মৃত্যু কি জাগতিক জীবনের পরিসমাপ্তি নাকি স্বপ্নহীন ঘুমের অন্তহীন যাত্রা? মৃত্যুর সংজ্ঞা যেভাবেই করা হোক না কেন ‘মৃত্যু’ একটি নিশ্চিত ও অবশ্যম্ভাবী ব্যাপার।
“জন্মিলে মরিতে হবে অমর কে কোথা হবে?”, কবিতার এই একটি চরণেই মাইকেল জীবনের এই চরম সত্যটিকে তুলে ধরেছেন।
আপনাকে যদি প্রশ্ন করা হয় আপনার কিসে ভয়? সাপ, কুকুর, মাকড়সা, পানি নাকি উচ্চতা? একেক জন নিশ্চিতভাবেই একেক উত্তর দিবেন। কিন্তু উত্তর ভিন্ন ভিন্ন হলেও এই প্রতিটা বিষয় থেকেই হতে পারে মৃত্যু যা ব্যক্তির ভয়ের মূল কারণ।
অর্থাৎ মাধ্যম যাই হোক না কেন মূল ভয়টি কিন্তু মৃত্যু ভয়। মৃত্যু ভয় নেই এমন ব্যক্তি নেহাতই কম।কিন্তু কারো কারো ক্ষেত্রে এটি অস্বাভাবিকভাবেই বেশী। এইঅস্বাভাবিক বেশীটাই ব্যক্তির মধ্যে রোগের ইঙ্গিত দেয়। যেমনটা দেখা যায় মানসিক কিছু রোগে।
অনেক সময় কিছু রোগী আসে মানসিক চিকিৎসকের কাছে নানাবিধ টেস্টের রিপোর্টসহ বহু চিকিৎসকের ফাইল নিয়ে।এর আগেই হয়ত পরামর্শ পেয়েছিলেন মানসিক চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়ার।কিন্তু নিজের মনকে বিশ্বাস করাতে পারেননি যে তার সমস্যাটিও মানসিক হতে পারে।
যাইহোক, সর্বশেষ চেষ্টা হিসেবে তিনি যখন এলেন ততদিনে শুধু ফাইল জমা হয়েছে তাই নয় আর্থিক ক্ষতিও হয়েছে কয়েক গুণ। হঠাৎ বুক কেঁপে উঠে তার, প্রচণ্ড ধড়ফড় করতে থাকে বুক। ভয় আর আতঙ্কে মনে হতে থাকে এই বোধহয় মারা যাচ্ছেন, দম বন্ধ হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলবেন তিনি। স্বভাবতই এই অবস্থায় প্রথমে এটিকে তিনি হৃদরোগের সমস্যাই ভেবেছিলেন। কিন্তু বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষায় হৃদরোগের কোন সমস্যাই ধরা পরল না। এমনকি থাইরয়েড হরমোনের বৃদ্ধিতেও এমনটা হতে পারে, কিন্তু তাও রিপোর্টে পাওয়া যায়নি এবং অন্যান্য রিপোর্টও নরমাল বলে শেষ পর্যন্ত মানসিক চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতেই হল। এইলক্ষণগুলো দেখা দিতে পারে প্যানিক ডিজঅর্ডার নামক মানসিক রোগেও।
রোগীর উপরোক্ত অবস্থাটিকে বলা হয় প্যানিক অ্যাটাক, যেখানে দম বন্ধ হয়ে যাওয়া কিংবা বুক ধড়ফড় করা ছাড়াও আরও কিছু লক্ষণ থাকে, যেমন: শরীর, হাত-পা অসাড় হয়ে আসা, হাত-পা কাঁপতে থাকা, শরীরে গরম অনুভূতি ও ঘামহওয়া, মাথাব্যাথা, বুকব্যাথা, বমি বমি লাগা ইত্যাদি।
কারও যদি এই প্যানিক অ্যাটাক বারবার হতে থাকে কিংবা দিনের বেশীর ভাগ সময় এই নিয়ে ভয় কাজ করতে থাকে যা তার স্বাভাবিক কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে তাহলে একে আমরা বলি প্যানিক ডিজঅর্ডার।এই রোগে রোগীর হৃদস্পন্দন এত দ্রুত চলতে থাকে যে রোগী মনে করে, সে এবার নিশ্চিতভাবেই মারা যাচ্ছে।
প্যানিক ডিজঅর্ডারের মত কাছাকাছি আরেকটি সমস্যা হচ্ছে এগারোফোবিয়া। এই দুইটিই হচ্ছে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ রোগ। এগারো শব্দটি মুলত বাজার অর্থে ব্যবহিত হলেও মুলত এই রোগে কিছু স্থান ও অবস্থাকে বোঝান হয়েছে। আর ফোবিয়া অর্থ ভয় বা আতঙ্ক যা গ্রীক ‘ফোবোস’ শব্দ থেকে আগত। অর্থাৎ এগারোফোবিয়া হচ্ছে কোন স্থান বা অবস্থায় রোগীর মধ্যে ভয় বা আতঙ্ক তৈরি হওয়াকে বোঝায়। কোন রোগীর ক্ষেত্রে দেখা যায় একা ঘরে বা বদ্ধ স্থানে থাকতে বা একা কোথাও যেতে অথবা একা একা বাসে, ট্রেনে বা লঞ্চে ভ্রমণ করতে ভয় লাগে আবার কারও কারও ক্ষেত্রে অনেক লোকের মধ্যে যেতে বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে ভয় লাগে।
এইসব স্থান ও অবস্থায় রোগীর মধ্যে ভয় কাজ করে যে যদি ঐ সকল স্থান বা অবস্থায় রোগী কোন অসস্থিকর অবস্থায় পরে বা তখন যদি তার দুশ্চিন্তা অনেক বেড়ে গিয়ে অস্বাভাবিক কোন অবস্থা তৈরি হয় তাহলে ঐ অবস্থায় তাকে সাহায্য করার কেউ থাকবে না বা ঐ অবস্থায় সে নিজেকে ওখান থেকে সহজে বের করে আনতে পারবে না। তাই এই অবস্থা বা স্থানগুলোতে রোগীর ভয় বেড়ে গিয়ে প্যানিক অ্যাটাক এর মত হয় এবং কয়েকবার এরকম হলে রোগীর মধ্যে ওইসব স্থান বা অবস্থা এড়িয়ে চলার প্রবণতা দেখা দেয় যা তার সমস্যাটিকে আরও দীর্ঘস্থায়ী করতে থাকে। এই রোগেও তাই প্যানিক ডিজঅর্ডারের মতই মৃত্যুভয় হতে পারে।
মায়ানমারের সৈন্যদের নির্যাতনে এদেশে আসা রোহিঙ্গারা বা রানা প্লাজা ধসে আহত হওয়া মানুষেরা এখন কেমন আছেন? চোখের সামনে ঘটা অমানুষিক নির্যাতন কিংবা আকস্মিক দুর্ঘটনায় আহত এসব মানুষের মানসিক অবস্থায় কি কোন পরিবর্তন ঘটে নি? সেদিনের সেই ঘটনা তাদের কারও কারও ঘুমে ভয়ংকর স্বপ্ন রূপে এসে কি তাদেরঘুম থেকে জাগিয়ে তুলে না? মনের ভাবনায় সেই দুঃসহ স্মৃতি যে এখন অনেকের মনেই তীব্রভাবে নাড়া দিয়ে যায় তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। এড়িয়ে চলতে চাইলেও চলে আসে তা মনে। ভয় ও আতঙ্কগ্রস্ত এসব মানুষদের মনের এই রোগটিকে বলে পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার।
মৃত্যু ঘটতে পারে এমন কোন দুর্যোগ, দুর্ঘটনা বা নির্যাতন এর পরে এ রোগ দেখা দিতে পারে।এ রোগে নানাবিধ লক্ষণ থাকলেও মূলত তার কষ্টের বড় কারণ হচ্ছে তার স্মৃতিতে সেই ঘটনার বারবার পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকা এবং মনে হয় যেন সেই ঘটনা বাস্তবে আবার ঘটছে। সেই সাথে স্বপ্নের মধ্যেও ভয়ঙ্করভাবে ভর করে রোগীকে বিপর্যস্ত করে তোলে। মৃত্যুমুখ থেকে বেঁচে ফিরে আসা এসব ভীত, সন্ত্রস্ত রোগীরা স্বভাবতই মৃত্যুভয়ে ভীত হয়ে সেই ঘটনা বা স্থানগুলো এড়িয়ে চলতে থাকে।একি সাথে সবকিছুতে নেতিবাচক ধারনা তৈরি হয়, সবকিছুতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে,অন্যদের সাথে সম্পর্কগুলো খারাপ হতে থাকে। তারমধ্যে অল্পতেই ভীত হওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়, অল্পতেই চমকে উঠে, খুব সহজেই রেগে যায় সে,নিজের ক্ষতি করে বসে প্রায়ই।কষ্টদায়ক এই রোগটি অনেকদিন পর্যন্ত থেকে যেতে পারে।
কখনও কি আপনার মনে চিন্তা এসেছে, আপনি যে ঘরে শুয়ে আছেন সে ঘরের ছাদটি যদি এখন ভেঙ্গে পরে? কিংবা আপনি কিভাবে মারা যাবেন, খুব খারাপভাবে কি মারা যাবেন কিংবা মারা যাওয়ার পর আপনার কি ঘটবে? হয়ত এসেছে বা চলেও গেছে। কিন্তু কারও কারও ক্ষেত্রে এই চিন্তাগুলো বারবার আসতে থাকে, চাইলেও তাড়াতে পারেন না তিনি। এই বারবার চিন্তা আসা রোগটিকে বলে অবসেশিভ কমপালসিভ ডিজঅর্ডার। এ রোগে আসা অন্যান্য চিন্তার মত এটিও একটি চিন্তা যেখানে মৃত্যু মূল বিষয় যা রোগীকে ভীত ও আতঙ্কগ্রস্থ করে রাখে। না চাওয়া সত্ত্বেও বারবার আসা চিন্তাগুলো নিশ্চিতভাবেই বিরক্তিকর এবং কষ্টদায়ক। আর সেখানে যদি চিন্তার বিষয় হয় মৃত্যু তাহলে মৃত্যুভয়ে ভীত ব্যক্তির জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পরে খুব সহজেই।
মানসিক আরও কিছু রোগ আছে যেখানে রোগীর মধ্যে সন্দেহপ্রবণতা থাকে, মনে করে অন্যরা তার ক্ষতি করে, তাকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করে এমনকি মেরে ফেলতে চায়। ভয়ে রোগী ঘর থেকেই বের হতে চায় না। সন্দেহপ্রবণতার জন্য তৈরি হওয়া মৃত্যুভয় সিজোফ্রেনিয়া, ডেল্যুসনাল ডিজঅর্ডার এর মত জটিল কিছু মানসিক রোগে তৈরি হতে পারে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে অনেক মানসিক রোগেই মৃত্যুভয় থাকে। মৃত্যুকে নিয়ে অমূলক ভীতি তাই জিইয়ে রাখা ঠিক নয়।সঠিক সময়ে এসব মানসিক রোগের চিকিৎসা নিলে এই ভীতি থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব।মৃত্যু জীবনে একবারই আসবে তাই বলে সবসময় এই ভয়ে ভীত হলে জীবনে চলা কঠিন হয়ে পড়ে। শেক্সপিয়ার বলেছিলেন, “ভীরুরা মরার আগে বারেবারে মরে, সাহসীরা মৃত্যুর স্বাদ একবারেই গ্রহণ করে”। তাই জীবনকে এগিয়ে নিতে হলে ভয়কে জয় করতেই হবে।
সূত্র: লেখাটি মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত।
করোনায় স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে