মানুষের আবেগানুভূতির সাথে পরিপাকতন্ত্রের কোনও সর্ম্পক আছে?

পছন্দসই খাবার গ্রহণে মানসিক চাপ ও বিষণ্ণতা কি কমে?

মানুষ হিসেবে আমি সবসময়েই খুব অসুখী ধরনের। আমার মধ্যে অতিরিক্ত চিন্তাভাবনা করার প্রবণতাও রয়েছে। বন্ধুদের কাছে আমি একজন হতাশাগ্রস্ত ও খিটখিটে স্বভাবের মানুষ হিসেবেই পরিচিত। আমি কখনও কখনও খুব হতাশাগ্রস্ত  এবং খিটখিটে হয়ে যাই এবং অযৌক্তিকভাবে রাগারাগি করি। তারপরেই আমার মধ্যে একপ্রকার অপরাধ বোধ জাগে। কিন্তু তার ফলে আমার মেজাজ-মর্জির কোনও উন্নতি হয় না।

আমার স্বভাবের এই ত্রুটির কারণ জানতে আমার অনেক সময় লেগে গিয়েছিল এবং শেষমেশ আমি বুঝেছিলাম যে এর পিছনে রয়েছে আমার উদ্বেগ ও অবসাদের শারীরবৃত্তীয় চক্র।

প্রশ্ন হল, মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যার আলোচনায় আমি শারীরবৃত্তীয় শব্দটি কেন  ব্যবহার করলাম? কারণ বিগত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা থেকে আমি বুঝেছি যে আমার অতিরিক্ত মানসিক চিন্তা ও আবেগানুভূতির মূলে ছিল দৈহিক রাসায়নিক বিক্রিয়ার প্রভাব, যা মূলত পাচনতন্ত্র বা খাদ্য পরিপাক ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত।

আমার যখন মাত্র ৩০বছর বয়স তখন আমি ভালোভাবে বুঝতে পারলাম যে প্রায় সবরকমের খাবারদাবারের (গমজাত খাবার, দুধজাতীয় খাদ্য, ডিম, চকোলেট এবং অন্যান্য খাদ্যবস্তু, তার মধ্যে কয়েকটি শাকসব্জি, ভেষজ বস্তু, মশলাপাতিও রয়েছে)  ক্ষেত্রেই আমার পরিপাক বা হজমের সমস্যা রয়েছে। এই খাবারগুলোর মধ্যে কখনও কোনওটা খেলে আমার মধ্যে অল্পস্বল্প সমস্যা থেকে এক সপ্তাহ ধরে বিছানায় শুয়ে থাকার মতো অসুস্থতা দেখা দিত। এই ঘটনার বেশ কিছু সময় পরে বুঝতে পেরেছিলাম যে ওই খাবারদাবারের সঙ্গে আমার আবেগানুভূতিজনিত সমস্যারও সরাসরি যোগ রয়েছে।

এরপরে খাবারদাবারের উপরে নিয়ন্ত্রণ এনে আমার নিজেকে স্বাস্থ্যবান বলে মনে হতে শুরু করল এবং আমি নতুন উদ্যমে শক্তি সঞ্চয় করে আনন্দ পেলাম। আমার মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির ফলে দৈহিক স্বাস্থ্যেরও উন্নতি হয়েছিল। এইসময়ে আমার নিজেকে অত্যন্ত সুস্থ বোধ হচ্ছিল। ভালো ঘুম হচ্ছিল, কাজ করার শক্তি পাচ্ছিলাম, সাধারণ মানুষ বিনা পরিশ্রমে যেসব কাজ করে আনন্দ পায় যেমন- পার্টি করা, ঘুরে বেড়ানো প্রভৃতি কাজ করেও আমার বেশ ভালো লাগছিল; মোটের উপর আমি খুব খুশিতে ছিলাম।

তবে আমি কী খাব, তা নিয়ে বারবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার অভ্যাস থাকার ফলে আমি মানসিক ও শারীরিকভাবে পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম, যা কিছুটা হলেও  আমার আনন্দের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। খাবারের তালিকায় এমন বহু খাবার ছিল যা হজম করতে আমার প্রচুর সময় লেগে যেত। কোন খাবার, কী জাতীয় খাবার খেলে আমার পরিপাক করতে সুবিধে হবে, তা বোঝার জন্য প্রতিটি খাবার মুখে দিয়ে যাচাই করা একপ্রকার অসম্ভব হয়ে গিয়েছিল। যদি আমায় স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে হয় তাহলে সামাজিকতা রক্ষা করার জন্য রেস্তোরাঁ, পার্টি প্রভৃতি জায়গায় গিয়ে নানারকম খাবার খেতে হতে পারে। সেক্ষেত্রে আমার পক্ষে তা মানিয়ে চলা সত্যিই সহজ কাজ ছিল না।

