মানসিক রোগের বয়স লাগে না

মানসিক রোগের বয়স লাগে না

মানসিক রোগের বয়স নিয়ে আমাদের বিভ্রান্তির শেষ নেই। একটু নজর দিলে আমাদের চারপাশেই এ ধরনের বিভ্রান্তি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখা যাবে। মানসিক রোগ আসলে কোনো রোগ কিনা, এটা যেমন প্রশ্ন (!), আবার এর চিকিৎসা, চিকিৎসা পদ্ধতি থেকে শুরু করে সুস্থতা অসুস্থতা নিয়েও বিভিন্ন রকম কথাবার্তা আমরা প্রায়ই শুনে থাকি।

পাঠক যদি একটি একটি করে জানতে চান, তবে তার প্রত্যেকটির আলাদা করে উত্তর কিংবা পূর্ণ একটি করে লেখা তৈরি করা সম্ভব।

তবে আপাতত অতি পরিচিত ও প্রচলিত একটি বিভ্রান্তি নিয়েই বরং কথা বলি।

মানসিক রোগ কখন শুরু হতে পারে ?

এক কথায় উত্তর যে কোনো বয়সে, যে কোনো সময়। নির্দিষ্ট করে বলার মতো কোনো উত্তর নেই।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে প্রায়ই আমাদের শুনতে হয়, আগে কোনো দিন ছেলেটি বা মেয়েটির মাঝে এমন কোনো সমস্যা ছিলো না। আগে তো কোনোদিন ও এমন করতো না। কিংবা কেউ বলেন, ছোটকাল থেকে ও ভালো ছিলো।

আর এ ক্ষেত্রে বেশির ভাগ সময়ই আমাদের উত্তর হয়, আগেতো ওর রোগটি ছিলো না।

উত্তর শুনে হয়তো অনেকেই হতাশ হন। মেনে নিতে কষ্ট হয়। রোগীর স্বজনেরা মানতেই চান না যে মানসিক রোগ হতে হলে কোনো বয়স লাগে না। তাদের মতে, মানসিক রোগ ছোট বেলা থেকেই শুরু হতে হবে।উল্টোভাবে বলা যায়, ছোট বেলা থেকে কেউ কোনো সমস্যায় থাকলে বা পড়লে সেটাই মানসিক রোগের মধ্যে পড়বে। অন্যথায় সেটা অন্য কোনো সমস্যা, মানসিক রোগ নয়।

বস্তুত মানসিক রোগ যেকোনো বয়সে, যেকোনো মানুষের, যেকোনো সময় হতে পারে।

নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয় যে, এতো বছরের আগে হলে মানসিক রোগ নয় কিংবা এতো বছরের পরে হলে সেটা মানসিক রোগ।

তবে অন্যান্য যেকোনো শারীরিক রোগের মতোই কিছু কিছু মানসিক রোগ বা সমস্যা আছে যেসব নির্দিষ্ট কিছু বয়সে বা সময়ে হতে পারে। কিছু রোগ যেমন জন্মগত, কিছু বংশগত, কিছু প্রকৃতি নির্ভর, কিছু আবার বয়স নির্ভরও হতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন রকমের মানসিক চাপ, ওষুধের প্রভাব (নেশা দ্রব্যসহ) থেকে শুরু করে অনেক কারণেই মানসিক রোগ হতে পারে। যার উপর যখন বা যে বয়সে এসব ভর করে, তখনই তার কোনো না কোনো রোগ বা সমস্যা হতে পারে। এখানে বয়স নিজে কোনো বিষয় নয়।

ধরুন, কারো কিডনি রোগ হলে সেটা যেমন নির্দিষ্ট কোনো বয়সের কারণে হয় না, তেমনি মানসিক রোগও ছোটদের কিংবা বৃদ্ধদের যে কারোরই হতে পারে।

তবে শারীরিক রোগের সাথে মানসিক রোগের একটি বড় রকমের তফাৎ হলো, প্রকাশভঙ্গীর ক্ষেত্রে। একই মানসিক রোগ ভিন্ন বয়সে, ভিন্ন রকমের প্রকাশভঙ্গী নিয়ে হাজির হতে পারে।

এমনকি একজন ব্যক্তির ক্ষেত্রেও এ পার্থক্য দেখা যেতে পারে। কারো সাত-আট বছরে যদি কোনো একটি মানসিক রোগ হয়, তার তখন যে প্রকাশভঙ্গী হবে, একই রোগ-এই ব্যক্তির ক্ষেত্রে পরবর্তীতে অর্থাৎ ৪০, ৫০ কিংবা ৬০ বছর বয়সে একই রূপে প্রকাশ নাও হতে পারে। সম্পূর্ণ ভিন্ন হতে পারে রোগের প্রকাশ।

কিন্তু কিডনির কোনো একটি রোগের প্রকাশ কিন্তু সব বয়সেই প্রায় একই রকম হবে। এটা শারীরিক রোগের তুলনায় মানসিক রোগের বড় একটি পার্থক্য।

আমাদের বিভ্রান্তির কারন কি?

মানসিক রোগের ক্ষেত্রে বয়স সংক্রান্ত বিষয়টিকে গুলিয়ে ফেলার বড় কারণ সম্ভবত, মানসিক প্রতিবদ্ধিতাকে মানসিক রোগের সাথে মিলিয়ে ফেলা। আমরা জানি মানসিক প্রতিবন্ধিতা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে জন্মগত (কিছু কিছু পরবর্তীতেও শুরু হতে পারে), অর্থাৎ ছোট বেলা থেকেই আচরণের ভেতর কিছু কিছু অসংলগ্নতা দেখা যায়। অনেকেই হয়তো ধারণা করেন, এসবই (কেবলমাত্র) মানসিক রোগের লক্ষণ। তাই জন্ম থেকে শুরু হওয়া সমস্যাগুলোকেই মানুষ অন্যদের ক্ষেত্রেও খুঁজে বেড়ান।

সেসব না থাকলে মানসিক রোগ হবে না বলেই অনেকে ধরে নেয়। যদি সমস্যাগুলো ছোটকাল থেকে না থেকে থাকে, তবে সেসবকে মানসিক সমস্যা ভাবতেও অনেকের অসুবিধা হয়। এমনকি বিশেষজ্ঞের মুখ থেকে শোনার পরও মানতে অনীহা।

এসবের পেছনের কারণ হিসেবে, রাজনৈতিক সামাজিক অর্থনৈতিক শিক্ষা সংক্রান্ত অনেক কিছুই বিদ্যমান। একদিনে সব সমস্যা দূর করা সম্ভব নয় জানা কথা, তবে দ্রুতই শুরু হওয়া দরকার।

মনে রাখতে হবে, যে কারণেই হোক, রোগগুলোকে সঠিক সময়ে চিহ্নিত করতে না পারার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন, আক্রান্ত ব্যক্তিটি এবং তার পরিবার। মানসিক স্বাস্থ্য, মানসিক রোগ বিষয়ক বিভ্রান্তিগুলো যতদ্রুত দূর হবে ততই মঙ্গল। মঙ্গল আক্রান্ত লোকটির জন্য, তার পরিবারের জন্য এমনকি দেশের জন্য। বিভ্রান্তি দূর করে দ্রুত চিকিৎসার আওতায় আনা এবং রোগমুক্ত হওয়া সরাসরি অর্থনৈতিক অবস্থার সাথেও সম্পর্কযুক্ত।

রোগের ক্ষেত্রে বয়স নয় বরং রোগের কারণ খোঁজা অত্যন্ত জরুরি।

মনে রাখতে হবে, রোগ রোগই… সে যে রোগই হোক, মানসিক কিংবা শারীরিক।

চিকিৎসাতেই রোগ সারে, অপেক্ষা বা পরামর্শে নয়।



প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।

Previous articleনিয়ন্ত্রণে রাখলে মানসিক চাপ উপকারী
Next articleমাদক মানেই কেমিকেল
অধ্যাপক ডা. সালাহ্উদ্দিন কাউসার বিপ্লব
চেয়ারম্যান, মনোরোগবিদ্যাি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here