গর্ভধারণ এবং সন্তান জন্মদান একজন নারীর জীবনে অনেক সুখের, অনেক আনন্দের একটি বিষয়। কিন্তু সবার জন্য এই প্রক্রিয়া আশানুরুপ হয় না, কারও কারও বিভিন্ন প্রকার জটিলতা ও তৈরী হয়।
সারা বিশ্বে শতকরা ১০ জন গর্ভবতী নারী এবং শতকরা ১৩ জন নারী সন্তান জন্মদানের পর বিষন্নতায় আক্রান্ত হন। উন্নয়নশীল দেশগুলিতে এই হার আরও বেশী। সাম্প্রতিক এক বড় গবেষণায় দেখা যায়, উন্নয়নশীল দেশে শতকরা ২০ জন নারী সন্তান জন্মদানের পর বিষন্নতায় আক্রান্ত হন।
গর্ভধারণ কালীন এবং প্রসব পরবর্তী সময়ে নারীর মৃত্যুর একটি বড় কারন আত্মহত্যা বা সুইসাইড। কারণ তীব্র বিষন্নতায় আক্রান্ত নারী নিজের যত্ন ঠিকভাবে নিতে পারেনা, তার ঘুম, গোসল, খাওয়া – দাওয়ার ঠিক থাকে না, তার মেজাজ খিটখিটে থাকে, কোনো কিছুই ভালো লাগে না-যা তাদেরকে শারীরিক ভাবে ও অসুস্থ করে তোলে। ফলশ্রুতিতে নবজাতকের পরিচর্যা ও ঠিকভাবে নিতে পারে না, সন্তানকে স্তনপান করাতে পারে না, সন্তানের সাথে তাদের বন্ধন মজবুত হয়না- যা সন্তানের বৃদ্ধি ও বিকাশে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। নবজাতকের মাঝে ডায়রিয়া ও অপুষ্টিজনিত রোগের হার ও প্রকোপ বাড়িয়ে দেয়। অনেক সময় পোষ্ট পার্টাম সাইকোসিসে আক্রান্ত রোগী নিজের সন্তানকে মেরে ও ফেলে।
কারা ঝুঁকিতে রয়েছে?
যে কোনো নারীই গর্ভকালীন এবং প্রসব পরবর্তী ১ বৎসর সময়ে মানসিক রোগে আক্রান্ত হতে পারে। তবে দারিদ্র্য, স্থানান্তর, অতিরিক্ত মানসিক চাপ এবং গার্হস্থ্য, যৌন, লিঙ্গ বৈষম্যজনিত বিভিন্ন প্রকার সহিংসতার শিকার যারা, যাদের মানসিক রোগের বংশগত ইতিহাস থাকে, পুর্বে যাদের মানসিক রোগের ইতিহাস থাকে, তাদের এসময়ে মানসিক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশী থাকে।
কি কি করণীয়?
১)পরিকল্পিত গর্ভধারণ করতে হবে
২) প্রেগন্যান্সি বা গর্ভধারনকালীন ও সন্তান প্রসবের পর শরীর ও মনের যত্ন নিতে হবে
৩) প্রেগন্যান্সি বা গর্ভধারণকালীন ও সন্তান প্রসবের পর
যে কোনো প্রকার শারীরিক ও মানসিক রোগ হলে জরুরী ভিত্তিক, নিষ্ঠার সাথে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অধীনে থেকে চিকিৎসা নিতে হবে।
৪) যারা মানসিক রোগের ঝুঁকিতে রয়েছে তাদের সতর্ক ও সচেতন থাকতে হবে, সমস্যা থাকলে সেগুলোর সমাধান করতে হবে।
৫) পারিবারিক, সামাজিক সমর্থন বাড়াতে হবে, জীবন সঙ্গীকে মূখ্য ভুমিকা রাখতে হবে।
৬) সর্বোপরি,মানসিক ও শারীরিক দিক থেকে প্রস্তুত থাকতে হবে।
কিভাবে নেবেন মানসিক প্রস্তুতি?
