মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের কাছে প্রায়শই কিছু রোগী আসেন একগাদা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎশাস্ত্রের ফাইল নিয়ে। এ ধরনের রোগীদের একটা বড়ো অংশই মানসিক রোগ ‘প্যানিক ডিজঅর্ডারে’ আক্রান্ত যা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মানসিক রোগগুলোর মধ্যে একটি। এর লক্ষণগুলো খুব ভীতিকর ও কষ্টদায়ক, যার ফলে রোগী খুব সহজেই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পরেন। বুক ধড়ফড় করা কিংবা বুক চেপে আসার মতো কষ্টদায়ক কিছু লক্ষণ রোগীকে শুরুতেই হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়ার কথাই মনে করিয়ে দেয়। তবে এই টেস্ট সেই টেস্ট করেও যখন রোগের কুলকিনারা হয় না তখন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞই একমাত্র ভরসা।
প্যানিক ডিজঅর্ডারে মূলত বারবার প্যানিক এট্যাক হয় যা রোগীর মধ্যে ভীতির সঞ্চার করে। এই এট্যাক কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ করেই হতে পারে এবং এতটাই যন্ত্রণার যে একবার এট্যাক হলে পরবর্তী এট্যাক আবার কবে হবে এ নিয়ে রোগীর মধ্যে ভয় থেকে যায় যা রোগীর আচরণেও পরিবর্তন নিয়ে আসে।
প্যানিক এট্যাকে রোগীর মধ্যে শারীরিক ও মানসিক বেশকিছু লক্ষণ দেখা যায়। যেমন খুব কমন একটি সমস্যা হচ্ছে বুক ধড়ফড় করা বা হৃদস্পন্দনের গতি বেড়ে যাওয়া বা অনেক সময় হৃদযন্ত্র লাফাচ্ছে বলে মনে হওয়া। এছাড়া অন্যান্য লক্ষণগুলোর মধ্যে শরীর হাত-পা কাপতে থাকা, শরীর ঘামতে থাকা, বুকে ব্যাথা অনুভব করা, শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া এবং রোগী মনে করে গলাটা চেপে আসছে। রোগীর পেটে অস্বস্তি হতে পারে কিংবা বমিবমি লাগতে পারে, শরীরে গরম অনুভব হয় এমনকি শরীর অনুভূতিহীন মনে হতে পারে। স্থির হয়ে দাড়িয়ে থাকা কষ্ট হয়ে পরে, শরীর টলতে থাকে, নিজেকেই নিজের অচেনা মনে হয় কিংবা আশেপাশের সবকিছু অবাস্তব মনে হতে থাকে, সবকিছু হতে যেন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছি এমনকি বোধ হয় আমি হয়ত মারা যাচ্ছি।
সতরাং লক্ষণগুলো হতে রোগীর মধ্যে মৃত্যুভীতি তৈরি হয় যা রোগীকে খুব সহজেই আতঙ্কগ্রস্ত করে তোলে। এই প্যানিক এট্যাক খুব অল্প সময় থাকে কিন্তু এই অল্প সময়ে রোগীর অবস্থা খারাপ করে ফেলে। প্যানিক ডিজঅর্ডার খারাপ বা ভয়ানক কোনো কারণে শুরু হবে এমনটি নয় বরং কোনো কারণ ছাড়াই শুরু হয় এবং এই রোগে দুশ্চিন্তার মাত্রা অন্যান্য যেকোনো কারণে দুশ্চিন্তার তুলনায় অনেক গুণ বেশি। এ এট্যাক যে কোনো স্থানে বা সময়ে কোনো কিছ বুঝে উঠার আগেই শুরু হতে পারে। তবে যেসব স্থানে রোগীর এই অ্যাটাকটি হয়েছিল রোগী সেসব স্থান পরবর্তীতে এড়িয়ে চলা শুরু করে এবং রোগীর ধারণা হয় যে সেসব স্থানে গেলেই বোধহয় তার আবার এ অ্যাটাকটি হবে।
এই রোগের সূচনা বেশি দেখা যায় কিশোর বয়সের শেষে কিংবা প্রাপ্তবয়সের শুরুতে। পরুষের তুলনায় মহিলাদের এই রোগ বেশি দেখা যায়। মনে রাখতে হবে প্যানিক অ্যাটাক মানেই প্যানিক ডিজঅর্ডার নয়। অর্থাৎ প্যানিক অ্যাটাক থেকে প্যানিক ডিজঅর্ডার ছাড়াও অন্য কোনো মানসিক রোগ হতে পারে।
গবেষণায় দেখা গেছে, জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে প্যানিক অ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ১৩.২ ভাগ এবং যাদের একবার প্যানিক অ্যাটাক হয় তাদের বেশিরভাগেরই পরবর্তীতে আবারও এই অ্যাটাক হওয়ার সম্ভবনা অনেক বেশি থাকে। গবেষণায় আরও দেখা গেছে প্যানিক অ্যাটাক হওয়া রোগীদের মধ্যে ১২.৮ ভাগের প্যানিক ডিজঅর্ডার রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ২০১৯ সালের আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, ২-৪ ভাগ মানুষের প্যানিক ডিজঅর্ডার হয়। আবার প্যানিক ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত রোগীদের একইসাথে অন্যান্য মানসিক রোগ থাকার সম্ভবনা প্রায় ৮০.৪ ভাগ।
প্যানিক ডিজঅর্ডারের নির্দিষ্ট কোনো কারণ এখনও জানা না গেলেও মূলত অন্যান্য মানসিক রোগের মতোই বংশগতির সাথে জীবদ্দশায় ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনার যোগফলেই এই রোগের কারণ হিসেবেই ধরা হয়। যেমন নিকটাত্মীয়ের কারও এই রোগ থাকলে কিংবা জীবনে ঘটে যাওয়া কোনো খারাপ ঘটনা ঘটলে এই রোগ হতে পারে। আবার দেখা যায় আমরা এই রোগের চিকিৎসায় যেসব ওষুধ ব্যবহার করি সেসব ওষুধ মস্তিষ্কের কোনো কোনো নিউরোকেমিক্যাল বা রাসায়নিক পদার্থের ওপর কাজ করে রোগকে নিয়ন্ত্রণ করে। এ থেকে এটা প্রমাণিত হয় যে এসব নিউরোকেমিক্যালগুলোর হ্রাস-বৃদ্ধি এই রোগের একটি কারণ।
এই রোগের চিকিৎসা আমরা দুইভাবে করতে পারি। যেমন ওষুধ এবং সাইকোথেরাপি। ওষুধের মধ্যে এন্টিডিপ্রেসেন্ট, বেটা ব্লকার ও বেনজোডায়াজিপাম গ্রুপের ওষুধগুলো ব্যবহার করা হয়। আর সাইকোথেরাপির মধ্যে কগনেটিভ বিহেভিয়র থেরাপি এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা। মনে রাখতে হবে এসব চিকিৎসার পাশাপাশি পরিমাণমতো ঘুম, নিয়মিত ব্যায়াম, নেশাদ্রব্য গ্রহণ না করা ও রিলাক্সজেশন থেরাপী এ রোগের চিকিৎসায় খুব ভাল ফল নিয়ে আসে।
প্যানিক ডিজঅর্ডার নিয়ে অবহেলা করা যাবে না। কারণ এ রোগ হতে রোগীর বিষণ্ণতা দেখা দিতে পারে। শুধু তাই নয় রোগীর আত্মহত্যার প্রবণতা এবং নেশায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা থাকে। এ রোগের ব্যাপারে নিজেকেও সচেতন থাকতে হবে এবং অন্যকেও সচেতন করতে হবে। এতে একদিকে যেমন রোগীর চিকিৎসাগত ভোগান্তি কমবে সেইসাথে রোগীর চিকিৎসা দ্রুত শুরু করা গেলে রোগীর রোগ যেমন দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আসবে তেমনি রোগের কারণে ভবিষ্যতে খারাপ পরিণতি হতেও রোগী বেচে যাবে।
ডা. ওয়ালিউল হাসনাত সজীব
সহকারী অধ্যাপক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ
মানসিক স্বাস্থ্য হাসপাতাল, পাবনা।
সূত্রঃ মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন, ৪র্থ বর্ষ, ১০ম সংখ্যায় প্রকাশিত।
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে