মিনি’ যেভাবে বেড়ে ওঠে

0
99

১. কৌতূহলী শিশু
এক বৎসর বয়সে কথা বলতে শিখে ফেলা রবীন্দ্রনাথের ‘কাবুলিওয়ালা’ ছোটগল্পের পাঁচ বছর বয়সী মিনি স্বভাবসুলভ চাপল্যে বাবাকে প্রশ্ন করেছিল “বাবা, মা তোমার কে হয়?” মিনির বাবা কিন্তু সে প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে, কাজের বাহানায় মিনিকে বলেছিলেন “মিনি, তুই ভোলার সঙ্গে খেলা কর্গে যা। আমার এখন কাজ আছে।”

একটি শিশুর বেড়ে ওঠার জন্যে তার কৌতূহলী মনের খোরাক জোগানোটা খুবই জরুরি। বাবা-মা অথবা  বড়রা সাধারণত শিশুদের প্রশ্নের মুখোমুখি হলে বেশিরভাগ সময় প্রশ্নটিকে প্রত্যাখ্যান করেন, তাকে ধমক দেন। তিনি মনে করতে পারেন তার ব্যস্ততা বুঝতে না পারাটা শিশুটির অপরাধ। তিনি তাকে চুপ করে থাকতে বলেন। কখনো বা সরাসরি উত্তর না দিয়ে বলেন, ‘আমি এটা বলেছি তাই’ অথবা  যথাযথ উত্তর না দিয়ে বললেন ‘এটাই নিয়ম’ ইত্যাদি। অনেক সময় অতি সংক্ষেপে দায়সারা জবাব দিয়ে শিশুকে সাময়িক নিবৃত্ত করতে চান। কখনোবা মিনির বাবার মত শিশুর মনোযোগকে অন্যদিকে ধাবিত করে প্রশ্ন ও উত্তর দুইই এড়িয়ে যান। কিন্তু এগুলোর কোনটিই শিশুর সৃষ্টিশীলতা বা জ্ঞানান্বেষণ কে অনুপ্রাণিত করে না।
বাবা-মায়েদের যা করা উচিত তা হলো, শিশুকে তার প্রশ্নটির উত্তর খুজেঁ পেতে সাহায্য করা। প্রশ্নের উত্তরে শিশুকে ছোট ছোট পাল্টা প্রশ্ন করতে পারেন। নিজের মতামত শিশুকে জানিয়ে তাকে নতুন কিছু ভাবনার খোরাক দিতে পারেন।
কৌতূহল শিশুকে সক্রিয় করবে, নির্লিপ্ত সনাতন গড্ডালিকার বাইরে স্রোতের বিপরীতে বেড়ে উঠতে সাহায্য করবে। পাশাপাশি শিশুর মধ্যে সৃষ্টিশীলতা আর বিকল্প চিন্তা করার ক্ষমতা তৈরি করবে। শিশুর সকল প্রশ্নের যুক্তিগ্রাহ্য জবাব দেবার চেষ্টা করতে হবে, তার প্রশ্নে বিরক্ত হওয়া চলবে না, তাকে প্রশ্ন করতে বাধা দেয়া যাবেনা, তার প্রশ্নের কোনো অযৌক্তিক বা মিথ্যা উত্তর দেয়া যাবেনা।
Mini-03-03-15

২. শিশুর ভাষা শিক্ষার
‘আমার পাঁচ বছর বয়সের ছোটো মেয়ে মিনি একদণ্ড কথা না কহিয়া থাকিতে পারেনা। পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করিয়া ভাষা শিক্ষা করিতে সে কেবল একটি বৎসরকাল ব্যয় করিয়াছিল, তাহার পর হইতে যতক্ষণ সে জাগিয়া থাকে এক মুহূর্ত মৌনভাবে নষ্ট করেনা।’

