অনেক সময় সিনেমা নাটকে মানসিক চাপ হতে হার্ট অ্যাটাকের মতো ঘটনা আমরা দেখে থাকি। যেমন ছেলের মৃত্যুর খবর বা দুর্ঘটনার খবর শুনে অথবা কোনো খারাপ খবর শুনে হার্ট অ্যাটাক হয়ে বাবা বা মায়ের মৃত্যু। এটা সবসময় সত্য নয়। অতিরিক্ত ভয় পেলে বুকের ব্যাথায় আক্রান্ত হওয়ার কারণটা নিঃসন্দেহে মানসিক। চিকিৎসকদের মতে, সবসময় বুকে ব্যাথার পেছনে হৃদযন্ত্রের ভূমিকা থাকে না। টেনশন বা মানসিক চাপ হতেও বুকে ব্যাথা হতে পারে। তবে বয়স্ক মানুষ কিংবা যারা আগের থেকেই হার্টের অসুখে ভুগছে, তাদের ক্ষেত্রে অনেক সময় হঠাৎ করে কোনো দুঃসংবাদ মৃত্যু ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে। যারা দীর্ঘদিন মানসিক চাপের মধ্যে দিয়ে যায় তাদের মধ্যে হৃদরোগের ঝুঁকি বেশি, এটা গবেষণায় প্রমাণিত। তবে কোনো খারাপ কিছু ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে যে হৃদরোগ হবে বা হার্ট অ্যাটাক হবে এটি সঠিক নয় বরং এর ফলে মানুষ আরো ভীত বা প্যানিক হয়ে যায়। তারা খারাপ কোনো ঘটনা বা সংবাদের সাথে হার্ট অ্যাটাকের একটা যোগসূত্র তৈরি করে ফেলে মনে মনে। ফলে যখনই জীবনে খারাপ কিছু ঘটে তখনই সে ভাবতে শুরু করে দেয় এই বুঝি হার্ট অ্যাটাক হলো। এই ধরনের দৃশ্য মূলত সকলক্ষেত্রে বিজ্ঞানসম্মত নয়। বিজ্ঞান সর্বদা বাস্তবনির্ভর ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা দ্বারা প্রমাণিত। সুতরাং কোনো বিষয় বাস্তবসম্মত হলে তা মানুষের হৃদয়ে পজিটিভ এফেক্ট ফেলে আর যদি তা বাস্তবসম্মত না হয় তার ফলাফল হয় নেতিবাচক।
মানুষ খুব অনুকরণপ্রিয়। যাকে সে মনে-প্রাণে আইডল ভাবে, তার সাথে বিভিন্ন বিষয়ে নিজেকে মেলানোর চেষ্টা করে। সিনেমা নাটকে বাস্তবচিত্রের প্রতিফলন না হলে দর্শকের মনে একটি ভুল বার্তা যাবে এবং সেটাকেই সে সঠিক ভেবে নিয়ে নিজের জীবনের সাথে মেলাতে শুরু করবে। ফলে উদ্বিগ্নতার শারীরিক উপসর্গকে সে হার্ট অ্যাটাক ভেবে নিয়ে আরো বেশি আতঙ্কিত হয়ে পড়তে পারে। এরকম দৃশ্য দেখানোর কারণ হতে পারে, মানুষ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খুব বেশি আবেগপ্রবণ। আবেগের কারণে তারা সবসময় যুক্তির ধার ধারে না বা বাস্তব জানার চেষ্টাটাও করে না। ফলে মানুষের মনকে নাড়া দেবে বা আন্দোলিত করবে, এমন ভাবনা থেকেই নির্মাতারা অনেকসময় তার সিনেমা বা নাটকের কাহিনি নির্মাণ করেন। কাহিনি যদি দর্শকের হৃদয় স্পর্শ করে তাহলে তা ব্যবসাসফল হবে, দর্শকনন্দিত হবে। কাহিনি বাস্তবনির্ভর করতে হলে অনেক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতে হয়, সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ওপর অনেক বেশি পড়াশুনা করতে হয়। সেক্ষেত্রে যথেষ্ট জ্ঞানের ঘাটতি থাকলে অনেকসময় ভুল তথ্য বা গোঁজামিল একটা ধারণা দর্শকের মনে গেঁথে যায়। আবার অনুমোদন কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা থাকলেও তা কাহিনি সঠিকভাবে যাচাই বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করতে পারে।
হিউস্টনের বেইলর কলেজ অব মেডিসিন-এর ‘মেডিসিন’ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক বিজয় নামবি বলেন “মানসিক চাপগ্রস্ত অবস্থায় শরীরে ‘ফাইট-অর-ফ্লাইট রেসপন্স’ সক্রিয় হয়ে ওঠে। কোনো মানুষ ভয় পেলে বা চমকে উঠলে তার রক্তচাপ বেড়ে যায়। সেক্ষেত্রে মানসিক চাপ ‘সিম্প্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম’কে সক্রিয় করে ‘অ্যাড্রনালিন’ ও ‘কর্টিসল’ নামক হরমোন নিঃসরণ করে যা হৃদস্পন্দনের গতি ও রক্তচাপ দুটোই বাড়িয়ে দেয়। দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া, ভীতিকর কিংবা বিপদের সময় এটি ভালো।
কর্মক্ষেত্রে সমস্যা, আর্থিক সমস্যা, ব্যক্তিগত সমস্যা ইত্যাদি থেকে ক্রমাগত মানসিক চাপ তৈরি হয়। এই মানসিক চাপ একজন মানুষের স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গড়ে তোলার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, যা রক্তচাপকে পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করে।’’ ইয়েল নিউ হ্যাভেন হসপিটালের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক, স্টিফেন জে. হুয়োট বলেন, ‘যতবার রক্তচাপ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়ে যায়, ততবারই রক্তনালী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মানসিক চাপের কারণে যদি কেউ অস্বাস্থ্যকর খাবার খান, ওজন বেড়ে যায়, শরীরচর্চা না করেন, রক্তচাপ কমানোর ওষুধ না খান তবে এসব কিছুই রক্তচাপের সমস্যা বাড়াতে থাকে। আবার চাপ সামলানোর জন্য যখন কেউ মদ্যপান, ধূমপান, মাদক সেবন করেন তখন তা রক্তচাপের ওপর এমনকি সার্বিক স্বাস্থ্যের ওপরও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে মারাত্মকভাবে।
মানসিক চাপে থাকা মানুষগুলো ভালোমতো ঘুমাতে পারে না। মাত্র একরাত ভালোভাবে না ঘুমালেই তা রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়। আর যাদের আগে থেকেই উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা আছে তাদের ঘুম না হলে এবং তার সঙ্গে পরের দিনের চাপ ও পরিশ্রম যোগ হয়ে মারাত্মক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। এগুলোই প্রতিনিয়ত একজন মানুষের হৃদরোগের মৃত্যু বরণের ঝুঁকি বাড়াতে থাকে।’
মনকে সতেজ ও প্রফুল্ল রাখতে হলে বিনোদন চর্চার কোনো বিকল্প নেই। তবে সে বিনোদন যেন শরীর ও মননে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। কোনো বার্তা যেন কারো কোমল মনের ক্ষতি না করে, কাউকে উদ্বিগ্ন বা প্যানিক না করে ফেলে সে ব্যাপারে শব্দচয়ন ও কাহিনি বিন্যাসে আরো সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। বস্টনের ব্রিগহ্যাম অ্যান্ড উইমেনস হাসপাতালের হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ মাইকেল আশা অ্যালবার্ট বলেন, কর্মক্ষেত্রে মানসিক চাপের ফলে পুরুষদের হৃদরোগের ঝুঁকির সাথে সাথে নারীদেরও হৃদরোগের ঝুঁকির বিষয়টি এখন পরিষ্কার। কর্মজীবী নারীদের মধ্যে যাদেরকে বেশি মানসিক চাপের মধ্যে কাজ করতে হয়, তাদের হৃদরোগের ঝুঁকি অন্যদের চেয়ে ৮৮% বেশি। তবে মানসিক চাপ বা ভয় আমাদের সিম্প্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেমকে সক্রিয় করে অ্যাড্রনালিন ও কর্টিসল হরমোন নিঃসরণ করে যার প্রভাবে হৃদস্পন্দনের গতি ও রক্তচাপ বেড়ে যায়, শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি দ্রুততর হয়। এটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। আবার যাদের প্যানিক সমস্যা আছে তাদের ক্ষেত্রেও একই ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়। সুতরাং বুক ধড়ফড় করা, রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া এবং দম বন্ধ হয়ে আসা মানেই হার্ট আট্যাক নয়। রিলাক্সেশন বা মেডিটেশন চর্চার মাধ্যমেও এটি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কখনো এর সঙ্গে সামান্য ওষুধ দেয়ার প্রয়োজন হতে পারে।
সবার উদ্দেশ্যে বলতে চাই, আপনারা কোনো বিষয়ে সঠিক তথ্য ভালোভাবে না জেনে অযথা আতঙ্কিত হবেন না। প্রয়োজনে আপনার চিকিৎসকের সাহায্য নিন বা মনোরোগ বিশেষজ্ঞকে দেখান। ওপরের আলোচনার প্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি, মানসিক চাপ থেকে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনাটি যেভাবে দেখানো হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এর প্রভাব নেতিবাচক, বিশেষ করে বয়স্ক মানুষ কিংবা যারা আগের থেকে হার্টের অসুখে ভুগছে তাদের ক্ষেত্রে এমন দৃশ্য অনেক সময় মৃত্যু ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে। এমন দৃশ্য দেখতে দেখতে অনেক সময় দেখা যায় অনেকে খারাপ কোনো ঘটনা বা সংবাদের সঙ্গে হার্ট অ্যাটাকের একটা যোগসূত্র তৈরি করে ফেলে মনে মনে। ফলে যখনই জীবনে খারাপ কিছু ঘটে তখনই ভাবতে শুরু করে দেয় এই বুঝি হার্ট অ্যাটাক হলো। মানসিক চাপ থেকে হৃদরোগ হয়-এটা বিজ্ঞানসম্মত। কিন্তু এই ধরনের দৃশ্য সকলক্ষেত্রে বিজ্ঞানসম্মত নয়। সিনেমা নাটকে বাস্তবচিত্রের প্রতিফলন না হলে দর্শকের মনে একটি ভুল বার্তা যাবে এবং সেটাকেই সে সঠিক ভেবে নিয়ে নিজের জীবনের সঙ্গে মেলাতে শুরু করবে। ফলে উদ্বিগ্নতার শারীরিক উপসর্গকে সে হার্ট অ্যাটাক ভেবে নিয়ে আরো বেশি আতঙ্কিত হয়ে পড়তে পারে। সিনেমা নাটকে দর্শককে আকৃষ্ট করার জন্য নিত্য নতুন ঘটনা প্রবাহ তৈরি করতে হয়। পরিচালকরা ভাবেন-কাহিনি যদি দর্শকের হৃদয় স্পর্শ করে তাহলে তা ব্যবসাসফল হবে, দর্শকনন্দিত হবে। এজন্যই সিনেমা নাটক ঘটনাবহুল করার জন্য এ ধরনের দৃশ্যের অবতারণা করেন। মানসিক চাপ ও হৃৎরোগের সম্পর্ক খুবই গভীর। অতিরিক্ত মানসিক চাপ হৃৎপিণ্ডের রক্তনালী সঙ্কুচিত করে রক্ত সরবরাহ কমিয়ে দিতে পারে। তাছাড়া হঠাৎ উত্তেজনায় হৃৎপিণ্ডের রক্তনালীস্থ চর্বির স্তর হঠাৎ করে ফেটে গিয়ে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। তাছাড়া হার্ট ফেইলিওরও হতে পারে। মানসিক চাপগ্রস্ত অবস্থায় শরীরে ‘ফাইট-অর-ফ্লাইট রেসপন্স’ সক্রিয় হয়ে উঠে। মানসিক চাপ ‘সিম্প্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম’কে সক্রিয় করে ‘অ্যাড্রনালিন’ ও ‘কর্টিসল’ নামক হরমোন নিঃসরণ করে যা হৃৎস্পন্দনের গতি ও রক্তচাপ দুটাই বাড়িয়ে দেয়। শুধু মানসিক চাপই হৃদরোগের জন্য দায়ী এমনটিও নয়। অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, ওজন বৃদ্ধি, ধূমপান, মদ্যপান, তেল জাতীয় খাবার, অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ ইত্যাদি উচ্চ রক্তচাপে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। সিনেমা নাটক বিনোদন, একইসঙ্গে শিক্ষার একটা মাধ্যম। মনকে সতেজ ও প্রফুল্ল রাখতে হলে বিনোদন চর্চার কোনো বিকল্প নেই। তবে সে বিনোদন যেন শরীর ও মননে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। তাই নির্মাতাদের প্রতি চাওয়া, এ ধরনের দৃশ্য যতটা সম্ভব বাস্তবসম্মতভাবে উপস্থাপন করা যাতে দর্শকরা মানসিক চাপ ও হৃদরোগের সঠিক সম্পর্কটা অনুধাবন করতে পারে। হৃদরোগ হলো দীর্ঘদিনের অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের ফল, সুতরাং তা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে দরকার সুন্দর ও সুশৃঙ্খল জীবনযাপন এবং দৈনন্দিন জীবনে কিছু ভালো অভ্যাস রপ্ত করার।
শুধুমাত্র মানসিক চাপ হৃদরোগের কারণ হতে পারে না, এর সঙ্গে অনিয়ন্ত্রিত ও বিশৃঙ্খল জীবনযাপন অনেকাংশে দায়ী। তবে সুস্থ হৃদযন্ত্রের জন্য মানসিক চাপ মুক্ত থাকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। মানসিকভাবে ভালো থাকতে সুস্থ বিনোদনের বিকল্প নেই। এ কারণে নাটক সিনেমাতে এরকম স্পর্শকাতর বিষয়গুলোর যৌক্তিক উপস্থাপন জরুরি। বিনোদন হোক সঠিক তথ্যনির্ভর ও আমাদের মনের উৎকর্ষ সাধনের নিয়ামক।
লিখেছেন- ডাক্তার মোহাম্মদ আব্দুল মতিন
সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
মানসিক রোগ বিভাগ, রংপুর মেডিক্যাল কলেজ।
সূত্রঃ মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন, ৪র্থ বর্ষ, ৯ম সংখ্যায় প্রকাশিত।
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে