দার্শনিক অ্যারিস্টটলের মতে, ‘মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই রাজনীতি প্রিয় প্রাণী’। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। মহল্লার চায়ের দোকান থেকে শুরু করে কর্পোরেট অফিস সব জায়গায় রাজনীতি বিষয়ক আলোচনা চলে সবসময়। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে বর্তমান বাংলাদেশে রাজনীতির আলোচনা শুরুই হয় নেতিবাচকভাবে। আর শেষ হয় রাজনীতির এই প্রহসন থেকে কীভাবে মুক্তি পাওয়া সম্ভব বা কীভাবে এর থেকে দূরে থাকা যায়?
অথচ নির্বাচন মানেই ছিল উৎসবমুখর এক পরিবেশ। রাজনীতিবিদ এবং ভোটার দুই পক্ষের জন্যই আনন্দের মুহূর্ত। বর্তমানে সেই চিত্র বদলে গেছে। ক্ষমতার লোভ এবং প্রতিহিংসার রাজনীতি এমন ধারার মধ্যে প্রবেশ করে রাজনীতিবিদদের মানসিক অবস্থা যেন পরিবর্তন হয়েছে ব্যাপকহারে। এর ফলে রাজনীতিবিদদের নির্বাচনী প্রচারণা এবং উত্তেজনা জনগণকে যতটা না আকৃষ্ট করেছে তার চেয়েও বেশি ভীতি এবং বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।
এমনকি রাজনীতিবিদ ও নির্বাচনের কারণেই বর্তমানে মানুষ অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। অপরাধী হিসেবে কেউই জন্মগ্রহণ করে না। কিন্তু পারিপার্শ্বিক অবস্থা, সঙ্গদোষ, মাদক, অর্থনৈতিক ও ক্ষমতার লোভ অপরাধী হিসেবে সামনে নিয়ে আসে তাদের। আর রাজনীতিবিদরা সেসব লোভ দেখিয়ে নির্বাচনের কাজে ব্যবহার করে নিচ্ছে তাদের কর্মীদের। বর্তমানে কিশোরদের এক বিশাল অংশকে দেখা যাচ্ছে অপরাধী হিসেবে। যারা কেবলই রাজনীতিবিদদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই কিশোরদের বয়সের উত্তেজনাকে কাজে লাগিয়ে রাজনীতিবিদরা নিজেদের কাজ হাসিল করে নিচ্ছে।
প্রধানত, বয়ঃসন্ধিকাল পেরিয়ে যাওয়া কিশোররা সমাজের নিয়ম শৃঙ্খলা ভেঙ্গে চলতে চায়। কিন্তু তাদের আরো বেশি করে নিয়মের মধ্যে আটকে রাখতে চায় এই সমাজ। উপদেশ, আইন, নীতিবাক্য, শাস্তি দিয়ে আটকে রাখতে চায় তাদের। আর সেই নিয়ম-শৃঙ্খলা থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে সামনে এগিয়ে আসে ক্ষমতালোভী রাজনীতিবিদরা। বর্তমানে ১৩-১৭ বছর বয়সী কিশোরদের মাদক এবং ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে নিজেদের পক্ষে কাজ করিয়ে নিচ্ছে রাজনীতিবিদরা। কিশোরদের অবারিত মাদক দিয়ে নিজেদের দলে টেনে নিচ্ছে রাজনীতিবিদরা। প্রয়োজনে অল্প বয়সে অস্ত্রও হাতে তুলে দেওয়া হয় তাদের। এতে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে কিশোররা জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন অপরাধে। এছাড়াও অর্থনৈতিক ও অবৈধ সুযোগ-সুবিধার লোভ দেখিয়েও কিশোরদের নিজেদের কাজে লাগাচ্ছে রাজনীতিবিদরা।
বাংলাদেশে নির্বাচন মানেই ছিল উৎসবের আমেজ। কিন্তু সময়ের পালাক্রমে ক্ষমতার লোভ এবং প্রতিহিংসার রাজনীতি সেই চিত্রেরই পরিবর্তন করছে। বর্তমানে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য রাজনীতিবিদরা নিজেদের সুযোগের সর্বোচ্চ ব্যবহার করছে। প্রয়োজনে প্রশাসনের সহায়তায় প্রতিপক্ষকে দমন পীড়নের মতো কাজও করছে। স্বাভাবিক গণতন্ত্রের চর্চা থেকে বের হয়ে রাজনীতিবিদদের কাছে ক্ষমতাই প্রধান হয়ে উঠেছে। প্রয়োজনে বর্ণ-বৈষম্য, সাম্প্রদায়িক বৈষম্যের মতো বিরোধ ঘটাতেও ভাবছেন না রাজনীতিবিদরা।
প্রধানত, ক্ষমতায় থাকার মাধ্যমে অল্প সময়ে বিপুল অর্থ আয় এবং বৈধ-অবৈধ সুযোগ খুব সহজলভ্য হয়ে যাওয়াতে এমন প্রবণতা বেড়ে গেছে তাদের মাঝে। আর তাই ক্ষমতায় থাকার জন্য প্রতিপক্ষের মাঝে ভয়ের রাজনীতিও ছড়িয়ে দিতেও ভাবছে না তারা। এমনকি প্রতিপক্ষকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়ারও প্রবণতা দেখা যায়। অবস্থা এমন হয়ে যাচ্ছে যে, বর্তমানে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত প্রতিনিধির সংখ্যা বাড়ছে প্রতিনিয়ত। মূলত ক্ষমতার লোভে নিজেদের মনুষ্যত্ব বিকিয়ে দিতেও যেন ভাবছেন না সেই রাজনীতিবিদ এবং তাদের রাজনৈতিক কর্মীরা।
বর্তমানে প্রতিপক্ষকে ধ্বসিয়ে দিতে ধর্ষণ, খুন কিংবা দমন-পীড়নের মতো ঘটনা সামনে নিয়ে আসেন রাজনীতিবিদরা। আর এসব অপরাধের পেছনে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, মানুষের জৈবিক, মনস্তাত্ত্বিক, অর্থনৈতিক, সমাজতাত্ত্বিক এসব দৃষ্টিভঙ্গি বদলালেই কেবল এমন অপরাধে যুক্ত হওয়া সম্ভব। এছাড়াও ঈর্ষাপরায়ণতা, হীনমন্যতা, হতাশা, স্বার্থ এবং আদর্শগত দ্বন্দ্ব বড় হয়ে কাজ করে। আর রাজনীতির ক্ষেত্রে এসবই বড় হয়ে সামনে আসে। এছাড়াও প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারা, কাজকর্মে সফলতা না আসা, চাকরিতে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বেকার থাকা এসবের কারণে হতাশা বাড়ছে অনেকের। আর সেই সুযোগটাই কাজে লাগাচ্ছে রাজনীতিবিদরা। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অব্যবহতি নির্বাচনের পর দেশজুড়ে যে সহিংসতা হয়েছিল, তার বড় অংশ ছিলো সেই বেকার যুবকরা।
অতীতে নির্বাচন যতটা আনন্দের স্মৃতি হয়ে ছিল, সেটিই বর্তমানে পানসে হয়ে উঠেছে জনগণের কাছে। বর্তমানে গণতন্ত্র নামে বেঁচে থাকলেও অপ্রিয় সত্য হচ্ছে, ভোটাররা নিজেদের ভোট দিতেই যেন ভুলে গেছে। এমনকি ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করছে না ভোটাররা। এছাড়াও নির্বাচনী প্রচারণার কালে প্রায়শই বিভিন্ন জায়গায় অতর্কিত আক্রমণের ঘটনা ঘটছে। এইসব আক্রমণের শিকার হচ্ছেন সাধারণ জনগণই। ফলে রাজনৈতিক প্রচারণা উপভোগের পরিবর্তে ভীতির সঞ্চার ঘটছে তাদের মাঝে। এছাড়াও মাঝে মাঝে নির্বাচনী প্রচারণা এতটাই মাত্রা ছাড়ায় যে, জনগণের স্বাভাবিক জীবনেও ব্যাহত ঘটাচ্ছে।
বর্তমানে তাই নির্বাচনকেন্দ্রিক সংবাদের শিরোনামেও পরিবর্তন এসেছে। রাজনীতি নিয়ে এখন বেশিরভাগই নেতিবাচক সংবাদ সামনে আসছে। যেখানে রাজনীতির কারণে খুনোখুনি, মারামারিই প্রধান সংবাদ হয়ে আসছে। এমনকি ভোটারহীন কেন্দ্রতে পরিপূর্ণ ব্যালট পাওয়ার ঘটনাও ঘটছে। এমনকি ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে গিয়েই শুনতে পারছে তাদের ভোট দেওয়া হয়ে গেছে। আর এই সংবাদ্গুলোই ব্যক্তিবিশেষে চরম মানসিক অশান্তিরও সৃষ্টি করছে তাদের মাঝে। এক্ষেত্রে তাদের কাঙ্খিত জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হলেও তাকে সাদরে মেনে নেওয়া সম্ভব হয়ে উঠছে না তাদের জন্য। হতাশার সময় কাটাতে হচ্ছে সাধারণ জনগণকে।
এজন্যই লেখক-সাংবাদিক নঈম নিজাম লিখেছেন, “রাজনীতিবিদরা কি মানুষের ভাষা বোঝেন?” এই প্রশ্নটাই অবধারিত হয়ে থাকছে বর্তমানে, ভবিষ্যতের জন্যও হয়ত।
লিখেছেনঃ কামরুল ইসলাম ইমন
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে