত বা অপরিচতদের সাথে যে কোনো বিষয় নিয়ে গুছিয়ে কথা বলতে পারে।
√ প্রতিটি বিষয়ে অদম্য আগ্রহ থাকে এবং সে মোতাবেক জানতে চায় ও জানার উৎসগুলো খুঁজে বের করে।
√ শারীরিক গড়নের উপর নজর দিতে শুরু করে।
যে সব সংকেত লক্ষ্য রাখতে হবে:
√ ঝগড়া, অন্যদের সাথে না খেলে একা একা বসে থাকা বা হঠাৎ করে স্বাভাবিক কাজকর্মে, স্কুলের কাজে, ক্ষিধে ইত্যাদিতে উৎসাহ হারানো।
√ অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে হাঁটা, বড় বয়সেও বিছানায় প্রস্রাব-পায়খানা করা, মুখ দিয়ে সমসময় লালা পড়া, বয়স অনুযায়ী নিজের যত্ন নিজে নিতে পারা, অস্বাভাবিক আচরণ, হঠাৎ উত্তেজিত হওয়া, অতিরিক্ত চুপচাপ বা অতিরিক্ত চঞ্চল হওয়া, সমবয়সী কারো সঙ্গে মেলামেশা না করা, চোখে চোখ না রাখা, খিঁচুনি হওয়া, বাবা-মায়ের সাথে দূর্ব্যবহার, ঘরের জিনিসপত্র চুরি করা, বাইরে থেকে অন্যের জিনিষ চুরি করে নিয়ে আসা, টাকা পয়সার হিসাব রাখতে অপারগ হওয়া, নিজের শরীরের ক্ষতি করা (হাত কাটা, চুল ছেঁড়া, হাত কামড়ানো, মাথা পেটানো, আত্মহত্যার চেষ্টা), স্কুল পালানো, স্কুলে যেতে না চাওয়া, খুব বেশি মন খারাপ করে থাকা, কানে গায়েবি আওয়াজ শোনা, যে কোনো ধরনের অস্বাভাবিক আচরণ করলে বুঝতে হবে শিশুটি মানসিক সমস্যায় ভুগছে।
√ যদি কোনো শিশুর মানসিক বা আবেগজনিত সমস্যা থাকে, নির্যাতিত হয়ে থাকে, তাকে পরামর্শদান করাতে হবে যাতে ভবিষ্যতে আরও জটিলতা না হয়। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের মতামত নিন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক উপযুক্ত পরীক্ষা নিরীক্ষা করে নির্ণয় করতে পারবেন শিশুর বিকাশ বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে কিনা।
√ নিজের প্রতি আগ্রহ, আস্থা ও বিশ্বাস সঠিক ভাবে তৈরি না হলে তার জন্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সুব্যবস্থা নিতে হবে।
এ বয়সী শিশুর জন্য যা করণীয়:
√ বাচ্চাদের ক্রমাগত পরিবর্তন হয় এবং নতুন ক্ষমতা অর্জন করে। মা-বাবার উচিত ওদের পরিবর্তন লক্ষ্য করা এবং গতিবিধি অনুসরণ করে আরও দ্রুত বিকাশে সাহায্য করা।
√ তাকে তার মতো স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে আচরণ করতে দিন। যদি মনে করেন শিশুটি ভুল করছে, তবে তাকে আন্তরিক ভাবে বোঝান। কখনোই কড়া শাসন করবেন না।
√ বাচ্চার কথা শুনুন এবং বাচ্চার সঙ্গে প্রায়ই কথাবার্তা বলুন।
√ শিশুর প্রতিদিন ১৬০০ থেকে ২০০০ ক্যালরী খাদ্য দরকার, তাই শিশুর বিকাশের জন্য সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। প্রতিদিন বিভিন্ন ধরনের খাদ্যের সমন্বয়ে সুষম খাদ্য খাওয়ান।
√ শিশুর মস্তিষ্ক বিকাশের জন্য বাদাম (আখরোট, চীনাবাদাম, কাঠবাদাম), মধু, ডিম, ডাল, দুধ, মাছ (প্রধানত সামুদ্রিক মাছ), মাছের তেল, ফল ইত্যাদি খাদ্য অতি প্রয়োজনীয়।
√ শিশুর বিকাশের জন্য প্রতিদিন নিয়মিত সময়ে সুষম খাদ্য খাওয়াতে হবে। প্রতিদিনই খাবারের তালিকায় বৈচিত্র থাকতে হবে, যাতে শিশু একই ধরনের খাদ্যে বিরক্ত না হয়।
√ প্রতিদিনই খাদ্য তালিকায় দুধ, ডিম, বাদাম, ফলমূল ও শাক সবজি রাখতে হবে।