কিন্তু কয়েকটি খাবারের বিপরীত প্রতিক্রিয়ার পরে আমার সন্দেহ হতে শুরু করেছিল যে এর পিছনে গভীর কারণ রয়েছে। কিছু খাবার আবার আমার মানসিক উদ্বেগের ক্ষেত্রে বিপজ্জনক ছিল। আর উদ্বেগের নিজস্ব বহিঃপ্রকাশ হিসেবে সংক্রমণজনিত প্রতিক্রিয়া হওয়াটা খুব অস্বাভাবিক ঘটনা নয়।

এই সমস্যার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা এখনও ততটা জোড়ালো না হলেও সাম্প্রতিককালের গবেষণায় এই বিষয়ে কিছু পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এই বিষয়ে দু’বছর আগে নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা গিয়েছে যে আমাদের খাদ্য পরিপাকের সঙ্গে স্নায়ুতন্ত্রের যোগাযোগের সময়ে এমনকিছু নিউরো-রাসায়নিক (নিউরোকেমিক্যালস্‌) পদার্থের ব্যবহার হয়, যা  আমাদের মস্তিষ্কে বার্তা পৌঁছতে সাহায্য করে এবং অন্ত্রের কার্যাবলীর সঙ্গে আমাদের মস্তিষ্কের গভীর যোগাযোগের ফলে আমাদের মানসিক উদ্বেগের মতো প্রাথমিক আবেগানুভূতির ভূমিকাও এক্ষেত্রে একপ্রকার মুখ্য হয়ে দেখা দেয়। গবেষণায় নির্দিষ্ট কয়েকটি ব্যাকটেরিয়াও অবসাদগ্রস্ত রুগিদের ক্ষেত্রে বিপজ্জনক বলে চিহ্নিত করা হয়েছে বা তাদের সঙ্গে ওই ব্যাকটেরিয়াগুলোর যোগসূত্র খুঁজে
পাওয়া গিয়েছে।

এই গবেষণা থেকে সিদ্ধান্ত করা গেছে যে নির্দিষ্ট কয়েকটি মানসিক অসুখের  চিকিৎসায় প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়াকে উপযোগী করে ব্যবহার করা যায়। এবং যখন এইধরনের চিকিৎসা করা সম্ভবপর তখন আমাদের মেজাজ পরিবর্তনের কারণ এবং কোন খাবার খেলে আমরা শুধু শারীরিক নয়, মানসিকভাবে সুস্থ বোধ করতে পারব সে সম্পর্কেও সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সহজসাধ্য হবে। আর এভাবেই আমাদের জীবনযাপনের ক্ষেত্রেও বদল আনা সম্ভব হবে।

শুনলে অবাক হয়ে যাবেন যে এই ঘটনা শুধু আমার সঙ্গে ঘটেনি। আমি আরও অনেক মানুষের কথা বলতে পারি যারা আমার মতো খাবারদাবারের উপর নিয়ন্ত্রণ করে তাদের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটিয়েছিল। এই বিষয়ে দিল্লির বাসিন্দা ৩২ বছর বয়স্ক সাংবাদিক অদিতি মাল্য জানিয়েছেন, ”আমি লক্ষ করেছি গ্লুটেন, ল্যাকটোজ এবং ইস্ট জাতীয় খাবার খাওয়ার ফলে আমার মধ্যে ক্লান্তি বা উদ্যমহীনতা দেখা দিত এবং এই খাবারগুলো খেলে আমার মেজাজ-মর্জিরও বদল ঘটছিল। আমি ক্রমশ খিটখিটে হয়ে পড়ছিলাম ও বিষণ্ণ বোধ করতাম।”

২৫ বছরের নাওমি বার্টন, দিল্লির প্রকাশনা জগতের একজন পেশাদারের গ্লুটেন জাতীয় খাবার সহ্য হত না। এর ফলে তাঁর মানসিক স্বাস্থ্যের উপর ওই  খাবারগুলোর সরাসরি বিক্রিয়া হত। কিন্তু সে কথা বার্টন স্বীকার করতে চাইতেন না। এই বিষয়ে তিনি বলেছেন, ”আমি লক্ষ করতাম যখন আমার পেটের গণ্ডগোল হত তখন আমার মনঃসংযোগ ক্রমশ কমে যেত, ক্লান্ত লাগত, খুব আবেগান্বিত হয়ে পড়তাম, যেন মনে হত আমার জীবনটা কেমন শূন্য হয়ে গিয়েছে।”

