মানুষের মনের জগৎ যেমন জটিল, তেমনি তার চিকিৎসাও এক গভীর মানবিক দায়িত্ব। কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. শাহেদুল ইসলাম সেই দায়িত্ব পালন করছেন নিষ্ঠা, দক্ষতা ও মানবিক বোধের সমন্বয়ে। চিকিৎসক ও শিক্ষক —এই দুই ভূমিকায় তিনি সমানভাবে সক্রিয়। মনের খবরের সহ-সম্পাদক আনিছুজ্জামান রুমি’র সঙ্গে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর পেশাগত অভিজ্ঞতা, চ্যালেঞ্জ, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবার বাস্তব চিত্র। সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে—চিকিৎসা সেবায় জনবল সংকট, কুসংস্কার ভাঙার প্রয়োজনীয়তা, শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা, এবং কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার রোল মডেল হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি।
মনের খবর: কেমন আছেন?
ডা. মো. শাহেদুল ইসলাম: ভালো আছি। কাজের ব্যস্ততার মধ্যেও ইতিবাচক থাকার চেষ্টা করি। রোগী, শিক্ষার্থী ও সহকর্মীদের সঙ্গে প্রতিদিনের যোগাযোগই আমাকে প্রাণবন্ত রাখে।
মনের খবর: বর্তমান সময়টা কেমন যাচ্ছে আপনার?
ডা. মো. শাহেদুল ইসলাম: সময়টা ভালোই যাচ্ছে। পেশাগত দায়িত্ব, শিক্ষকতা ও প্রশাসনিক কাজের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যসচেতনতা বাড়াতে বিভিন্ন কর্মসূচিতেও যুক্ত থাকার চেষ্টা করছি।
মনের খবর: এত ব্যস্ততার মাঝেও পরিবারকে কীভাবে সময় দেন?
ডা. মো. শাহেদুল ইসলাম: আসলে ইচ্ছা থাকলে সবই সম্ভব। সময় ব্যবস্থাপনা ও অগ্রাধিকার ঠিক রাখলে পরিবার ও পেশা দুটোই সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে চালানো যায়। আমি চেষ্টা করি পরিবারকে প্রতিদিন কিছুটা সময় দিতে, তাদের সঙ্গে মানসিকভাবে সংযুক্ত থাকতে।
মনের খবর: মানসিক রোগ চিকিৎসার পেশাকে বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত কীভাবে নিলেন?
ডা. মো. শাহেদুল ইসলাম: এই শাখাটি আমাকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছে, কারণ এখানে রোগীর মনের গভীরতা বোঝার সুযোগ আছে। মানসিক চিকিৎসক হিসেবে আমি জানি, সঠিকভাবে চিকিৎসা দিলে অপচিকিৎসার সম্ভাবনা কম থাকে এবং রোগীকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে কার্যকরভাবে কাজ করা যায়।
মনের খবর: আপনার দীর্ঘ অভিজ্ঞতার পথে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ও প্রাপ্তি কী?
ডা. মো. শাহেদুল ইসলাম: আমি এটিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখি না। বরং জাতীয় পর্যায়ে চিকিৎসা দিতে পারছি—এটাই আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। মানুষের আস্থা অর্জন করা এবং তাদের মানসিক কষ্ট লাঘবে ভূমিকা রাখতে পারা আমার জন্য পরম আনন্দের।
মনের খবর: কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মানসিক রোগ বিভাগের সেবা কাঠামো সম্পর্কে বলবেন?
ডা. মো. শাহেদুল ইসলাম: আমাদের বিভাগে প্রতিদিন বহিঃবিভাগ খোলা থাকে (শুক্রবার ও সরকারি ছুটি ছাড়া)। এছাড়া আন্তঃবিভাগীয় সেবা, শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা, জরুরি সেবা এবং প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন সবই নিয়মিতভাবে চলছে। আমরা রোগীদের সর্বোচ্চ মানসম্পন্ন সেবা দেওয়ার চেষ্টা করি। তাছাড়া আইসিইউ এর মাধ্যমেও চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হয়।
মনের খবর: মানসিক রোগ সম্পর্কে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে কতটা পরিবর্তন এসেছে বলে মনে করেন?
ডা. মো. শাহেদুল ইসলাম: খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি বললেই চলে। এখনও অনেকেই মানসিক রোগকে লজ্জার বিষয় মনে করেন। তবে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সচেতনতা কিছুটা বাড়ছে, যা আশার জায়গা।
মনের খবর: কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কী ধরনের মানসিক রোগের চিকিৎসা দেওয়া হয়?
ডা. মো. শাহেদুল ইসলাম: আমরা সব ধরনের মানসিক রোগীর চিকিৎসা করি—ডিপ্রেশন, এংজাইটি, স্কিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার ডিসঅর্ডার, আসক্তি, স্লিপ ডিসঅর্ডার, ডিমেনশিয়া, পার্সোনালটি ডিজঅর্ডার, টিক ডিজর্ডার, ডিলিউশনাল ডিজঅর্ডার, ইন্টেলেকচুয়াল ডিজেবিলিটি, ডেলিরিয়াম তাছাড়া মানসিক অন্যান্য সমস্যার রোগীদেরও এখানে চিকিৎসা দেয়া হয়।
মনের খবর: বর্তমানে কোন কোন আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি চালু রয়েছে?
ডা. মো. শাহেদুল ইসলাম: বর্তমানে প্রায় সব আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু রয়েছে, শুধুমাত্র ECT (Electroconvulsive Therapy) ছাড়া। ওষুধের পাশাপাশি কাউন্সেলিং, সাইকোথেরাপি এবং প্রয়োজনীয় মনোসামাজিক সহায়তা দেওয়া হয়।
মনের খবর: সরকারি পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা কী?
ডা. মো. শাহেদুল ইসলাম: সাধারণ মানুষ এখনও “উন্মাদ” ব্যক্তিকেই মানসিক রোগী বলে মনে করে। এই ধারণা খুব সীমিত এবং ক্ষতিকর। মানসিক সমস্যা অনেক সূক্ষ্ম—সেগুলোর প্রতিও গুরুত্ব দেওয়া জরুরি।
মনের খবর: সমাজে প্রচলিত ভুল ধারণা ও কুসংস্কার চিকিৎসা গ্রহণে কীভাবে বাধা তৈরি করছে?
ডা. মো. শাহেদুল ইসলাম: এ ক্ষেত্রে শুধু সাধারণ মানুষ নয়, নন-সাইকিয়াট্রিস্ট চিকিৎসকদেরও দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্যকে অন্যান্য শারীরিক রোগের মতো গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
মনের খবর: আপনি কীভাবে এই সামাজিক বাধাগুলো ভাঙতে কাজ করছেন?
ডা. মো. শাহেদুল ইসলাম: আমি নিয়মিত সচেতনতামূলক বক্তৃতা, ওয়ার্কশপ ও আলোচনায় অংশ নিই। ধীরে ধীরে মানুষের মনোভাব পরিবর্তন হচ্ছে—এই দিক থেকে কিছুটা সফল বলতে পারি।
মনের খবর: চিকিৎসা সেবায় জনবল বা অবকাঠামোগত সমস্যার মুখোমুখি হন কি?
ডা. মো. শাহেদুল ইসলাম: হ্যাঁ, অন্যতম সমস্যা হলো সময়মতো কর্মরত জনবলকে পাওয়া যায় না। দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল আরও বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
মনের খবর: কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় রোল মডেল করতে কী প্রয়োজন বলে মনে করেন?
ডা. মো. শাহেদুল ইসলাম: রোল মডেল করতে হলে এর জন্য প্রয়োজন সৎ ও সু-শৃঙ্খলা জনবল, এবং কার্যকর আন্তঃবিভাগীয় সহযোগিতা। আমরা সেই লক্ষ্যেই কাজ করছি। কিন্তু এখানে অনেক চিকিৎসকের মাঝে সময়নুবর্তিতার অভাব রয়েছে। যা প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসা সেবাকে ব্যাহত করে।
মনের খবর: আপনার তত্ত্বাবধানে গৃহীত কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ সম্পর্কে বলবেন?
ডা. মো. শাহেদুল ইসলাম: হাসপাতালে নতুন পদ সৃষ্টির উদ্যোগ নিয়েছি এবং তাতে আংশিক সফলতাও এসেছে। এটি আমাদের বিভাগের সক্ষমতা বাড়াবে।
মনের খবর: ভবিষ্যতে বিভাগের উন্নয়নের জন্য আপনার পরিকল্পনা কী?
ডা. মো. শাহেদুল ইসলাম: আমি চাই রোগীদের অপ্রয়োজনীয় ওষুধ নির্ভরতা কমে আসুক। অনেক সময় শারীরিকভাবে ও মানসিকভাবে সুস্থ মানুষও নানা কারণে ওষুধ গ্রহণ করে, যা অনাবশ্যক। আমরা চিকিৎসায় যুক্তিসংগত ও প্রমাণভিত্তিক ব্যবস্থাপনা জোরদার করতে চাই।
মনের খবর: মেডিকেল শিক্ষার্থীদের মানসিক রোগ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে কী করা যেতে পারে?
ডা. মো. শাহেদুল ইসলাম: বর্তমানে যে প্রশিক্ষণ ও পাঠ্যক্রম আছে, সেটি সঠিকভাবে অনুসরণ ও প্রয়োগ করা হলে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা আরও বাড়বে।
মনের খবর: মিডিয়া, পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা আপনি কীভাবে দেখেন?
ডা. মো. শাহেদুল ইসলাম: তাদের সঠিক তথ্য দেওয়া গেলে সমাজে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রথম পর্যায়ের সহায়তা দিতে পারে, আর মিডিয়া জনসচেতনতা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
মনের খবর: মনের খবরের পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন।
ডা. মো. শাহেদুল ইসলাম: আমি আশা করি মনের খবর মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে বাস্তব ও ইতিবাচক তথ্য প্রচার করবে, যাতে মানুষ আরও সচেতন হয় এবং মানসিক রোগ নিয়ে ভীতি বা লজ্জা না পায়।
মনের খবর: মনের খবরের কার্যক্রম সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
ডা. মো. শাহেদুল ইসলাম: মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে মনের খবর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তবে এই প্রচেষ্টা আরও কার্যকর করতে হলে সঠিক তথ্যভিত্তিক প্রচার ও গবেষণাধর্মী উদ্যোগ বাড়াতে হবে।
“বাংলাদেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধানদের সঙ্গে আমরা ধারাবাহিকভাবে বিশেষ সাক্ষাৎকার নিচ্ছি। সেই ধারারই অংশ আজকের এই আলাপচারিতা।”
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনেরখবর-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য মনেরখবর কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।
আরও দেখুন-