√ শিশুরা সমবয়সী শিশুদের সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করবে তা শেখান এবং ঘরের বাইরে অন্য শিশুর সঙ্গে খেলার সুযোগ দিন।
√ শিশুকে নিজে থেকে কিছু পছন্দ করা ও দায়িত্ব নেওয়ার সুযোগ করে দিন।
√ ভালো কাজের জন্য শিশুকে প্রশংসা, আদর ও পুরষ্কার দিন এবং মন্দ বা অনাকাঙ্ক্ষিত কাজের জন্য আদর, প্রশংসা ও পুরষ্কার বন্ধ রাখুন।
√ পারিবারিক ও সামাজিক রীতি-নীতি ও ভালো-মন্দ শেখান।
√ শিশুকে পারিবারিক কাজে উতসাহিত করুন, পর্যাপ্ত খেলাধুলা ও বিনোদনের ব্যবস্থা করুন।
√ অন্য শিশু এবং পরিবারের বাইরের লোকদের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ করে দিন।
√ শিশুরা বড়দের সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করবে (সালাম দেয়া, মেহমান এলে বসতে বলা ইত্যাদি) তা শেখান ও পালন করতে উৎসাহিত করুন।
√ শিশুর মানসিক বিকাশের জন্য যথাযথ সাহায্য করুন।
√ শিশুর পড়ালেখার জন্য নির্দিষ্ট জায়গা ও সময় ঠিক করে তাকে যথাযথ ভাবে লেখাপড়ার সুযোগ দিন।
√ পড়ালেখায় মনোযোগ দেয়ার জন্য তাকে সাহায্য করুন এবং প্রতিদিন পড়তে বসার জন্য উৎসাহিত করুন।
√ শিশুকে তার মস্তিষ্ক বিকাশের জন্য খেলাধূলায় যথেষ্ট সময় দিন। কম্পিউটারে খেলা, ভিডিও গেমস, টেলিভিশন দেখা সহ অন্যান্য অবসর সময়ের জন্য প্রতিদিন ১-২ ঘন্টা বরাদ্দ রাখুন। তবে বাইরের খেলাধূলা ও মাঠে খেলার জন্য উৎসাহ বেশি দিতে হবে যাতে তার মস্তিষ্কের বিকাশ ভালোভাবে হতে পারে। অবশ্যই শারীরিক পরিচর্যা ও ব্যায়াম এর মধ্যে থাকতে হবে। এবং এর জন্য আরো ১-২ ঘন্টা বরাদ্দ দেয়া যেতে পারে।
√ পড়ালেখায় দূর্বল শিশুকে বেশি করে পড়ার জন্য উৎসাহিত করতে হবে। বকাঝকা, মারধোর -এর সমাধান নয়। যত্ন, ধৈর্য্য ও সহযোগিতার সাথে তাকে পড়া বুঝাতে হবে। লেখাপড়ায় যাতে বিরক্ত না হয় সেদিকে খেয়াল রেখে তার মতো করে রুটিন মাফিক পড়াতে হবে।
√ শিশুর জ্ঞান ও চিন্তার পরিধি বাড়ানোর জন্য নির্দিষ্ট পড়ার বই ছাড়াও গল্পের বই, সাধারণ জ্ঞানের বই, গ্রামার বই, পাজেল, ক্রিয়েটিভ খেলা অথবা বই দিতে হবে।
√ সময়মতো শিশুকে যথেষ্ট ঘুমাতে দিন। এ বয়সী শিশুদের ৮-১০ ঘন্টা ঘুম যথেষ্ট।
√ এ বয়সী শিশুকে তার নিজস্ব চিন্তা ও সিদ্ধান্ত নিতে উৎসাহ প্রদান করতে হবে। শিশু যাতে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে সেজন্য তাকে সাহায্য করতে হবে। সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আলোচনা করে তাকে সাহায্য করতে হবে এবং কী করলে ভালো হবে তা আলোচনা করে তাকে সাহায্য করতে হবে এবং বুঝিয়ে দিতে হবে।
√ যে কোনো সমস্যা সমাধানের জন্য তাকে তার মতো বুঝিয়ে সাহায্য করতে হবে।
পারিবারিক, সামাজিক, পারিপার্শ্বিক কারণে অনেক শিশু মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। এছাড়া শরীর গঠনের সময় কোনো ধরনের বাধা পড়লে পরিণতিতে শিশু মানসিক রোগগ্রস্থ হতে পারে। সাধারণ ধারণার বশবর্তী হয়ে কোনো শিশুকে রোগী বা অসুস্থ হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে না। প্রয়োজনে একজন দক্ষ মনোরোগ চিকিৎসকের পরারর্শ নিন।
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।