যৌন রোগ চিকিৎসার পোস্টারে ছেয়ে গেছে ঢাকা। অলিতে গলিতে বাসা-বাড়ির দেয়ালে যৌন শক্তি বর্ধক ওষুধ আর চিকিৎসা কেন্দ্রের বিজ্ঞাপন সম্বলিত পোস্টার। এমনকি কোমলমতি শিশু কিশোরদের স্কুলের দেয়ালও বাদ যাচ্ছে না বিজ্ঞাপনের আওতা থেকে।
বাসে-ট্রেনে লিফলেট-স্টিকারের জোয়ার দেখে মনে হয় পুরো দেশটাই বুঝি যৌন সমস্যায় ভুগছে। কোথাও বাস একটু থামা মাত্র বোরকা পরা নারীরা জানালা দিয়ে লিফলেট ছুঁড়ে মারে। লিফলেটগুলোর ভাষা খুব খোলামেলা। আগে বড় বড় বাস টার্মিনালে এমনটা দেখা যেত। এখন ছোট বড় প্রায় সব বাস স্ট্যান্ডে এইসব চিকিৎসা কেন্দ্রের ছড়াছড়ি। দুই-দশ গজের মধ্যে তাদের অবস্থান। চিকিৎসার বিষয় বলতে গেলে একটাই নারী পুরুষের গোপন রোগ। ক্যাবল টেলিভিশনগুলোর মাধ্যমেও চলে এমন বিজ্ঞাপন। আর যাদের পুঁজি কম, দোকান ভাড়া করে সেন্টার খুলতে পারে না ,তারা ভ্যানগাড়ির ওপর পসরা সাজিয়ে বসে। হাতে মাইক নিয়ে পর্নোগ্রাফির অ্যালবাম খুলে যৌন জ্ঞান বিতরণ করতে করতে ওষুধ বিক্রি করে। তারাও খোলামেলা ভাষায় কথা বলে। পথচারী আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার সামনে তারা নারী-পুরুষের যৌন সমস্যার বিস্তারিত বিবরণ দেয়। সবার সামনে আ্যলবাম খুলে যৌনাঙ্গের ছবি দেখায়। দেখতে দেখতে বিষয়টা যেন গা সওয়া হয়ে গেছে ।
মূলধারা মানে অ্যালোপ্যাথিক ওষুধের দোকানগুলোয় দেখা যায় বাহারি রকমের ভিটামিন, যৌন শক্তি বর্ধক ও মিলেনের সময় দীর্ঘকারী ওষুধের প্রদর্শনী। তাক ভর্তি থরে থরে সাজানো ওষুধ কোনোটার ওপর ফোলানো বাহুর ছবি, কোনোটায় আঙ্গুর-কমলা-বেদানা-নাশপতির ছবি।
স্বল্প শিক্ষিত, অল্প বয়সী স্বল্প আয়ের মানুষই মূলত এসবের ক্রেতা। আগে এসব মানুষের হাতে টাকা ছিল না। গার্মেন্টস, গার্মেন্ট এক্সিসরিজ ও অন্যান্য সহযোগী কর্ম ক্ষেত্র তৈরি হওয়াতে এসব মানুষের হাতে টাকা এসেছে। ফলে তাদের জীবনের চাওয়া পাওয়া সমস্যাগুলো টাকার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করছে। যদিও কোনো জরিপ আমার জানা নেই, তবুও এটুকু বলা যায়, নগরবাসী এসব মানুষের অন্যান্য আর পাচঁটা সমস্যার মধ্যে যৌন রোগ একটা বড় সমস্যা ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের সাইকিয়াট্রি সেক্স কিনিক-এর কোঅর্ডিনেটর ডা. সালাহ্উদ্দিন কাউসার বিপ্লবের সাথে কথা বলে জানা যায়, কম বয়সী দম্পতিদের যে সমস্যাটা বেশি তা হল দ্রুত বীর্যপাত। আর এই সমস্যার জন্য অনেক ক্ষেত্রে ডিভোর্সের হুমকির মধ্যে পড়তে হয় স্বামীকে। সংসার টিকিয়ে রাখার জন্য স্বামীরা তখন সহজ উপায় খোঁজে।
এখন শুধু সামাজিক বা আর্থিক প্রয়োজন থেকে মেয়েরা বিয়ে করছে না। আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী একটা মেয়ের কাছে ভাত-কাপড়ের চেয়ে শারিরীক এবং মানসিক প্রয়োজনটা বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। স্বামী অক্ষম হলে ডিভোর্স দিতে পিছপা হচ্ছে না। নীরব নিস্তব্ধ নিস্ক্রিয় পড়ে থেকে স্বামীকে যৌন সুখ দিতে মেয়েরা এখন আর আগের মতো অতটা রাজি নয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরপরেই ইউরোপে নারীর অর্থনেতিক স্বাধীনতার সাথে তার যৌন আচরণের পরিবর্তন শুরু হয়েছিল। তখন পুরুষের সংখ্যা কমে গেলে নারীরা অধিক হারে কর্মক্ষেত্রে আসতে শুরু করে। উপার্জনক্ষম নারীরা নিজের প্রতি বেশী মনোযোগী হয়। এখন বাংলাদেশেও সেরকম একটা অবস্থা তৈরি হয়েছে। গ্রাম ছেড়ে আসা মেয়েরা শহরে বাঁচার চেষ্টা করছে, নিজের পছন্দে বিয়ে করছে। অভিভাবক মহল আগের মত কঠোর থাকতে পারছে না। ঘরের বাহিরে একটি মেয়ে কার সাথে মিশবে আর কার সাথে মিশবে না এই সিদ্ধান্ত এখন তার ওপরেই ছেড়ে দিতে হচ্ছে।
শিক্ষায়ও নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে পুরুষের তুলনায়। প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ-সুবিধা তুলনামূলক মেয়েরা বেশি পাচ্ছে। নিম্ন মধ্যবিত্ত ও নিম্ন বিত্তে এমন অনেক স্বামীকে পাওয়া যাবে যার শিক্ষাগত যোগ্যতা তার স্ত্রীর তুলনায় কম। শিক্ষা ও অর্থ দুটোই নারীকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অনুকূল পরিবেশ যেমন তৈরি করে দিচ্ছে তেমন বাড়াচ্ছে জীবনের প্রতি সচেতনতা। পুরুষকে এখন একটা চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে হচ্ছে। তাকে প্রমাণ করতে হচ্ছে, সে তার নারী সঙ্গীর কতটা উপযোগী। এতটা কঠোরভাবে না হলেও তাকে ভাবতে হচ্ছে তার নারী সঙ্গীর যৌন আকাঙ্ক্ষা নিয়ে।
পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে বিজ্ঞাপনের ভাষাতেও। আগে যৌন উত্তেজক ওষুধের বিজ্ঞাপনে একজন পুরুষকে উৎসাহিত করা সে কতাটা উত্তেজিত হবে-এই বলে। এখন বলা হচ্ছে, ওই ওষুধ খেয়ে সে তার যৌন সঙ্গীকে কতটা সুখী করতে পারবে।
নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন হবে, হতে থাকবে। এটাই স্বাভবিক। সভ্যতার পথ রোধ করা কোনো সুস্থ্য চিন্তা নয়। পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়াটাই আসল কথা। শহরময় বিজ্ঞাপনের ছড়াছড়ি দেখে যেমন যৌন স্বাস্থ্যের প্রয়োজনীয়তা বোঝা যায় তেমনি নারীর যৌন আকাঙ্ক্ষার প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি যে বদলেছে তাও বোঝা যায়।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমদের মূলধারার চিকিৎসা ব্যবস্থা এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য কতটুকু প্রস্তুত?
ডা. এসএম আতিকুর রহমান
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
বদলে যাচ্ছে আমাদের যৌন জীবন ধারাবাহিক প্রতিবেদনের অন্যান্য পর্ব গুলো পড়তে পারেন এখান থেকে
বদলে যাচ্ছে আমাদের যৌনজীবন-পর্ব ২
বদলে যাচ্ছে আমাদের যৌনজীবন-পর্ব ৩
বদলে যাচ্ছে আমাদের যৌন জীবন-পর্ব ৪
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনেরখবর-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য মনেরখবর কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের দায় নেবে না।