হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন গবেষক চায়নার ১২৯টি প্রি স্কুলে খেলনার রং নিয়ে একটি গবেষণা করেন, যেখানে তাঁরা ইচ্ছাকৃতভাবে এই ধরনের অনেকগুলো খেলনা বিভিন্ন রঙের বানান এবং সেই স্কুলের বাচ্চাদের কাছে দেন।
এখানে গবেষণার জন্য দুটি দলে ভাগ করা হয়। একটি দলের বাচ্চাদের বলা হয়, হলুদ হচ্ছে মেয়েদের রং এবং সবুজ হচ্ছে ছেলেদের রং। অন্য দলের বাচ্চাদের রং সংক্রান্ত কোনো ধারণাই দেয়া হয় না। এই দুটি আলাদা দলের বাচ্চাদের মাঝে স্পষ্ট একটি পার্থক্য দেখা যায় সেখানে বাচ্চাদের আগে থেকে জানানো হয় কোন লিঙ্গের জন্য কোন রংটি নির্ধারিত, বাচ্চারা শুধু তাদের লিঙ্গের ভিত্তিতে হলুদ বা সবুজ রঙের খেলনা সংগ্রহ করে।
অন্যদিকে যে-সকল বাচ্চাদের এ সংক্রান্ত কোনো ধারণা দেয়া হয়নি তারা নিজেদের পছন্দমতো বিভিন্ন রঙের খেলনা সংগ্রহ করছে, সেখানে কোনো রং-নির্দিষ্ট বিষয় ছিল না।
Wong ও Yeung (২০১৮) দাবি করেন বাচ্চাদের রং সম্পর্কিত ধারণা একটি সামাজিক নির্মাণ যা বর্তমান সময়ের বিভিন্ন মিডিয়া ও বাণিজ্যিক পণ্যের বাজারজাতকরণের জন্য উদ্দেশ্যমূলকভাবেই নির্মাণ করে। বাচ্চাদের বিভিন্ন ধরনের খেলনা ব্যবহারও একই প্রক্রিয়ায় সমাজে চর্চিত হয়।
পশ্চিমা সমাজে লিঙ্গকেন্দ্রিক রং ও খেলনার যে-চর্চা দেখা যায় তার অনেক চর্চাই আমাদের বাংলাদেশে দেখা যায়। আমরা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে বাচ্চাদের খেলনাকে লিঙ্গকেন্দ্রিক চর্চার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করে দেখি। বিশেষ করে আমাদের সমাজের মধ্যবিত্ত পরিবারে এই চর্চা অনেক বেশি স্পষ্ট।
আমাদের পরিবারের ভেতরে কিংবা আশপাশে যদি একটি ছেলে বাচ্চা হাড়ি-পাতিল দিয়ে রান্না করার খেলা খেলে কিংবা খুব যত্ন করে জুতার খালি বাক্সে কাপড়ের তৈরি পুতুল দিয়ে খেলে তাহলে দেখা যাবে নিজ এবং অন্য পরিবারের নানা বয়সী সদস্যরা তাচ্ছিল্যের সুরে এইসব উপকরণ দিয়ে তার খেলাকে খারাপ বা অনুচিত হিসেবে চিহ্নিত করছে।
এখানে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, ছেলে শিশু কেমন হবে তার একটা কাঠামোবদ্ধ ধারণা সমাজে বিরাজ করে। এই সামাজিক ধারণাগুলো এতটাই গভীরে প্রোথিত যে, অনেক সময় অধিকাংশ মানুষ অবচেতন মনেই তা চর্চা করে। এ বিষয়গুলো যে শুধু পুরুষরাই চর্চা করে এমন নয়, বরং এ ধারণাগুলো অনেক নারীও ধারণ করে। আর এটাকেই বলা হয় পুরুষতান্ত্রিক মনস্তত্ত্ব যা নারী ও পুরুষ উভয়েই ধারণ ও চর্চা করতে পারে।
অন্যদিকে কন্যা শিশু কী নিয়ে খেলবে বা কী ধরনের রঙের খেলনা কিনবে বা খেলার সঙ্গী কে হবে তা-ও সমাজের চর্চায় নির্ধারিত হয়। একজন মেয়ে শিশু ধীরে ধীরে বড়ো হওয়ার প্রক্রিয়ায় অনেক কিছু জানতে পারে এবং তার সীমানা সম্পর্কে অবগত হয়। পরিবার ও সমাজ শিশুটির সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় তার নারী হয়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য ও নির্দেশনা প্রদান করে।
এক্ষেত্রে কন্যা শিশু যদি দুরন্ত হয়, ছেলে শিশুরা খেলে এমন খেলায় প্রতিনিয়ত অংশগ্রহণ করে তবে তাকে নানান ধরনের সামাজিক ধিক্কারের সম্মুখীন হতে হয়। যেখানে তার কৃতকর্মকে অপরাধ বা অনুচিত কাজ হিসেবে চিহ্নিত করে তার যেন পনুরাবৃত্তি না হয় সে বিষয়ে সাবধান করা হয়।
সামাজিকীকরণের এ প্রক্রিয়াগুলো আমাদের সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের মাঝেই দেখতে পাই। কিন্তু এখানে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় লক্ষণীয়। প্রথমত, শিশুর সামাজিকীকরণে শিশু নারী বা পুরুষ হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সমাজের যে প্রতিষ্ঠিত লিঙ্গীয় ধ্যান-ধারণাগুলো আছে সেগুলো পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেয়া।
এ ধারণাগুলোর পুনরুৎপাদন প্রতিনিয়ত চলতে থাকে। এখানে সাধারণত সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে প্রাধান্য দিয়ে সাংস্কৃতিক আদলে একটি চর্চার পরিসর তৈরি করা হয়। যা একভাবে কাম্যচর্চা হিসেবে অনেকের কাছেই বিবেচ্য থাকে।
দ্বিতীয়ত, শিশুর লিঙ্গীয় চর্চা কী হবে তা বহিঃসংস্কৃতি তথা বৈশ্বিক বাজারকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দ্বারা নির্ধারিত হয়। অর্থাৎ পণ্যকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা শিশুর শরীরকে সাবজেক্ট হিবেবে বিবেচনায় এনে শিশুর কাম্যচর্চা নির্ধারণ করে এবং সে অনুযায়ী শিশুর খেলনা এমনকি খেলনাসহ ব্যবহৃত পণ্যের রং-ও নির্ধারিত হয়।
এই চর্চা হঠাৎ উৎসারিত নয় বরং অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে জ্ঞান, ক্ষমতা ও কাঠামোর সম্পর্ক বিরাজমান। একইসঙ্গে এই চর্চাগত জায়গায় মিডিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বিভিন্ন দেশের গবেষণায় দেখা যায়, পাঁচ বছর বয়সী ছেলে শিশুরা তুলনামূলকভাবে বাইরের খেলাগুলো পছন্দ করে। অন্যদিকে নারী শিশুরা ঘরের ভেতরের খেলাগুলো পছন্দ করে, কিন্তু তা আবার নির্ভর করে সন্তানের বাবা-মা আসলে তাদের সন্তানের জন্য কোনটি বেশি পছন্দ করেন তার ওপর।
অর্থাৎ বাবা-মা আসলে তাদের সন্তানদের যেভাবে দেখতে চান তার একটা প্রতিফলন সন্তানের খেলার ধরন ও পছন্দের সামগ্রী কী হবে তার ওপর পড়ে। অন্যদিকে বাণিজ্যিকভাবে যখন কোনো খেলনা উৎপাদন করা হয় তা তার নির্দিষ্ট ভোক্তা (শিশু ভোক্তা) শ্রেণিকে উদ্দেশ্য করে নির্মাণ করা হয়।
এক্ষেত্রেও শিশুদের পছন্দ কী হবে তা একভাবে নির্মাণ করা হয়, যার সঙ্গে থাকে সমাজে প্রচলিত ধারণার সম্পর্ক। অর্থাৎ কোন লিঙ্গের শিশু কী উপকরণ দিয়ে খেলবে সে-বিষয়ে সমাজের কিছু ধারণা থাকে যার সঙ্গে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যকে যুক্ত করে তৈরি করা হয় নতুন নতুন উপকরণ এবং এই উপকরণগুলোর বিষয়ে নানান ধরনের জ্ঞান উৎপাদিত হয় বিভিন্ন সংস্থা, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে।
সেই জ্ঞান আবার বাজারে বিভিন্ন মিডিয়ার (বিজ্ঞাপন কিংবা আর্টিকেল) মাধ্যমে জনগণের কাছে পৌঁছে। যে জ্ঞান সাধারণ জনগণের চর্চিত ধারণার সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে সমাজে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে এবং ধীরে ধীরে তা স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। এভাবে কোনো একটি খেলনা নারী বা পুরুষ শিশুর জন্য নির্দিষ্ট হয়ে ওঠে এবং সে ধারণা থেকে ব্যতিক্রম হলে সমাজ তাকে অস্বাভাবিক হিসেবে বিবেচনা করে।
শিশুর মনস্তত্ত্ব নির্মাণে মিডিয়া ও মোটা দাগের জ্ঞানকাণ্ডের ধারণাগুলো কাজ করে। বর্তমান সময়ে বিশ্বায়নের ফলে দুনিয়ার যেকোনো প্রান্তের তথ্য অন্য প্রান্তে ছড়িয়ে যায়। বাংলাদেশসহ সারা দুনিয়ার বিভিন্ন সিনেমা বা চলচ্চিত্রে নায়ক বা কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে সাধারণত পুরুষকেই দেখা যায়। যেখানে পুরুষ হচ্ছে শক্তিশালী, প্রতিবাদী, কঠোর, নির্মাণকারী, সফল, সাহসী ইত্যাদি যা তার পুরুষালি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে প্রকাশ করে।
বিপরীতে নারী অনেকটা নমনীয়, কোমল, ঘরোয়া, রক্ষণশীল, সংবেদনশীল ইত্যাদি যা মাতৃসুলভ বা নমনীয় হিসেবেই বিবেচিত হয়। নারী-পুরুষের এই বিভেদের চিত্র তার খেলনা সামগ্রীর মাঝে খুব স্পষ্টভাবে লক্ষ করা যায়।
বর্তমান সময়ে ভিডিও গেইমসের ক্ষেত্রেও দেখা যায় সহিংস খেলা যেখানে সেনা সদস্য হিসেবে শত্রুকে ঘায়েল করার বিষয় থাকে সে ধরনের খেলায় ছেলে শিশুর আগ্রহ বেশি থাকে। একইভাবে বন্দুক, পিস্তল, ট্রাক, লেগো, ট্রেন ইত্যাদি খেলনা ছেলে শিশুর চর্চায় দেখা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে। অন্যদিকে বারবি ডল, টেডি বিয়ার, প্রসাধন সামগ্রী ইত্যাদি বস্তুগুলো মেয়ে শিশুদের জন্য ব্যবহৃত হতে দেখা যায়।
শিশুর খেলনার ডিজাইনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সমাজের বস্তুগত সংস্কৃতির সম্পর্ক রয়েছে। আমরা গোলাপি রং বলতে যেভাবে নারীর সঙ্গে সম্পর্কিত করে দেখি, এই নির্মাণ প্রক্রিয়ার একটি ঐতিহাসিকতার সম্পর্ক আছে।
বারবি ডলের রং গোলাপি ও এর আদিবাস আমেরিকান সমাজে যা সময়ের আবর্তে ধীরে ধীরে অপশ্চিমা সমাজেও চলে এসেছেÑযা এই অপশ্চিমা সমাজে একটা সময়ে অনুপস্থিত ছিল। খেলার উপকরণের যে বিশ্বায়ন তা খেয়াল করলে দেখা যায়, এসব মূলত পশ্চিমা ধারণা থেকে আমাদের সমাজে বিস্তৃত হয়েছে।
নৃবিজ্ঞানী Jean Pierre Rossie তাঁর Toys, Play, Culture and Society (2005) তে দেখান যে, পশ্চিমা খেলার উপকরণে জেন্ডারের যে বৈষম্য তা সকল সমাজে একইভাবে বিরাজমান নয়। বরং তিনি আফ্রিকান সমাজের এথনোগ্রাফিক উদাহরণ দিয়ে দেখান যে, আমেরিকান সমাজে খেলার উপকরণের রং ও ধরন অনুযায়ী লিঙ্গীয় যে বিভাজন আছে তা একইভাবে আফ্রিকান সমাজে নেই। বরং আফ্রিকান বিভিন্ন সংস্কৃতিতে খেলা খেলনা, প্রথা ইত্যাদি বিষয়ের ভিন্ন সামাজিক বাস্তবতা ও চর্চা রয়েছে।
আফ্রিকার গ্রামীণ সমাজে বারবি ডলের কোনো সামাজিক মূল্য নেই কারণ এখানে পশ্চিমা জ্ঞান ও চর্চা প্রবিষ্ট হয়নি। বিপরীতে স্থানীয় বিভিন্ন ধরনের পুতুলের উদাহরণ দেন তিনি যেগুলো বিভিন্ন রঙের এবং নারী- পুরুষ উভয় শিশুই এই পুতুলকে খেলনা হিসেবে বিবেচনা করে।
বর্তমান সময়ে আমাদের সামাজিক বাস্তবতায় খেলনার যে লিঙ্গীয় বিভাজন দেখতে পাই তা অনেকাংশেই পশ্চিমা জ্ঞানের আদলে নির্মিত বিভাজন এবং এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে লিঙ্গকেন্দ্রিক সামাজিক চর্চার বিষয়াবলি। একটি সমাজের শিশুদের খেলনাকে বোঝার জন্য সেই সমাজের খেলনার সামাজিক অর্থকে অনুধাবন করা জরুরি এবং এর সঙ্গে অপরাপর সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্পর্ককে অনুধাবন করা আবশ্যক।
একই সঙ্গে খেলনা কীভাবে একটি লিঙ্গীয় শ্রেণির উপকরণ হয় তা অনুধাবন করা জন্য সমাজে বৃহৎ অর্থে লিঙ্গীয় সম্পর্কের বিশ্লেষণের মাধ্যমে বুঝতে হবে। সর্বোপরি খেলনাকেন্দ্রিক বৈশ্বিক যে জ্ঞান এবং খেলনাকে পণ্য হিসেবে বাজারজাত করার প্রক্রিয়া ও মিডিয়ার উপস্থাপনার ধরনগুলো লক্ষ করতে হবে। তবেই শিশুদের খেলনার বস্তু, রং এবং জেন্ডার অনুধাবন করা সম্ভব হবে।
জাভেদ কায়সার
সহকারী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে