প্রতিটি মুহুর্তে আমাদের মনে নানা ধরনের চিন্তা আসা-যাওয়া করছে। অবিরাম এই চিন্তন প্রক্রিয়ায় যেমন আছে ইতিবাচক চিন্তন ক্ষমতা তেমনি আছে নেতিবাচক চিন্তা করার প্রবণতা। কখনও কখনও এই নেতিবাচক চিন্তাগুলোতে আমরা এমনভাবে আটকে যাই যে, এগুলো বাস্তবে সত্যিকার ভাবেই ঘটবে বলে আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পড়ি। নেতিবাচক চিন্তার প্রতি মনোযোগ এবং বিশ্বাসের কারণে মানুষ ধীরে ধীরে অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার বা উদ্বেগ জনিত রোগ এগোরা ফোবিয়ায় ভুগতে পারে। আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন প্রকাশিত ডায়াগনষ্টিক এন্ড স্ট্যাটিস্টিক্যাল ম্যানুয়েল ফর সেন্ট্রাল ডিজঅর্ডার (ডিএসএম-৫) এ এগোরাফোবিয়া নির্ণয়ের জন্য কতগুলো লক্ষণের কথা বলা হয়েছে-
ডায়াগনস্টিক ক্রাইটেরিয়া (রোগ নির্ণায়ক লক্ষণ)
♦ উল্লেখ করার মত বা সহজে চোখে পড়ার মত ভয় এবং উদ্বেগ দুই (আরো বেশি) দেখা যায় নিম্নলিখিত চারটি পরিস্থিতির মধ্যে,
১- যানবাহন ব্যবহারের ক্ষেত্রে (যেমন- গাড়ী, বাস, ট্রেন, জাহাজ, উড়োজাহাজ);
২- উন্মুক্ত স্থানে (গাড়ী রাখার স্থান, বাজার, সেতু);
৩- বদ্ধ স্থানে (দোকান, নাট্যশালা, চলচ্চিত্র);
৪- একা বাড়ির বাইরে থাকা।
♦ ব্যক্তি পরিস্থিতিকে ভয় বা এড়িয়ে চলার কারণ সে চিন্তা করে এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসা তার জন্য কঠিন হবে এবং যদি প্যানিক অ্যাটাক এর মত লক্ষণ বা অন্য কোন লক্ষণ প্রকাশ পায় যা তার পক্ষে সমাধান করা সম্ভব নয় বা কোন অপমানজনক বা বিপদজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় (যেমন- বয়স্কদের সম্মুখে ইতস্ততবোধ, মলমূত্র নিয়ন্ত্রণের ভয়)।
♦ এগোরাফোবিক পরিস্থিতিতে প্রায় সব সময় ভয় এবং উদ্বেগ থাকে।
♦ এগোরাফোবিক পরিস্থিতিতে সে দৃঢ়ভাবে এড়িয়ে চলে একজন সঙ্গীও যদি তার সাথে থাকে অথবা তীব্র ভয় বা উদ্বেগের অভিজ্ঞতা অর্জন হয় এইসব পরিস্থিতিতে।
♦ ভয় এবং উদ্বেগের বিষয়টি সত্যিকারভাবেই এগোরাফোবিক পরিস্থিতিতে হচ্ছে কিনা এবং সামাজিক সাংস্কৃতিক পটভূমির সাথে সম্পর্কিত কিনা তা বিবেচনা করতে হবে।
♦ এই ভয় উদ্বেগ বা দীর্ঘস্থায়ী এড়িয়ে চলা ছয় মাস বা তার বেশি সময় থাকতে পারে।
♦ এই ভয়, উদ্বেগ বা এড়িয়ে চলার কারণে চিকিৎসায় তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে তার সামাজিক, পেশাগত এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহারিক বিষয়ে বিঘ্ন বা সমস্যার সৃষ্টি হয়, সেজন্য তার চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।
♦ যদি অন্য ধরনের শারীরিক অসুস্থতা উপস্থিত থাকে (ইনফ্লামমেটরি বাওয়েল ডিজিজ, পারকিনসন্স ডিজিজ) সে ক্ষেত্রে ভয়, উদ্বেগ অথবা এড়িয়ে চলা আরো প্রকট আকারে দেখা দেয়।
গুরুতর এগোরাফোবিয়া আক্রান্ত রোগীরা সম্পুর্ণরূপে ঘরে থাকতে বাধ্য হয়ে পড়ে বা বাইরে বেরুতে অক্ষম হয়ে যায়। মৌলিক প্রয়োজনেও অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ডিমোরালিজেশন (আত্মবিশ্বাস, আশা হারানো) শিশুরা একা বাইরে যেতে ভয় পায়। বড় দোকানে কেনাকাটা করতে, লাইনে দাঁড়াতে অথা উন্মুক্ত স্থানে ভয় পেয়ে থাকে।
এগোরাফোবিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে তিন ভাগের দুই ভাগেরই ৩৫ বৎসরের আগেই লক্ষণ শুরু হয়ে যায়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কৈশরকাল এবং যৌবনকালে হয়ে থাকে। এবং দ্বিতীয় পর্যায়ের ক্ষেত্রে ঝুঁকি থাকে চল্লিশ বৎসর বয়সের পরে। প্রথম শুরুটা শৈশবকালে খুব কমই ঘটে। সাধারণত গড়ে সতের বৎসর বয়সে ঘটে থাকে তবে ২৫ থেকে ২৯ বৎসরের মধ্যে প্যানিক অ্যাটাক বা প্যানিক ডিজঅর্ডার ছাড়াও শুরু হতে পারে। চিকিৎসা না করলে এগোরাফোবিয়া কমই ভাল হতে দেখা যায় এবং গুরুতর আক্রান্তদের ক্ষেত্রে আবার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া মেজর ডিপ্রেসিভ ডিজঅর্ডার, ডিসথাইমিয়া এবং সাবস্টেন্স (মাদক) ব্যবহার জনিত রোগ হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
শিশুর শৈশবকালীন পরিবেশ এবং অভিজ্ঞতা তার পরবর্তী জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অশান্ত পারিবারিক পরিবেশ, অতিশাসন, মা-বাবার অতিরক্ষণশীল মনোভাব, তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ, শিশু লালন-পালনে উষ্ণতার অভাব, বংশগতি ইত্যাদি নানাবিধ উপাদানের কারণে তার মধ্যে যে নেতিবাচক অনুভূতি, দুঃখ-কষ্ট, ভয় তৈরি হলো তারই ফলশ্রুতিতে তা একদিন রূপ নিলো এগোরাফোবিয়া নামক অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডারে। আজ যে ভয় দেখিয়ে আমরা শিশুকে বাধ্য, ভদ্র, লাজুক শিশুতে পরিণত করছি। আগামীতে সেই ভয় তাকে মানসিকভাবে অসুস্থ শিশুতে পরিণত করবে।
ভয়, উদ্বেগ এবং দুঃশ্চিন্তাকে প্রাধান্য দিতে দিতে সে গৃহে অবরুদ্ধ হয়ে পড়তে পারে। বর্তমানে যারা এগোরাফোবিয়াতে ভুগছে তাদের চিকিৎসামুখী করা এবং প্রতিরোধে আমাদের সচেতনতা খুবই প্রয়োজন।
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।