বাংলাদেশে পালিত উল্লেখযোগ্য দিবসগুলোর মধ্যে “শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস” অন্যতম। বুদ্ধিজীবী বলতে কোন ব্যক্তির নিজস্ব বুদ্ধিমাবৃওিক শিক্ষা, কর্ম, গবেষণা এবং ইতিবাচক জীবনের প্রতিফলন এবং দর্শনবোধকে বোঝায় যার মাধ্যমে ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ট্র কে প্রভান্বিত করে নতুন আলোর পথ উন্মোচন করেন। প্রাত্যহিক কর্মে সকল জায়গার বুদ্ধি প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। একজন বুদ্ধিজীবী অন্যের চিন্তাভাবনা কে মূল্যয়নের মাধ্যমে মানব জীবনের বিমূর্ত এবং রহস্যজনক দিকগুলি গবেষণায় মাধ্যমে তার মতবাদ কে সূখ্যভাবে বিশ্লেষণ করে থাকেন। একজন বুদ্ধিজীবী প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করতে পারেন এবং যে কোন পেশার সাথে সম্পৃক্ত থাকতে পারেন। কখনও কখনও বুদ্ধিজীবীরা এক হয়ে তার জ্ঞান ও বুদ্ধিকৌশলকে যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে সমাজের কোন সমস্যা সমাধানের প্রস্তাব দিতে পারেন, প্রত্যাক্ষান করতে পারেন। কোন মূল্যবোধ ব্যবস্থাকে রক্ষা করার জন্য মধ্যস্তাকারী হিসেবে কাজ করতে পারেন এবং যে কোন অন্যায় অবিচারের প্রতি দৃঢ় প্রতিবাদ গড়ে তুলতে পারেন ।
১৪ই ডিসেম্বর “শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস” এই দিবসটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় বাংলাদেশের মূল্যবোধ রক্ষা করার জন্য বুদ্ধিজীবীদের প্রেরণা অর্থাৎ উদ্দীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে আত্মত্যাগের ইতিহাসকে। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরী। যার পুরো নাম ছিল আবু নয়ীম মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী। তিনি একদিকে ছিলেন শিক্ষাবিদ, ভাষাবিজ্ঞানী, নাট্যকার, সাহিত্য সমালোচক এবং একজন নির্ভীক দেশপ্রেমিক নেতা। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন ১৩৫৮), যখন ছাত্ররা ১88 ধারা ভঙ্গ করে রাজপথে নেমে এসেছিল বাংলা ভাষা’কে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে। তখন বাংলা ভাষার জন্য প্রান দিয়েছিলেন অনেক ভাষা শহীদরা এবং কারাবরণ করেন অনেকে। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরী। ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করার জন্য পাকিস্তান সরকারের কাছে বন্ধী হয়ে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। কারাগারে বন্ধী হয়ে তিনি আরও জেগে ওঠেন। বন্ধী অবস্থায় তিনি কারাসঙ্গী অজিত গুহের কাছ থেকে প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের পাঠ গ্রহন করেন এবং কারাগারে বন্ধী অবস্থায় কৃতিত্বের সাথে এম.এ পাশ করেন।
জেলে বসে রচিত ‘কবর’ তার অন্যতম সাহিত্যকর্ম। ২ বছর তিনি দিনাজপুর এবং ঢাকা জেলে বন্দি ছিলেন। ১৯৫8 সালে পূর্ব পাকিস্তানের যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতাপ্রাপ্ত হলে তিনি কারাগার থেকে মুক্তিপান এবং ১৯৫৫ সালে বাংলা বিভাগে খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। বাঙ্গালী জাতি হিসেবে ‘বাংলা ভাষা’ যেন বিশ্বে সম্মানিত স্তরে পৌঁছাতে পারে। তার জন্য তিনি আবার মনোযোগ দেন লেখাপড়ায়।
১৯৫৬ সালে বৃওি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং ১৯৫৮ সালে হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে “ভাষাতত্ত্ব” অর্থাৎ ভাষার প্রকৃতি, গঠন, একক এবং যে কোনো ধরনের পরিবর্তন নিয়ে গবেষণা করে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন। পরবর্তীকালে দেখা গেছে তার এই গবেষণা শুধু বাংলা ভাষা কে বিজ্ঞানসম্মত ভাবে গবেষণা করেনি, চিকিৎসা বিজ্ঞানে খুলে দিয়েছেন এক নতুন উন্মেষিত দ্বার। কারণ রোগের কারণে মানুষ শারীরিক ও মানসিক ভাবে যেমন আক্রান্ত হয়ে থাকে তেমনি কোন কোন রোগের কারণে মানুষের ভাষা বিকাশ পর্বটি নাও হতে পারে অথবা বিকশিত ভাষা বিকাশ পর্বটি হারিয়ে যেতে পারে, তৈরী হতে পারে ভাষা বৈকল্য।
ভাষা বৈকল্য রোগীরা হতে পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের জন্য বোঝা। তার গবেষণার উপর ভিত্তি করে ২০১০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্মোচন করা হয় ‘চিকিৎসা ভাষাবিজ্ঞান’ নামে একটি নতুন গবেষণা ক্ষেএ। এই গবেষণায় রোগের কারণে ভাষার অন্তঃনিহিত কোন উপাদান (যেমন: ধবনি, শব্দ, বাক্য, অর্থ) আক্রান্ত হয়েছে তা বিশ্লেষণ করে একটি তাত্ত্বিক কাঠামো তৈরী করা এবং এই তাত্ত্বিককাঠামোর মাধ্যমে রোগীকে চিকিৎসা পদ্ধতি অর্থাৎ স্পীচ ল্যাংগুয়েজ থেরাপি দেয়া হয়।
যারা ভাষা নিয়ে গবেষণা করেন তাদের বলা হয়ে থাকে ‘ভাষাবিজ্ঞানী/ভাষাবিদ। শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর ভাষাবিজ্ঞানী হিসেবে এই অবদান অবিস্মরণীয়। ১৯৭১ সালে আবারও তিনি জেগে উঠেছিলেন দেশ মুক্ত করার জন্য। যখন স্বাধীনতা আমাদের দ্বার প্রান্তে, ১8 ই ডিসেম্বর ১৯৭১ রাজাকার বাহিনীদের মাধ্যমে নির্মমভাবে মুনীর চৌধুরীকে হত্যা করা হয়। বধ্যভূমিতে তার ক্ষত বিক্ষত লাশটি কেউ চিহ্নিত করতে পারেনি। কিন্তু মুছে ফেলতে পারেনি বাঙ্গালী জাতির জন্য তার মেধা, শ্রম, দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের ইতিহাসকে। মানুষ বেঁচে থাকে তার নিজ কাজের/কর্মের মাঝে, জীবনের বিনিময়ে পাওয়া ইতিহাস চাইলেও মুছে ফেলা যায় না ।
লিখেছেন
ডা: ফাহমিদা ফেরদৌস
মনোরোগ/মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ এবং চিকিৎসা ভাষাবিদ
সহকারী অধ্যাপক (মনোরোগবিদ্যা বিভাগ),
জেড এইচ সিকদার ওমেন্স মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে