অধ্যাপক ডা. মো. সালেমির হোসেন চৌধুরী পাবনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সাবেক সিনিয়র কনসালটেন্ট। সমাজে নৈতিকতার অবক্ষয় নিয়ে এই মনোরোগবিদ কথা বলেছেন মনের খবরের সঙ্গে।
মনের খবর : প্রতিনিয়তই আমাদের সমাজে নৈতিকতার অবক্ষয় হচ্ছে। ফলে সমাজে রাহাজানি ও নৈরাজ্যের মতো অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। তো এসব পরিস্থিতি আমাদের সমাজের সাধারণ মানুষের ওপর কি ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে?
ডা. মো. সালেমির হোসেন চৌধুরী : আসলে নৈতিকতা বলতে আমরা কি বুঝি? নৈতিকতা বা morality যার অর্থ হলো চরিত্র বা উত্তম আচরণ। এটি মূলত সিদ্ধান্ত এবং কর্মের মধ্যকার ভালো-খারাপ, উচিত-অনুচিত এর পার্থক্যকারী। নৈতিকতার একটি আদর্শ উদাহরণ হলো: “আমাদের উচিত অন্যের সাথে সেভাবেই আচরণ করা যেমনটা আমরা নিজেরা অন্যের থেকে আশা করব।” অপরদিকে, অনৈতিকতা হলো নৈতিকতারই সম্পূর্ণ বিপরীত। যা অসচেতনতা, অবিশ্বাস, উদাসীনতারই বহিঃপ্রকাশ। যা পারস্পরিক মানসিক দ্বন্দ্বের কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়। নৈতিকতার অবক্ষয় হচ্ছে সামাজিক মূল্যবোধ না থাকা বা বিলুপ্তি ঘটা। নৈতিক অবক্ষয়ের পেছনে একজন মানুষের মানসিক অবস্থার ভূমিকা অনেক। সে কোন ধরনের পরিবারে বসবাস করে, পরিবারের সকলের সাথে এবং প্রতিবেশিদের সাথে তার সম্পর্ক কেমন, পরিবারের বাইরে সে কাদের সাথে এবং কেমন সম্পর্ক বজায় রেখে চলে তার উপরে নৈতিক আচরণ নির্ভর করে। সে যদি পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যের সাথে অসদাচরণ করে এবং বাইরের দুষ্ট বন্ধু-বান্ধবদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলে তবে তার সুষ্ঠু মানসিক অবস্থার আস্তে আস্তে অবনতি ঘটে। ফলে পরিবার তথা সমাজের মধ্যে একটা অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়, যা সুশীল সমাজের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। আর এর খারাপ প্রভাব নৈতিক ও ভালো চরিত্রের ছেলেমেয়েদেরকেও নষ্ট করে দেয়।
মনের খবর : আপনার সময়ে সমাজ ব্যবস্থাটাকে আপনি যেভাবে দেখেছেন তখন থেকে এখন পর্যন্ত সমাজ ব্যবস্থার যে বিবর্তন সেটাকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
ডা. মো. সালেমির হোসেন চৌধুরী : নৈতিক অবস্থার অবক্ষয়ের জন্য সমাজে এখন চুরি, ছিনতাই, মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার, কিশোর অপরাধ ইত্যাদি নৈরাজ্য তৈরি হয়েছে, যা পরবর্তীতে মারামারি, খুন, গুমের মতো পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। আর এ সমস্ত সামাজিক নৈরাজ্য অবস্থার কারণে ব্যাপক নিরাপত্তাহীনতার শঙ্কা তৈরি হয়। যার কারণে সমাজের সাধারণ ও নিরীহ লোকেরা মানসিকভাবে অনেক সময় শারীরিকভাবেও নির্যাতিত হয়। পরে তাদের মধ্যে হতাশা ও ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয় বিধায় তারা তাদের স্বাভাবিক কাজকর্ম সুষ্ঠুভাবে চালিয়ে যেতে পারে না, যেমন- ছাত্রছাত্রীদের সঠিকভাবে তাদের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে না পারা, চাকরিজীবীরা মনোযোগ দিয়ে তাদের কাজ করতে না পারা এবং ব্যবসায়ীরা শান্তিপূর্ণভাবে তাদের ব্যবসা চালিয়ে যেতে না পারা। ফলশ্রুতিতে সমাজে সার্বিকভাবে একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতি বিরাজ করে।
মনের খবর : সমাজে এ অবস্থার পরিবর্তনের জন্য মনোরোগবিদ হিসেবে আপনাদের ভূমিকা কি?
ডা. মো. সালেমির হোসেন চৌধুরী : প্রতিটি মানুষ তার স্বাভাবিক কাজকর্ম চালিয়ে যাওয়ার জন্য মানসিক নিরাপত্তা ও পারস্পারিক সহযোগিতা বিশেষভাবে প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি। নিরাপত্তাহীনতার কারণে মানুষ তার নৈতিকতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে পরিবার ও সমাজে সুষ্ঠুভাবে কাজকর্ম চালিয়ে যেতে পারেনা। এতে করে তাদের বিভিন্ন ধরনের মানসিক অবক্ষয় ঘটে, যেমন-অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার- একটি মানসিক রোগের নাম। যা হতাশা এবং কাজকর্মে অনীহা তৈরি করে।ফলে অনেক সময় কর্মহীনতা এবং আর্থিক টানাপোড়েন অবস্থার সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রে মনোরোগবিদদের ভূমিকা কি হতে পারে? এক্ষেত্রে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ব্যক্তিদের জন্য মনোরোগবিদদের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। তারা বিভিন্নভাবে যেমন- সংবাদপত্র, রেডিও, টিভি এবং অনলাইন প্রজেক্টের মাধ্যমে তাদের মানসিক অবস্থার উন্নতি ঘটাতে সহযোগিতা করতে পারেন। এছাড়াও মানসিকভাবে আক্রান্ত রোগীদের মনোরোগবিদদের কাছে গিয়ে ওষুধ এবং সেই সাথে কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে চিকিৎসা নিয়ে মানসিক অবস্থার পরিবর্তনের জন্য সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারেন। সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা ও নৈতিকতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পরিবারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ ও আঞ্চলিক গণ্যমান্য ব্যক্তিদেরকে নিয়ে মনোরোগবিদরা কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে তাদের সন্তানদের মানসিকতা ও নৈতিকতার উন্নয়নে নির্দেশনা দিতে পারেন। সর্বোপরি, সামাজিক নিরাপত্তা বৃদ্ধির লক্ষ্যে স্থানীয় প্রশাসন ও সমাজকর্মীদের নিয়ে মনোরোগবিদগণ বিভিন্নভাবে বিভিন্ন তথ্য দিয়ে অবগত করবেন এবং বিশেষ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য নির্দেশনা প্রদান করবেন।