আমাদের মতো যাদের উপর খাদ্যের এমন ক্ষতিকারক প্রভাব পড়ে তাদের মনে  রাখা জরুরি যে আমরা একে অপরের থেকে আলাদা এবং আমাদের প্রয়োজনীয়তাগুলোও আলাদা। তবে খাবারদাবারের উপর নিয়ন্ত্রণের ফলে নাটকীয়ভাবে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়।

আমার ক্ষেত্রে এর বহিঃপ্রকাশ এমন হয়েছিল যা আমি কোনওদিনই চিন্তা করতে পারতাম না। যেমন- যখন আমি সুস্থ বোধ করতাম তখন আমি শান্ত, ধীর-স্থির হয়ে যেতাম, আমি প্রকৃতই খুশি ছিলাম, সহজে খিটখিটে হতাম না। আমি বেশ দয়ালু ও ধৈর্যশীল হয়ে উঠেছিলাম।

আমি এখনও প্রায়শই অসুস্থ বোধ করি। যদিও যে কোনও খাবার খাওয়ার ফলে মাঝে মাঝে হওয়া ছোটখাটো বিক্রিয়ার বিষয়ে আমি বারবার নজরদারি করে  নিশ্চিত হতে চাই। কিন্তু এখন আমি জানি যে কোন খাবার খেলে আমার মধ্যে মানসিক উদ্বেগ জন্মাবে না বা কোন খাবার আমার পক্ষে বিপজ্জনক অথবা কোন খাবার খেলে আমায় তেমন সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে না। এখন আমি সহজেই হেসে বলতে পারি আক্ষরিক অর্থেই এই খাবার শুধু আমার খিদে মেটানোর জন্য তৈরি হয়েছে।

যখন আমার মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত আবেগানুভূতির প্রকাশ ঘটে, যেমন- ছোট কোনও বিষয় নিয়ে দারুণ চিন্তাভাবনা করা, সঙ্গীকে কামড়াতে যাওয়া, সিনেমা দখে কান্নাকাটি করা প্রভৃতি, তখন সেইসব লক্ষণগুলোকে আমি সহজেই চিহ্নিত করতে পারি। অর্থাৎ তখন বুঝতে পারি যে পিএমএস (প্রিমেন্সট্রুয়াল সিনড্রোম) বা খাদ্যজনিত প্রতিক্রিয়ার ফলেই আমার মধ্যে এসব লক্ষণ দেখা দিচ্ছে। এটা কোনও  ব্যক্তিত্বের ত্রুটি বা বাইরে ঘটা কোনও ঘটনার যুক্তিপূর্ণ ফলাফল নয়। আমার মধ্যে এই অবস্থাটা যাতে কেটে যায় সেজন্য আমি অপেক্ষা করব এবং এর ফলে যাতে আমার নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকে নজর রাখব। সেই সঙ্গে আমার মধ্যে জন্মানো অতিরিক্ত মানসিক উদ্বেগ দূর হওয়ার জন্য এবং আবেগের বশবর্তী হয়ে নাড়ির গতি অস্বাভাবিক অবস্থা থেকে যাতে স্বাভাবিক হয় সেজন্যও  আমি অপেক্ষা করব। আমি নিজের প্রতি দয়ালু থাকার চেষ্টা করব। ধীরে ধীরে এমন কাজ করার দিকে মনোযোগ দেব যার ফলে আমার মন সমস্যা থেকে বাঁচার জন্য অন্যদিকে বিচ্ছিন্ন হয় ও আমায় সঠিক পথে চালিত করতে পারে।

 সূত্র: মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক ভারতীয় একটি ওয়েবসাইটে প্রবন্ধটি লিখেছেন উন্মানা। 

মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে চিকিৎসকের সরাসরি পরামর্শ পেতে দেখুন: মনের খবর ব্লগ
করোনায় মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক টেলিসেবা পেতে দেখুন: সার্বক্ষণিক যোগাযোগ
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
করোনায় সচেতনতা বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও বার্তা দেখুন: সুস্থ থাকুন সর্তক থাকুন

 

Previous articleমানবসৃষ্ট দুর্যোগেও মানসিক সমস্যা তৈরি হয়
Next articleকরোনা মহামারী’তে মন ভাল রাখতে সহায়ক পরামর্শ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here