ডা. পঞ্চানন আচার্য্যঃ রূপা-আসলেই রূপা। অষ্টম শ্রেণিতে পড়া একজন প্রাণোচ্ছল কিশোরী। যেমন রূপবতী, তেমনি গুণবতী। ক্লাসে প্রথম, বিতর্কে সেরা, গান ও নাচে পারদর্শী। দুপাশের গজদন্তের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসা হাসিটুকু দেখলেই প্রাণ ভরে যায়। এতকিছু সত্ত্বেও আচরণে ভদ্র, বিনয়ী এবং সহজ-সরল। তাই ক্লাসের বান্ধবীরা খুব ভালোবাসে তাকে। সেইসঙ্গে, তার শিক্ষক, পাড়া- প্রতিবেশী বা আত্মীয়-স্বজন সবার কাছেই একজন আদর্শ কিশোরীর উদাহরণ সে। নিজেকে নিয়ে রূপা অনেক স্বপ্ন দেখে- একজন চিকিৎসক হবার, মানুষের মতো মানুষ হবার, আনন্দে জীবন ভরিয়ে রাখার। সেভাবেই তার এগিয়ে চলা প্রতিদিন।
সেই এগিয়ে চলা একদিন ধাক্কা খেল প্রচণ্ড। রূপাকে এক বখাটে রাস্তায় প্রায়ই উত্যক্ত করত। লেখাপড়ার ধারেকাছে না থাকলেও ছেলে এবং স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের প্রিয়ভাজন হওয়ার যোগ্যতায় সে রূপাকে বিরক্ত করত। হঠাৎ একদিন সবার সামনে রাস্তায় রূপার পথরোধ করে, ওড়না টেনে নেয় এবং চুমু খেতে চায়। রূপা তাকে চড় মারে। প্রথমে হতচকিয়ে গেলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই রূপার চুল ধরে মাটিতে ফেলে দেয় এবং কিল-চড় ঘুষি মারতে থাকে। স্কুলের যাওয়ার সময় হওয়াতে দশম শ্রেণি পড়ুয়া রূপার ভাই রূপক তখন ঐ পথ দিয়ে যাচ্ছিল। সে প্রতিবাদ করে। শুরু হয় ওদের মধ্যে মারামারি। বখাটেদের কয়েকজন মিলে তাকে মারতে থাকে। রূপার চিৎকার সত্ত্বেও আশেপাশের একজন লোকও সহায়তার জন্য এগিয়ে আসে না। হঠাৎই রূপকের ক্লাসের বন্ধুদের কয়েকজন লাঠিসোটা নিয়ে এগিয়ে আসে। মার খেয়ে, ভয় পেয়ে বখাটেগুলো পালায়। মামলা হয়। একজন ধরা পড়ে, বাকিরা পলাতক। এরপর কেটে যায় প্রায় ছয় মাস। সেদিনের পর থেকেই বারবার অনিচ্ছাকৃতভাবে রূপার মনের গহীনে চলে আসে সেই দিনের ঘটনাগুলো। যেন সিনেমার মতো মানসপটে ভেসে ওঠে সেদিনের দৃশ্যগুলো। ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখে আঁতকে উঠে, চিৎকার করে জেগে যায় রূপা। কখনো মনে পড়ে, কখনো মনে পড়ে না স্বপ্নের দৃশ্যগুলো। তবে নিশ্চিত যে, ভয়ঙ্কর কিছু স্বপ্নে ফিরে ফিরে আসে বারবার। ঐ স্কুলের রাস্তা দিয়ে যেতে গেলেই সেইদিনের অনুভূতিগুলো ফিরে আসে যেন। টিভিতে রোমান্টিক নাটক বা সিনেমাতেও ওড়না টানার দৃশ্য বা বখাটে উত্যক্ত করার দৃশ্য দেখলে মনের ভেতরে ভয়ঙ্কর অস্থিরতা, যন্ত্রণা অনুভব করে। ভুলে থাকার জন্য সে আর টিভি দেখে না, উপন্যাস পড়ে না, স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। পুলিশ তদন্তে এসে বারবার জিজ্ঞেস করেও রূপার কাছ থেকে মাঝে মাঝে ফাঁকা উত্তর পায়। তারা বোঝে না যে, সেদিনের আগে পরের অনেক কথাই আর মনে করতে পারছে না সে। যখনই সে ভাবতে বসে, সবকিছু মিলিয়ে তার কেবলই মনে হতে থাকে-এসব কিছুর জন্য আসলে সে নিজেই দায়ী। এই জগটা একটা ভয়ঙ্কর জায়গা। আশেপাশের মানুষের কাউকেই আর ভরসা করতে পারছে না। সারাক্ষণ ভয় আর লজ্জাবোধ তাকে ঘিরে রাখে। ভয় হয়, আবার এমন কিছু যদি ঘটে যায়। অনেক সময় ঘটবেই- এই ভাবনা অন্ধবিশ্বাসের মতো যেন চেপে বসে। আর লজ্জা হয় কে কীভাবে নিয়েছে, সবাই তাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে আড়ালে, তার বর্ণনাম ছড়িয়ে গেছে সারা সমাজে। কীভাবে মুখ দেখাবে সে?
রূপা আজ আর সেই রূপা নেই। সদালাপী, হাসিখুশি রূপা এখন খিটখিটে, অল্পতেই রেগে যায়, সহজেই চমকে ওঠে, কোনো কাজে মনোযোগ দিতে পারে না। ঘুম না হওয়ায় চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। এখন সে আর কারো সঙ্গে মেশে না, নিজেকে সবসময় আলাদা করে রাখে, একা থাকে, কোনো কাজেকর্মে বিশেষত পড়ালেখা বা স্কুলে যাওয়াতে একেবারেই অনীহা। তার জগষ্টা শুধুই সাদা-কালো, তাতে কোনো রঙ নেই যেন, নেই হাসি-আনন্দ-উচ্ছলতা। অবশেষে ছয় মাস পর রূপাকে নিয়ে তার মা ও এক আন্টি হাজির হন একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে। দেখেশুনে তিনি বললেন, ‘রূপা পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারে ভুগছে। এর পেছনের কারণ, অবশ্যই সেদিনের ঘটনা; তবে একইসঙ্গে রূপার মানসিক চাপ মোকাবেলার ক্ষেত্রেও কিছুটা সমস্যা আছে’।
রূপার মা আহাজারি করে বলেন, ‘হায় আল্লাহ। আমার মেয়ের কপালেই কেন এমন একটা রোগ লিখে দিলে। ডাক্তার তাঁকে বোঝান এই বলে যে, এটা যে শুধু আপনার মেয়ের ক্ষেত্রেই ঘটেছে এমন নয়। এটা অনেকেরই হতে পারে। যেমন গবেষণায় বলে থাকে, সাধারণ মানুষদের মধ্যে এটা হবার সম্ভাবনা শতকরা ৮ ভাগ। আর এটা যে শুধু ঘটনার শিকার হলেই হবে তা- ও নয়। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদেরও এটা হতে পারে। যেমন ধরুন সাংবাদিকদের, উদ্ধারকর্মীদের। আবার এটা বাচ্চাদেরও হতে পারে। ইরাক যুদ্ধের কথা মনে আছে? ঐ সময় প্রায় ৭ লাখ যুদ্ধফেরত আমেরিকান যোদ্ধার মধ্যে প্রায় ১ লাখের ক্ষেত্রেই বিরক্তভাব, দুর্বলতা, নিশ্বাসের সমস্যা, বিভিন্ন স্থানে ব্যথা, মাথাব্যথাসহ আরো অনেক উপসর্গ দেখা দেয়। এটাকে বলা হয় গালফ ওয়ার সিনড্রোম। পরবর্তীতে এদের মধ্যে কয়েক হাজার যোদ্ধার এই পিটিএসডি রোগ নির্ণীত হয়। এরকমই আরেকটা উদাহরণ হচ্ছে, নয় এগারোর ঘটনাটা।’ রূপার মা জিজ্ঞেস করেন, ঔষধ কি খাওয়ানোই
ডাক্তার বুঝিয়ে বলেন, ‘যদি চিকিৎসা না করা হয়, তবে সারাজীবন ধরে আক্রান্তদের ৪০%-এর অল্প ২০% এর মাঝারি সমস্যা থেকেই যায় এবং ১০% দিনে দিনে খারাপ হতে থাকে। তবে খেয়াল করলে দেখবেন, এখানে কিন্তু ৩০% আরো লোক আছে, যারা চিকিৎসা ছাড়াই ভালো হয়ে যায়। চিকিৎসা করালে দেখা যায়, এক বছরের মধ্যেই ৫০% রোগী ভালো হয়ে যায়। আবার, এই ভালো হওয়ার পেছনে বিভিন্ন কারণ আছে। যেমন, যদি খুব হঠাৎ করে হয়, হয় মাসের কম সময় ধরে থাকে, রোগে আক্রান্ত হবার আগে কাজেকর্মে পারফরম্যান্স বেশ ভালো থাকে। সামাজিক সহায়তা এক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। রূপার মা বলেন, ‘তাহলে ওষুধ খেলে ভালো হয়ে যাবে। আশা রাখি।’
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জোর দিয়ে বলেন, ‘ ঔষধ তো লাগবেই, সাথে সাইকোথেরাপিও লাগবে। দুইটাই সমান গুরুত্বপূর্ণ। ইএমডিআর (EMDR) নামে একটা থেরাপি আছে যেটা অনেক সময় বেশ
এমন সময় রূপার সাথে আসা আন্টি রূপাকে বলে। বসে, ‘এরকম অঘটন কত মানুষের জীবনেই তো ঘটে। এর চেয়ে আরো খারাপ কিছুও তো ঘটতে পারত। আল্লাহ না করুক, যদি তুলে নিয়ে যেত, খারাপ কিছু করত। তাহলে? এখন এসব না ভেবে, মনকে শক্ত কর। মনের জোর বাড়াতে হবে। কী বলেন ডাক্তার সাহেব?”
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ রূপার আন্টিকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “নিজে থেকে চেষ্টা অবশ্যই করতে হবে। তবে আপনি যেভাবে বললেন ঐভাবে আসলে হয় না। ভাঙা পা নিয়ে কেউ দৌড়াতে পারে না। দৌড়ানোর চেষ্টা করাই উচিত না। তাতে পায়ের ক্ষতি হতে পারে। একইভাবে, পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারসহ যেকোনো মানসিক রোগেই অনেক গবেষণার ভিত্তিতে ঠিক করা বা সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা-পদ্ধতিতেই আগাতে হবে।
ডাক্তার দেখানো শেষে রূপা ফিরে চলে তার মা আর আন্টির সাথে। নতুন করে আবার সব শুরু করবে বলে।
-ডা. পঞ্চানন আচার্য্য মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, মানসিক রোগ বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।
লেখাটি মনের খবরের মাসিক প্রিন্ট ম্যাগাজিনের ১৫ তম সংখ্যায় প্রকাশ হয়েছিল। লেখকের অনুমতিতে পুনঃপ্রকাশ হল। এবং লেখার ভাবনা একান্তই লেখকের নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতিমালার সাথে এর কোন বিরোধ নেই।