মিনির এই ভাষা শিক্ষার বিষয়টি জ্যঁ পিয়াজের শিশুর ধারণার জগৎ তৈরি তত্বের দ্বিতীয় ধাপ প্রি-অপারেশনাল এর অন্তর্গত। সাধারণত ২ থেকে ৬ বছর বয়সের মধ্যে ধারণা তত্বের এই ধাপ গড়ে উঠে। এসময় শিশু শব্দ আর চিত্র দিয়ে তার চারপাশের সবকিছু ব্যাখ্যা করতে চায়। মিনিও এর ব্যতিক্রম নয়, তবে তার ভাষা শিক্ষা পর্ব খানিকটা আগেই তৈরি হয়েছে! মিনির এই বাকপটুতাকে কোনো অস্বাভাবিকতা যেমন অতি চঞ্চলতা বলা যাবেনা যদিও তার মা প্রায়ই ‘ধমক দিয়া তাহার মুখবন্ধ করিয়া দেয়’।

শিশুর এই ভাষা শিক্ষার পর্বটিকে উৎসাহিত করতে হবে। বিকৃত শব্দ বা বিজাতীয় শব্দ প্রয়োগ করে এই সময়টিকে বিগড়ে দেয়া মোটেও সঠিক নয়। প্রায়ই দেখা যায়, শিশুসুলভ শব্দ ব্যবহার করে বড়রা শিশুর সাথে কথা বলেন। এতে করে শিশুর ভাষা শিক্ষা অনেক সময় ব্যাহত হয়, কখনো কখনো তার উচ্চারণের ত্রুটি সারাজীবনের জন্য রয়ে যায়। শিশুর সাথে শুদ্ধ উচ্চারণে সঠিক শব্দ প্রয়োগ করে কথোপকথন করা উচিত। শিশুর প্রগলভতাকে বাচালতা জ্ঞান না করে তাকে বলতে দিতে হবে, তার সাথে কথা বলতে হবে। শিশুকে কথা শেখাতে তাকে বেশি মানুষের মাঝে রাখার চেষ্টা করতে হবে। তাকে ছোট ছোট শব্দ আগে শেখাতে হবে, আশেপাশের বস্তু, শরীরের অঙ্গ, রং, এবং পরিচিত পশুপাখির নাম আগে শেখাতে হবে। প্রয়োজনে ছবির বই, কার্ড, গুণতে শেখার খেলনা ব্যবহার করতে হবে।

৩. শিশুর জগৎ বিমূর্ত নয়
“বাবা, রাম দয়াল দরোয়ান কাক কে কৌয়া বলছিল, সে কিচ্ছু জানেনা। না?”…… “দেখো বাবা, ভোলা বলছিল আকাশে হাতি শুঁড় দিয়ে জল ফেলে, তাই বৃষ্টি হয়। মাগো, ভোলা এত মিছিমিছি বকতে পারে! কেবলই বকে, দিন-রাত বকে। ”
বারো–তেরো বছরের আগ পর্যন্ত শিশুর চেতনায় বিমূর্ত ভাবনার ক্ষমতা তৈরি হয়না। তাই পাঁচ বছর বয়সী মিনির কাছে রাম দয়ালের নিজস্ব ভাষারীতিতে কাক কে ‘কৌয়া’ বলা নিতান্তই বিষ্ময়ের। বিষ্মিত হতে হতেই শিশু বেড়ে উঠে। আবার পাশাপাশি একটি প্রতিষ্ঠিত সত্যকে সে কখনো পরিবর্তিত রূপে দেখতে চায়না।

৭ থেকে ১১ বছর বয়সের মধ্যে ধারণার এই পর্বটি শুরু হয়। যাকে জ্যঁ পিয়াজে বলেছেন, মূর্ত ধারণা তৈরির পর্ব বা ‘কংক্রিট অপারেশনাল’। মিনি এই কারণে মেনে নিতে পারেনা বৃষ্টির কারণ হিসেবে ভোলার কোনো আষাঢ়ে বক্তব্য। যদিও গল্পে আমরা দেখি, সাত বছর হবার আগেই মিনি এই পর্বে প্রবেশ করেছে। ধারণার জগৎ তৈরির এই পর্বে সংখ্যা, ভর আর আকৃতি দিয়ে শিশু তার চারপাশকে বুঝতে শেখে। মিনি যখন হাসতে হাসতে কাবুলিওয়ালাকে জিজ্ঞেস করে “কাবুলিওয়ালা, ও কাবুলিওয়ালা, তোমার ও ঝুলির ভিতর কী।” তখন কাবুলিওয়ালাও হাসতে হাসতে উত্তর দেয়, “হাঁতি”।

মূর্ত ধারণার সাথে কল্পনা ও বিমূর্ত ধারণা তৈরির এই সন্ধিক্ষণে মিনি একদিকে কখনোই বিশ্বাস করেনা ছোট্ট ঝোলায় হাতি থাকতে পারে আবার বিষয়টিকে সে আস্বাদন করে দারুণ কৌতুকের সাথে। এই কারণে একই উত্তর শোনবার জন্য একই প্রশ্ন সে বারবার করে। এই নির্মল আনন্দের জগৎটুকু একান্তই শিশুর নিজস্ব। শুরুতে কাবুলিওয়ালার বেশভূষা আর তার ঝোলা নিয়ে সংশয় থাকলেও পরে কিন্তু অসম বয়সী এই লোকটিকে বন্ধু করে নিতে মিনির বেশি সময় লাগেনি। একটি শিশুকে সৃষ্টিশীল হিসেবে গড়ে তুলতে এবং সকল ধরনের পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে হলে মূর্ত ও বিমূর্ত দুই ধারণার সাথেই শিশুর পরিচিতি থাকা প্রয়োজন। শিশুর কল্পনার জগৎকে অবদমন করার কোনো সুযোগ নেই, তাকে বাড়তে দিতে হবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে।

৪. শিশুর নৈতিক বিকাশ
মিনির বাবার দেয়া আধুলি যখন কাবুলিওয়ালা সকলের অজান্তে আবার মিনিকে ফিরিয়ে দেয় তখন বয়সজনিত সারল্যে মিনি তা গ্রহণ করে, এতে তার কোনো কুণ্ঠা হয়না। পরে বিষয়টি প্রকাশ পেলে সে জানায়, “আমি চাইনি, সে আপনি দিলে।”

লরেন্স কোহ্লবার্গ শিশুর এই নৈতিকতা বিকাশের পর্যায়গুলোকে তিনটি স্তরে ভাগ করেন। প্রথম স্তরকে তিনি বলেন প্রাক-প্রচলিত নৈতিকতা (প্রি-কনভেনশনাল মরালিটি), দ্বিতীয় স্তর হচ্ছে প্রচলিত নৈতিকতা (কনভেনশনাল মরালিটি) আর তৃতীয় স্তরটিকে তিনি বলেন প্রচলিত-উত্তর নৈতিকতা (পোস্ট কনভেনশনাল মরালিটি)।

নৈতিকতার বিকাশের প্রথম স্তরে মিনির অবস্থান। সাধারণত একেবারে শিশু পর্যায় থেকে এই স্তর শুরু। কোনো পুরষ্কার পেতে অথবা কোনো শাস্তি এড়াতে শিশু তখন পারিবারিক ও সামাজিক নিয়মগুলো মেনে চলতে বাধ্য হয়। শিশুর এই নৈতিক বিকাশকে সাবলীল করতে পরিবারে নৈতিকতার চর্চা করা প্রয়োজন। নিজের মতের পাশাপাশি অন্যের দৃষ্টিভঙ্গিকে গ্রহণ করার সক্ষমতা শিশুর মধ্যে জাগিয়ে তুলতে হবে। নয়তো শিশু নৈতিকতা শিক্ষার এক স্তর থেকে আরেক স্তরে উপনীত হতে পারবে না। একপেশে বদ্ধমূল নৈতিক বিশ্বাস নিয়ে একজন সংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ হিসেবে কোনো শিশু বেড়ে উঠুক তা কারো কাম্য নয়। একটা পর্যায়ে শিশু দেখে শিখে। তাই তার সামনে কোনো ধরনের অনৈতিকতার দৃষ্টান্ত তৈরি করা যাবেনা, তা যতই ক্ষুদ্র হোকনা কেন।

৫. শিশুর সামাজিকতা
চঞ্চল হৃদয়া মিনির আচরণ যে, অত্যন্ত লজ্জাজনক তাহা তাহার বাপকেও স্বীকার করিতে হয়। সে স্বচ্ছন্দে তাহার পুরাতন বন্ধুকে বিস্মৃত হইয়া প্রথমে নবী সহিসের সহিত সখ্য স্থাপন করিল। পরে ক্রমে যত তাহার বয়স বাড়িয়া উঠিতে লাগিল ততই সখার পরিবর্তে একটি একটি করিয়া সখী জুটিতে লাগিত। এমনকি, এখন তাহার বাবার লিখিবার ঘরেও তাহাকে আর দেখিতে পাওয়া যায়না।

শিশুর সামাজিকতা তৈরির জন্য তাকে সুযোগ করে দিতে হবে। আগডুম-বাগডুম খেলার বয়সে মিনির সঙ্গী ছিল ‘দরোয়ান রামদয়াল’ আর ‘ভোলা’- পরবর্তীতে বাবার প্রশ্রয়ে সে ভীনদেশী ‘রহমত’ এর সাথে সখ্যতা গড়ে তোলে। রহমত যখন একটি অপরাধ করে গল্পের মঞ্চ থেকে বিদায় নেয় তখন ‘নবী সহিস’ আর তারও পরে কিশোরীদের সাথে তার সখ্যতা গড়ে উঠে। মিনির এই সামাজিকতা তৈরিতে তার বাবার ভূমিকা অনস্বীকার্য। তিনি ঘেরাটোপের মধ্যে মিনিকে আটকে রাখেননি। মা বা পরিবারের অন্যদের অমূলক সংশয়কে উপেক্ষা করে কাবুলিওয়ালা রহমতের সাথে মিনির সখ্যতাকে তিনি কখনো বাধা দেননি। বাধা দিলে কাবুলিওয়ালার কাহিনী হয়ত অন্যভাবে শেষ হতো। শিশুকে সামাজিকতার শিক্ষা দিতে তাকে পরিচিত মানুষজনের সাথে মিশতে দিতে হবে, পাশাপাশি তার সব ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে পরিচিত করাতে হবে নতুনদের সাথেও। নতুন বন্ধু তৈরিতে তাকে উৎসাহিত করতে হবে। অনেকে মিলে খেলা যায় এমন খেলা তাকে খেলতে দিতে হবে। অবসরে পরিবারের সদস্যরা মিলে একসাথে সময় কাটানো, পড়ালেখার পাশাপাশি সংস্কৃতি চর্চা তার সামাজিক সম্পৃক্ততাকে আরো জোরদার করবে।

কাবুলিওয়ালা গল্পে শেষ পর্যন্ত “রাঙা-চেলি-পরাকপালে-চন্দন-আঁকাবধূবেশিনী মিনি সলজ্জভাবে” পাঠকের সামনে উপস্থিত হয়। একটি প্রগলভ শিশুর মধ্যে পরবর্তী জীবনে অতিচঞ্চলতা, অমনোযোগিতা, আবেগের সমস্যা, ব্যক্তিত্বের বিকার অথবা বিষন্নতা সৃষ্টি হবার মত অনেক দৃশ্যকল্প এই ছোটগল্পটিকে কখনো কখনো হুমকীর মুখে ফেলেছে ঠিকই কিন্তু গল্পের পরিসমাপ্তি ঘটেছে শুভময়তার মধ্য দিয়ে- কোনো অঘটন ছাড়াই। প্রতিটি শিশুর জীবন হোক বিকশিত মঙ্গল আলোকে প্রত্যেক বাবা-মায়ের শুভ উৎসব উজ্জ্বল হয়ে উঠে।

আহমেদ হেলাল
মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ,
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা।


প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনেরখবর-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য মনেরখবর কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।

Previous articleনির্যাতনের শিকার হতে পারেন স্বামী ব্যক্তিটিও
Next articleকখন হয় মানসিক রোগ?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here