মানুষ এবং রোবটের মধ্যে একটা বড়ো পার্থক্য হলো আবেগ বা অনুভূতি। আমাদের জীবনযাপন, নিজেকে প্রকাশ করার ভাষাও নানারকম আবেগের রূপক দিয়ে পূর্ণ।
যেমন- কান্নায় ভেঙে পড়া, আহ্লাদে আটখানা হওয়া, ঈর্ষায় কাতর তো শোকে পাথর অথবা রাগে অন্ধ হয়ে যাওয়া। আবেগ প্রতিনিয়ত আমাদের অভিজ্ঞতাকে তার রঙে রঞ্জিত করছে। প্রাথমিক কিছু আবেগ যেমন: আনন্দ, দুঃখ, ভীতি। রাগ সবার মধ্যেই কোনো না কোনো সময় দেখা যায়। যদিও এগুলো খুবই স্বাভাবিক তবুও এগুলোর বহিঃপ্রকাশ স্বাভাবিকের চেয়ে কম বেশি হলে সেটা ভাবনার বিষয়।
আমাদের নানাবিধ আবেগের মাঝে রাগ নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষকরা কী বলছেন তা জানা যাক। অস্বাভাবিক রাগ হলো অযৌক্তিক, অযাচিত এবং নিয়ন্ত্রণহীন রাগ। যা ব্যক্তির পারিবারিক, সামাজিক এবং কর্মক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।আবার যা কিনা বিভিন্ন মানসিক ও সামাজিক পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গেও সম্পর্কিত।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, রাগ বা ক্রোধের সঙ্গে অনেকগুলো বিষয় জড়িত। বিভিন্ন মানসিক রোগের একটি কমন বা সাধারণ উপসর্গ হলো রাগ। একটি জরিপে বলা হয়েছে, বহির্বিভাগে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা নিয়েছেন এমন ১৩০০ জন লোকের মধ্যে অর্ধেকের বেশির মাঝারি থেকে তীব্র মাত্রার রাগ ছিল এবং এক চতুর্থাংশের মাঝে সেটা এতই তীব্র ছিল যে তা সহিংসতা বা ক্রিমিনাল আচরণে রূপ নেয়।
এছাড়াও বিষণ্ণতা, দুশ্চিন্তা, প্যানিক ডিজঅর্ডার, মাদকাসক্তি, ব্যক্তিত্বের সমস্যা এবং সিজোফ্রেনিয়াসহ বহু মানসিক রোগে সাধারণ উপসর্গ হলো অযৌক্তিক রাগ বা অতিরিক্ত ক্রোধ। আর্থ-সামাজিক বিভিন্ন বিষয়, বয়সের পার্থক্যের সঙ্গে সঙ্গে রাগের প্রকাশ বা প্রকোপের বিভিন্নতা দেখা যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি স্টেটের ১৮ বছর এবং তদোর্ধ্ব বয়সীদের মধ্যে রাগের প্রকোপ এবং এর সম্পর্কে সম্পর্কিত কী কী বিষয় আছে তা নিয়ে একটি বড় গবেষণা করা হয়েছে। যা প্রকাশিত হয় ২০১৬ সালে। জরিপে অংশগ্রহণকারী প্রথম ধাপে ছিলেন ৪৩০৯৩ এবং দ্বিতীয় ধাপে ছিলেন ৩৪,৬৫৩ জন।
দ্বিতীয় ধাপে সবাইকে ৩ টা প্রশ্ন করা হয়। আর তা হলো-
১. খুব ছোটোখাটো বিষয়ে রেগে যান অথবা রাগ নিয়ন্ত্রণ আপনার জন্য কঠিন কিনা?
২. প্রায়শই কি আপনি ক্রোধান্বিত হয়ে পড়েন এবং নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যান?
৩. রাগান্বিত অবস্থায় আপনি মানুষকে আঘাত করেন অথবা জিনিসপত্র ছড়ে ফেলেন বা ভাঙচুর করেন?
প্রত্যেকটি প্রশ্নের পর দৈনন্দিন জীবনে তার প্রভাব সম্পর্কেও প্রশ্ন করা হয়। যারা হ্যাঁ উত্তর দিয়েছেন এবং বলেছেন পারিবারিক, পেশাগত এবং সামাজিক জীবনে সমস্যা হয় তাদের রাগকেই চিহ্নিত করা হয়েছে অযাচিত তীব্র এবং নিয়ন্ত্রণহীন রাগ হিসেবে।
অংশগ্রহণকারীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা নির্ণয়ের জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতা, পেশা, মাসিক আয়ও রেকর্ড করা হয়েছে। DSM – 4 ব্যবহার করে নির্ণয় করা হয়েছে কোনো মানসিক সমস্যা আছে কিনা অথবা গত ১ বছরের মধ্যে চিকিৎসক সিজোফ্রেনিয়া হিসেবে ডায়গোনোসিস করেছেন কিনা। এর সঙ্গে সঙ্গে ১৭ বছরের নিচে কোনো সময় কোনো শারীরিক বা মানসিক লাঞ্ছনার শিকার হয়েছিলেন কিনা এবং বাবা মায়ের মধ্যে কোনো মানসিক সমস্যা বা মাদকাসক্তি ছিল কিনা সে সম্পর্কেও প্রশ্ন করা হয়। যেন রাগ বিষয়ে সম্পূর্ণ ধারণা পাওয়া যায়।
সব তথ্য বিশ্লেষণ করে পাওয়া যায়, যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের মাঝে নিয়ন্ত্রণহীন রাগের প্রকোপ ৭.৮১%। নারীদের তুলনায় পুরুষের রাগের মাত্রা বেশি। শ্বেতকায়দের তুলনায় এশিয়ানদের রাগ কম আবার আদি আমেরিকানদের মাঝে রাগ বেশি। বয়সের সঙ্গে নিয়ন্ত্রণহীন রাগের বিপরীত সম্পর্ক পাওয়া গেছে। ৪৫ বছরের বেশি বয়সীদের মাঝে রাগের হার কম।
যাদের মাসিক আয় বেশি, তাদের রাগ কম। বেকারদের মাঝে রাগের হার অনেক বেশি। রাগের হার বেশি ছিল বিধবা, তালাকপ্রাপ্ত অথবা অবিবাহিতর মাঝে। শৈশব-কৈশোরে শারীরিক মানসিক লাঞ্ছিত বা পরিণত বয়সে অযাচিত কোনো ঘটনার শিকার এবং বাবা-মায়ের মাদকাসক্তি বা মানসিক সমস্যা যাদের ছিল তাদের মধ্যে এই হার বেশি।
রাগ প্রায় সব মানসিক রোগের সাধারণ উপসর্গ হলেও ব্যক্তিত্বজনিত সমস্যা যেমন বর্ডার লাইন পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার এবং স্কিজোটাইপাল পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডারে বেশি পাওয়া গিয়েছে। বাইপোলার মুড ডিজর্ডার, মাদকাসক্তি ইত্যাদি রোগেও অনুপাত বেশি ছিল।
বিস্তারিত গবেষণা সত্ত্বেও, কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল এই গবেষণায়। যেমন- এটা সেল্ফ রিপোর্টের মাধ্যমে রাগ বিষয়ে ৩টি প্রশ্নের ওপর নির্ভর করে করা হয়েছে এবং ১৮ বছরের নিচে বয়সীদের বিশাল একটা অংশ বাদ পড়ে গিয়েছে, যাদের মধ্যে এই হার অনেক বেশি। কিন্তু তারপরও এটা একটা জাতীয় নিরীক্ষা এবং এই গবেষণার ফলাফল নির্দেশ করে, একটি কার্যকর স্ক্রিনিং টুলের প্রয়োজনীয়তা এবং সে অনুযায়ী প্রাথমিক দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ।
রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন, এই হেরে যাওয়া ঠেকাতে এবং নিয়ন্ত্রণহীন রাগের কারণ নির্ণয় করে মনো-সামাজিক ক্ষেত্রে রাগ নিয়ন্ত্রণের কৌশল অবলম্বন করলে অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়।
ডা. সাদিয়া আফরিন
রেসিডেন্ট এমডি (চাইল্ড অ্যান্ড অ্যাডোলসেন্ট সাইকিয়াট্রি),
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।