হাসান আজিজুল হক আজীবনের স্বাপ্নিক

0
150
হাসান আজিজুল হক

শামীমা আক্তার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ও এখন চেয়ারম্যান। তিন দশকেরও বেশি সময় হাসান আজিজুল হকের সান্নিধ্য পেয়েছেন সহকমী ও শিক্ষক হিসেবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে শিক্ষকতা শুরু করলেন এখানে। বাংলাদেশের কিংবদন্তী এই ছোট গল্পকারের মৃত্যু হয়েছে গতকাল। তাকে নিয়ে স্মৃতির জানালা খুলে দিয়েছেন ওমর শাহেদের কাছে

মানুষটি তিনি ছিলেন খুব ভালো, অত্যন্ত সহযোগিতাপরায়ণ ছিলেন হাসান আজিজুল হক। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলাম, এখানে শিক্ষকতা শুরু করলাম-এই আমাকেই তিনি ছাত্রী সমতুল্য জ্ঞান করে সবসময় আগলে রেখেছেন। আমার আশা ও প্রত্যাশার চেয়েও ভালোবাসা, সহযোগিতা পেয়েছি তার কাছ থেকে।

হাসান স্যার ছিলেন পড়ালেখার লোক, ফলে পড়তে বেজায় ভালোবাসতেন। সাহিত্যের মানুষ ছিলেন তিনি। দর্শনের সঙ্গে সাহিত্যের মিশেলে লেখালেখি করেছেন। কেবল তার একটি আলাদা ভুবনই ছিল না, সাহিত্য ও জীবনবোধ এবং দর্শনের সংমিশ্রণ ছিল সেখানে। দর্শনের সঙ্গে সাহিত্যের যোগ পরিস্কার করে তুলে ধরেছেন তার ছোট গল্পগুলো, প্রবন্ধ আর উপন্যাসের ভুবনে। তিনি এই লেখা ও পড়ার ভুবনেই থাকতেন। আমাদের খুব ভালোভাবে, অতি সুন্দর করে সময় করে বুঝিয়ে দিতেন বিষয়গুলো। স্যারের সাহিত্যের গভীর বোধ থেকে আমরা সমৃদ্ধ হয়েছি প্রতিনিয়ত।

বইয়ের একটি বিরাট কালেকশন ছিল তার। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক আমরা যে বইটিই চাই, সেটিই তার কাছে আছে। লেখার রশদ জোগাড়ের জন্য, আপডেট থাকতে তিনি বই পড়ে যেতেন। আমাদের বিষয় সংশ্লিষ্ট বাংলা, ইংরেজি, লিঙ্গ, দর্শন, সাহিত্য ইত্যাদি যেকোনো বিষয়ের যেকোনো ভালো বই একমাত্র স্যারের কাছেই ছিল। তিনি দেদার পড়তেন, অনেক বই যোগাড় করতেন সারাবিশ্বে ছড়িয়ে থাকা তার বন্ধু, স্বজন, গুণগ্রাহী ও ছাত্র, ছাত্রীদের মাধ্যমে। চাইলে সেগুলো আমাদের পড়তে ও কাজে লাগাতে দিতেন।

এই মানুষটি শিক্ষক না হলে আমার মনে হয় অভিনেতা হতেন। কেননা, তিনি খুব ভালো অভিনয় করতেন। ছাত্রজীবন থেকে অভিনয়ের জড়িয়ে ছিলেন। আমি তার অভিনয়ের অনেক ছবি দেখেছি। আমাদের বিভাগেও আছে। ধীরে, ধীরে বিভাগে ছাত্র, ছাত্রী বেড়েছে। হাসান আজিজুল হক নামের বাংলা সাহিত্যের সেরা ছোট গল্পকার লেখা, পড়া, বিভাগের কাজ, আলোচনা সভা, ছাত্র পড়ানো ইত্যাদি অনেক কাজে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছেন বলে নাটকে অভিনয়ের কাজ কমিয়ে দিতে, দিতে বন্ধ করে দিয়েছেন। তারপরও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিভাগের নাট্য সংগঠনগুলোর কাজে বিভিন্নভাবে জড়িত ছিলেন। নাটকে অভিনয়ের জন্য ছাত্র, ছাত্রী ও শিক্ষকদের তিনি উৎসাহ দিয়ে গিয়েছেন।

এই ক্যাম্পাস তার বড় প্রিয় ছিল। আমরা যখনই যেকোনো প্রয়োজনে ডেকেছি, তিনি চলে এসেছেন। আমাদের বিভাগ থেকে অবসর নিয়েছিলেন অনেক বছর আগে-সবাই জানেন। তারপরও কোনোদিন না করেননি। আস্তে, আস্তে বার্ধক্য তাকে ঘিরে ধরলো। তিনি বয়সের ভারে নুব্জ্য হয়ে গেলেন, এরপর বাধক্যজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হতে লাগলেন। হাসান আজিজুল হক বুড়ো বয়সের রোগ শোককে জয় করে চিরতরুণ, চিরকালের সেরা গল্পকার হিসেবে ধীরে, ধীরে উঠে আসতেন তার বিভাগে।

আমাদের বড় ক্লাসরুমটি আছে তিন তলাতে। সেখানে আসতেন নিয়মিতই। বিভাগের যেকোনো নবীনবরণ, সমাপনী আয়োজনে নিয়মিত অত্যন্ত সম্মানিত অতিথি হিসেবে হাজির হয়েছেন। করোনা ভাইরাসের আক্রমণের আগে আগে আমরা শেষ অনুষ্ঠানটি করেছি। তাতে এসেছেন, সবার সঙ্গে হাসিমুখে অংশগ্রহণ করেছেন। এই কাজগুলোর একমাত্র কারণ ছিল ছাত্র, ছাত্রীদের প্রতি স্যারের অপরিসীম টান।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বছরের শিক্ষকতা জীবন শেষে তিনি ঢাকায় কিংবা তার গল্পের ভুবন পশ্চিম বাংলাতে চলে যাননি। যেখানে তার আত্মীয়-পরিজন, শৈশব কেটেছে। এর কারণ ছিল- এই বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে শহরে এবং পুরো বাংলাদেশে হাসান আজিজুল হকের বিরাট একটি ভুবন তৈরি হয়েছিল। একটি উদাহরণ দেই কেমন সম্প্রীতির বাঁধনে আমাদের সবাইকে বেঁধেছেন এই গুরুজন-স্যার টিচারর্স কোয়ার্টারের যে বাসাটিতে থাকতেন, বিহাসে বাড়ি তৈরি করে চলে যাবার পর সৌভাগ্যক্রমে আমি সেখানে উঠে গেলাম। টানা ৯টি বছর সেখানে থেকেছি। তিনি আমাকে অন্য প্রিয় শিক্ষকদের মতোই দাওয়াত করে বিহাসে খাইয়েছেন।

তিনি আগে এখানে  বাসায় থাকতেন, সেখানে পেছনে লেক আছে। আমার ছেলেও বারান্দার গ্রিল ধরে, ধরে উঠে যেত লেকের পাখি দেখতে। এখানে দাঁড়িয়ে তিনি পাখি দেখতেন। কাক-পক্ষীর সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল। মনকে প্রশান্ত করতেন, ভাবতেন। এভাবেই এই ক্যাম্পাস থেকে, এমন পরিবেশ থেকে তিনি তার লেখার ভুবন তৈরি করে নিলেন। বিহাসেও তার বাড়িটির দোতলায় খুব সুন্দর একটি জায়গা তৈরি করে নিয়েছিলেন তিনি। সেখানে বসে লিখতেন।

দর্শন বিভাগে শিক্ষক হিসেবে আসার আগে থেকেই তো লেখালেখির প্রক্রিয়ার মধ্যে ছিলেন। এই বিভাগে যোগদান করে তার সাহিত্য ও দর্শনের বোধ আরো উন্নতি করতে লাগলো। সাহিত্যের মধ্যে গভীরভাবে দশর্নকে বোধ করতে শুরু করলেন। তার সাহিত্যে দর্শন লেখায় গভীরভাবে হাজির আছে। এই বিভাগে নিজের চেম্বারে বসে অনেক সময় তিনি অবসর নেবার পরও লিখেছেন। বাসায় সুন্দর ভুবন তৈরি করে নিয়েছিলেন তিনি। সেখানে লিখতেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছিল তার লেখার উপকরণ পাওয়ার স্থান। অনেক কিছু নিয়েছেন তিনি এখান থেকে। এই পরিবেশকে তিনি তার পারিবারিক পরিবেশ থেকেও তাই বেশি বুঝতে পারতেন।

হাসান আজিজুল হক আজীবনের একজন স্বাপ্নিক। তিনি সারাজীবন কেবল তার বিভাগেরই নয়, সারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, ছাত্রীদের অনুপ্রাণিত করে গিয়েছেন। তাদের মাঝে সবসময় এসে তাদের জীবনবোধ গড়ে দেবার চেষ্টা করেছেন। সেজন্য নিজের যত কষ্টই হোক, সেসবকে উপেক্ষা করেছেন।

তিনি এত বড় একজন দার্শনিক-সবসময় যার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল আশাবাদের। দেশকে ভালোবেসে, তাকে জানার প্রেক্ষিতে উন্নয়নে এগিয়ে আসতে হবে এই উৎসাহ তিনি সবাইকে সবসময় দিয়ে গিয়েছেন। আমরা সবাই যেন ভালোকে নিতে পারি সেজন্য তার কাজের ভুবনে চেষ্টার কোনো কমতি ছিল না।

রাগ ছাড়া কোনো মানুষ হয় না। তিনিও রাগ করতেন। খারাপ কিছু দেখলে তিনি আমাদের বলতেন, ‘এভাবে তো ঠিক নয়’, ‘এই কথাটি ঠিক হলো না।’ পরে নিজের জ্ঞান দিয়ে তার রাগকে দূর করে ফেলতেন। তারপর আমাদের পথ দেখাতে এগিয়ে আসতেন স্যার। তিনি রাগ করলে কখনো আমরা তাকে শান্ত করে ফেলতাম। কখনো নিজের পান্ডিত্যে তিনি স্থির হয়ে যেতেন। রাগ দমন করতেন নিজের।

একবারের ঘটনা বলি তিনি আমাদের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের আজীবনের সভাপতি ছিলেন। একবার তিনি রেগে গিয়ে আর থাকতে চাইলেন না। পরে আমরা গিয়ে বোঝালাম। স্যার আবার সভাপতির দায়িত্বে ফিরে এলেন। তবে ঘৃণা তার ছিল না। তিনি কোনো মানুষকে ঘৃণা করতে পারতেন না। সেটি হাসান আজিজুল হক শেখেননি।

তার জীবনযাপন ছিল খুব সাধারণ। একটি বয়সে গিয়ে তিনি বাংলাদেশের সবচেয়ে ধনী লেখক হয়েছেন। তবে তখন তার আর পার্থিব কোনো চিন্তাভাবনা ছিল না। এটি সবাই জানেন, আরো অনেক শিক্ষকের মতো সারাজীবন একটি সাইকেল চালিয়ে হাসান আজিজুল হক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে শিক্ষকতা করার জন্য আসা-যাওয়া করেছেন, সংসার ও জীবনের সব কাজ সেরেছেন।

বিহাসে তিনি প্রথম দিকেই বাড়ি করে চলে গিয়েছিলেন। সেখানে এখন অনেক বাড়ি উঠেছে বলে আগের মতো পরিবেশটি নেই। তবে তিনি যখন প্রথম গিয়েছেন, শান্ত-নিবর পরিবেশে থেকেছেন। এমনভাবে থাকতে তিনি ভালোবাসতেন।

তার মেলামেলা সবসময় সাহিত্য নিয়ে ছিল। সেই পরিমন্ডলে ছিলেন তিনি সারাক্ষণ। অ্যাপ্লাইড কেমেস্ট্রির শহীদুল ইসলাম, সনৎকুমার সাহার মতো মানুষদের সঙ্গে তার খুব মেলামেশা ছিল। তিনি অনন্য ছিলেন তার ব্যক্তিত্ব, চলাফেরাতে তার লেখালেখির মতো।

১৬ নভেম্বর, ২০২১; ঢাকা।

 

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

“মনের খবর” ম্যাগাজিন পেতে কল করুন ০১৮ ৬৫ ৪৬ ৬৫ ৯৪
Previous articleকিশোর বয়সের মানসিক স্বাস্থ্য
Next articleশিশুর মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় গঠনোপযোগী পরিবেশ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here