- যারা সন্তান নিতে ইচ্ছুক এবং চেষ্টা করছেন তাদের শতকরা ৬০ জন প্রথম তিনমাসে এবং শতকরা ৮৫ জন ১ বছর সময়ের মাঝেই গর্ভধারণ করে থাকেন। গর্ভকালীন সুদীর্ঘ সময়ে বিভিন্ন প্রকার মানসিক চাপ তৈরী হতে পারে। তবে চেষ্টা করতে হবে মানসিক প্রশান্তি ধরে রাখতে।
- বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে মানসিক চাপ গর্ভধারণকে নেতিবাচক ভাবে প্রভাবিত করে। তাই প্রতিদিন অন্তত ১০ মিনট যদি মাইন্ডফুলনেস মেডিটেশন করা যায় তাহলে তা খুব উপকারী হবে। এটা শুধু শরীর ও মনকে প্রশান্তই করবে না প্রয়োজনীয় কাজে মনোনিবেশ করতে এবং অপ্রয়োজনীয় কিছুকে না বলতে শেখায়।
- গর্ভধারণ কালীন সময়ে জীবনে বেশ কিছু বড় পরিবর্তন ঘটে। নিজেকে নতুন করে জানার সুযোগ হয়। এই পরিবর্তনের ইতিবাচক দিকগুলোতে মনোনিবেশ করতে হবে। আর যা কিছু হারিয়ে গেছে, যা কিছু ক্ষতি হয়েছে সেগুলো থেকে মনকে দূরে সরিয়ে রাখতে হবে।
- কোনো কোনো মা অতিরিক্ত মর্নিং সিকনেস, অপ্রতিরোধ্য ক্লান্তি ও অন্যান্য অসহনীয় অবস্হার মধ্য দিয়ে যান। তাই অনাকাঙ্ক্ষিত অনেক কিছুর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
- পরিবারে,বন্ধুদের মাঝে যারা গর্ভধারণ করেছেন, প্রয়োজনে যাদের সহায়তা নিতে পারেন, এমন কারও সাথে যোগাযোগ রাখুন,সমর্থন চান। যাদের পারিবারিক ও সামাজিক সমর্থন জোড়ালো থাকে তাদের প্রসব পরবর্তী মানসিক স্বাস্থ্য ভাল থাকে এবং নির্ধারিত সময়ের পুর্বে সন্তান জন্মদান, অপরিণত শিশু জন্মদানের ঝুঁকি কম থাকে।
- আপনার পার্টনার বা জীবনসঙ্গীর সাথে কথা বলুন। তাকে জানান আ আপনার ভালোলাগার কথা, আপনার ভয়ের কথা, মা হওয়ার অনুভুতির কথা। তার কাছে ও জানুন তার অনুভুতির কথা। আর তাতে দুজনার বন্ধন দৃঢ় হবে, সমস্যার সমাধান ও সহজ হবে।
- নতুন শিশুর আগমণের পুর্বেই পরিবারের অন্য শিশু বা শিশুদের মানসিকভাবে প্রস্তুত করুন।
কিভাবে নেবেন শারীরিক প্রস্তুতি?
- সন্তান নেবার কমপক্ষে ৬ মাস আগে থেকেই জীবনযাপন প্রণালি তে পরিবর্তন আনুন। চা, কফি, পাস্তুরিত খাদ্যদ্রব্য, ধুমপান, মদ্যপান পরিহার করুন।
- ফলিক এসিড ভিটামিন গ্রহন করুন- যা জন্মগত বিকলাঙ্গতা যেমন স্পাইনা বাইফিডা প্রতিরোধ করবে।
- সব প্রকার কৃত্রিম প্রসাধনী পরিহার করুন। প্রাকৃতিক, উদ্ভিদজাত নিরাপদ প্রসাধনী ব্যবহার করুন।
- গর্ভাবস্থায় দাঁতের মাড়ির ইনফেকশন প্রিম্যাচিউর বেবির জন্ম দিতে পারে। তাই দাঁতের চিকিৎসা করুন।
- যে কোনো দীর্ঘ মেয়াদী রোগ যেমন- হাইপোথাইরয়ডিজম,ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, অ্যাজমা ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণে আছে কিনা দেখুন।সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞ এবং প্রয়োজনে একজন অবসটেট্রিকস এন্ড গাইনী বিশেষজ্ঞ এর পরামর্শ নিন।
- গর্ভধারণ কালীন প্রথম তিনমাস কোনোপ্রকার ঔষধ গ্রহন না করাই শ্রেয়। যদি একান্তই নিতে হয় তবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্বাবধানে থেকে নিরাপদ ঔষধ, নিরাপদ মাত্রায় গ্রহণ করুন।
- নিয়মিত এন্টিন্যাটাল চেকআপ করুন। প্রয়োজনীয় খাদ্যগ্রহণ করুন, নিয়মিত এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমান। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী যোগব্যায়াম করতে পারেন।
সূত্র: লেখাটি মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত।
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে