কোভিড ১৯: চিকিৎসকদের কাজ নির্দিষ্ট কাঠামোতে আনতে হবে-অধ্যাপক ডা. ওয়াজিউল আলম চৌধুরী

0
60
কোভিড ১৯: চিকিৎসকদের কাজ নির্দিষ্ট কাঠামোতে আনতে হবে
কোভিড ১৯: চিকিৎসকদের কাজ নির্দিষ্ট কাঠামোতে আনতে হবে

দেশে করোনায় আক্রান্তের শতকরা ৭ ভাগই চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী। ফলে সম্ভবনা দেখা দিচ্ছে  চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মনোবল ভেঙে পড়ার। এরকম পরিস্থিতিতে  চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের কি ধরনের মানসিক সমস্যায় ভোগার সম্ভাবনা আছে? এ থেকে পরিত্রানের জন্য কি করা যেতে পারে? তাদেরকে এই মুহূর্তে মানসিকভাবে চাঙা রাখার জন্য কি করা যেতে পারে? সে সর্ম্পকে মনের খবর এর পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয় বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব সাইকিয়াট্রিস্ট (বিএপি) এর সভাপতি অধ্যাপক ডা. ওয়াজিউল আলম চৌধুরী এর কাছে।
খ্যাতনামা এই মনেরোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, “রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষণা করা হয়েছে যে সারাদেশ বর্তমানে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। প্রতিটি মানুষই এখন সন্দেহভাজনের তালিকায় রয়েছে। সর্বক্ষেত্রেই করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। তাই সব চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যেই এক ধরণের উদ্বেগ, ভয়, আশংকা কাজ করে। প্রাথমিকভাবে কাজে মনোযোগী হলে এই উদ্বেগের হার কমে যেতে পারে। তবে একটানা কাজ করলে এবং প্রয়োজনীয় শারীরিক ও মানসিক বিশ্রাম না পেলে হতাশার সৃষ্টি হতে পারে। আর দীর্ঘদিনের হতাশা থেকে ক্ষোভ সৃষ্টি হতে পারে। মেজাজ খারাপ বা খিটখিটে হয়ে যেতে পারে।
সবসময় নিজের মধ্যে সংক্রমণের একটা আশংকা বা ভয় কাজ করতে পারে। এর ফলে উদ্বেগের মাত্রা ক্রমশও বেড়ে যেতে পারে। উদ্বেগ ও হতাশা বৃদ্ধির ফলে অনেকেই মনোযোগ হারিয়ে ফেলতে পারে। অমনোযোগী হলে কাজের ক্ষেত্রেও ভূল হতে পারে।। তখন আবারও মেজাজ খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যসেবাকর্মীদের যে পেশা, এতে উৎকন্ঠা বা বিষন্নতায় ভোগা স্বাভাবিক বিষয়। মনের মধ্যে অস্থিরতা, উদ্বেগ, বিরক্তিভাব এবং বিষন্নতা তৈরি হতে পারে। দীর্ঘদিন কাজ করলে ভয় থেকে মানসিক দূর্বলতা হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।
করোনায় আক্রান্ত ৩০-৪০% মানুষের মধ্যে তেমন কোন উপসর্গ দেখা যায় না। যাদের পরীক্ষা করে করোনা আক্রান্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে তারা করোনার জন্য বিষেশায়িত হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। বাকি যারা রয়েছেন তারাও অসুস্থতার জন্য বিভিন্ন হাসপাতালে বা চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছেন। যারা বিষেশায়িত হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা দিচ্ছেন তাদের একধরণের শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি ও ব্যক্তিগত সুরক্ষা ব্যবস্থা একেবারেই আলাদা। কিন্তু এর বাইরে যারা শহর এবং গ্রামের বিভিন্ন হাসপাতালে যেসব সাধারন মানুষকে চিকিৎসা দিচ্ছেন, তাদের মধ্যে কেউ হয়তো করোনায় আক্রান্ত কিন্তু তাদের পরীক্ষা করা হয়নি। আবার প্রত্যেকেরই করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। তাই এসব ক্ষেত্রে যারা চিকিৎসা দিচ্ছেন, তাঁরা অনেক ঝুঁকি নিয়েই চিকিৎসা দিচ্ছেন।
চিকিৎসকরা বেসরকারীভাবে বা সরকারী নির্দেশ মেনে প্রথম থেকেই মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁরা বিশেষ কোন প্রনোদনার জন্য কাজ করছেন না। এখন নানারকম প্রনোদনা বা উৎসাহ-উদ্দীপনার কথা আসছে যা হয়তো শুরুর দিকে ছিলো না। আবার নানারকম বৈষম্যের কথা এবং চিকিৎসকদের সুরক্ষার কথাও অনেকবার এসেছে। অনেক ক্ষেত্রেই সুরক্ষাসামগ্রী ছাড়াই চিকিৎসকরা চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন। সব ধরনের বেসরকারী বা সরকারী হাসপাতালেই চিকিৎসা দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। সরকারী ও বেসরকারী হাসপাতালে দেখভালের বিষয়ের ক্ষেত্রে পার্থক্য থাকলেও সবার জন্যই ঝুঁকি রয়েছে।
যারা চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন, সকলক্ষেত্রেই তাদের কাজ কে একটি কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসা উচিৎ। তাদের জন্য একটি বিশেষ রুটিন ও পালাবদল করে কাজের ব্যবস্থা করা উচিৎ। সুতরাং সমগ্র দেশে কতজন সরকারী ও বেসরকারী চিকিৎসক আছেন, কতোজন আক্রান্ত এবং কতজন আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে, কতোজন রোগী অন্যান্য হাসপাতালগুলোতে রোজ আসছে এগুলো বিবেচনায় এনে একটা সেন্ট্রাল রোস্টারিং সিস্টেমের মধ্যে আসা খুব জরুরী হয়ে পড়েছে। কারণ কোন উপজেলাভিত্তিক হাসপাতালে যদি ৪/৫ জন চিকিৎসক একসাথে কাজ করেন, তখন কেউ যদি আক্রান্ত হোন বা কোন করোনা রোগীর সংস্পর্শে আসেন, তখন সবাইকেই কোয়ারেন্টাইনে যেতে হবে। ফলে হাসপাতালে কোন চিকিৎসক থাকবে না। এই বিষয়টি মাথায় রেখে একটা সেন্ট্রাল রোস্টারিং সিস্টেম তৈরী করতে হবে। কোন হাসপাতালে কতোজন চিকিৎসক আছেন, কতোজন কাজ করছেন তা অনুযায়ী পালাবদলের ব্যবস্থা চালু করতে হবে। এতে করে চিকিৎসকদের কাজে ক্লান্তি আসবে না, তাঁরা বিশ্রামের সময় পাবেন ও কিছুটা হলেও দুঃশ্চিন্তামুক্ত থাকতে পারবেন।
যারা কাজ করছেন তাদের নিজেদের ঝুঁকি তো আছেই, পরিবারের সদস্যরাও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। এই বিষয়টিও তাদের জন্য টেনশনের কারণ। কারণ নিজেরা যদি আক্রান্ত হয়, পরিবারের সদস্যরাও আক্রান্ত হবেন। এই অবস্থার কথা বিবেচনা করে যতটুকু সুরক্ষাব্যবস্থা বা প্রনোদনা দরকার, তা অবশ্যই দেওয়া উচিৎ। সেজন্য চিকিৎসকদের দ্বায়িত্ব খুব সূক্ষ্মভাবে ভাগ করে দেওয়া উচিৎ। অনেক দেশেই ভলান্টিয়ার ওয়ার্কের কথা বলা হচ্ছে অথাৎ যারা অবঃসরপ্রাপ্ত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যসেবাকর্মী তাদের এগিয়ে আসতে বলা হচ্ছে এবং যারা এখনোও কাজ শুরু করেনি তাদের কেউ পর্যাপ্ত ট্রেনিং দিয়ে ভলান্টিয়ারের সংখ্যা বাড়াতে হবে।
একটানা দীর্ঘদিন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করলে মানসিক চাপ বেড়ে যায়। তাই যারা কাজ করছে তাদের মানসিক চাপ যতটা কমিয়ে আনা যাবে, তাঁরা ততটা ভালো থাকবে। তাদের কাজের আগ্রহ থাকবে, শক্তি থাকবে। করোনা পরিস্থিতি কতোদিনের ব্যাপার তা অজানা। তাই চিকিৎসকদের ও স্বাস্থ্যসেবাকর্মীদের কর্মস্থলে কিভাবে সুস্থ রাখা যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তাদের ভালো খাবারের ব্যবস্থা, ভালো থাকার ব্যবস্থা, কাজের শেষে বিশ্রামের ব্যবস্থা, বিনোদোনের ব্যবস্থা এগুলো থাকা অনেক জরুরী। এতে হয়তো তাঁরাও প্রফুল্য থাকবে, কিছুটা নিশ্চয়তাবোধ করবে।“

Previous articleর্দীঘ লকডাউনে বেড়ে চলা দুশ্চিন্তা কমাতে করণীয়
Next articleকর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা ব্যক্তিত্বের ওপর প্রভাব ফেলে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here