আমি কেন কেউই জানেন না নভেল করোনা ভাইরাস কোভিড-১৯ থেকে কবে আমরা মুক্ত হবো ? কবে পৃথিবী আবার কর্মচঞ্চল হয়ে উঠবে, মানুষের মনে শান্তি বিরাজ করবে ?
আমি আজ যখন ঘুমিয়ে পড়েছি হঠাৎই আমার কলিজার টুকরা আমার মেয়ে আমার ঘুম ভাঙলো আর বলল, মা তোমার সাথে আমার কথা আছে । আমি বললাম, বল, সে বলল মা কিছুদিন থেকে দেখছি তুমি আর আমাকে আগের মতো আদর করো না, ভালোবাসো না , আমাকে জড়িয়ে ধরো না, তোমাকে ধরে ঘুমাতেও দাও না। আমি ওর কথাগুলো মন দিয়ে শুনলাম, অনুভূতি গুলোকে অনুভব করলাম।
ওকে বললাম, “মামনি এতে তুমি কষ্ট পেয়োনা”। আগে আমরা ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ গুলো আদর,জড়িয়ে ধরা, ধরে ঘুমানো এভাবে প্রকাশ করতাম। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমি যদি তোমাকে আগের মতো জড়িয়ে ধরে আদর করি, জড়িয়ে ধরে ঘুমাই তাহলে তোমাকে ভাবতে হবে তোমার মা তোমাকে ভালোবাসে না। আর যদি তোমার সাথে দূরত্ব রেখে চলি তাহলে ভাববে তোমার মা তোমাকে অনেক ভালোবাসে।
বর্তমান যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে তাতে আমাদের চিন্তা প্রক্রিয়া কে উল্টো করে অর্থাৎ নেতিবাচক ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ কে ইতিবাচক করে ভাবতে, মনের ভিতর তা মানিয়ে নিয়ে বাস্তবে অভ্যাসে পরিণত করা শিখতে হবে ।
আমি জানিনা আমার মেয়ের ছোট মস্তিষ্ক ও মন আমার এতো জটিল কথা গুলো বুঝতে পারলো কিনা? আমার কথা শেষে সে শুধু বলল, “মা তোমার ওড়না টা একটু দিবে?” আমি বললাম, “কেন?” সে বলল, “ওড়নাটাকে তুমি ভেবে বুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাবো”। আমি তাই করলাম আর দেখলাম মেয়ে আমার ওড়না তার বুকে জড়িয়ে ধরে রাগ নিয়ে বললো, “মা এই করোনা মরোনা যে কবে যাবে?” এর উত্তর আমার জানা নেই তাই চুপ করে রইলাম ।
এই কোভিড -১৯ পুরো পৃথিবীর মানুষকে ভাবাচ্ছে! মানুষের ভালোবাসার সংজ্ঞা কে বদলে দিচ্ছে! ভালোবাসার ইতিবাচক অনুভূতি গুলো, প্রকাশ গুলোকে এখন সাময়িক বিসর্জন দিয়ে আমাদের চিন্তা প্রক্রিয়ায় ভালোবাসার নেতিবাচক আচরণের বহিঃপ্রকাশকেই ইতিবাচক আচরণ মনে করে সময় কাটাতে হচ্ছে। এতে করে আমরা নিজেরা যেমন কষ্ট পাচ্ছি তেমন আমাদের সন্তান, পরিবারের বয়োঃজেষ্ঠ্য ও অন্যান্য সদস্যরাও কষ্ট পাচ্ছেন। নিজের মনের সাথে নিজের মানিয়ে নিতে খুব যন্ত্রণা হচ্ছে।
আমাদের কিছুই করার নেই কারণ কোভিড -১৯ এর কাছে আমরা বড়ই অসহায় ! কোভিড -১৯ জোড় করে মনের বিরুদ্ধে আমাদের হাত পা বেঁধে রাখতে বাধ্য করছে।
আমরা শিশুদের ছোট্ট ভেবে তাদের মনের দিকে নজর দিতে চাই না আমাদের সমস্ত মনোযোগ শুধু শিশুর শারীরিক বিকাশ নিয়ে । শিশুকে জোর করে ঠেসে ঠেসে বেশি বেশি খাবার খাইয়ে দিচ্ছি। বর্তমানে আমরা ঘর বন্ধি এখন আমাদের অগাধ সময়। সময় না দেয়া নিয়ে বর্তমানে আর কারো মনের ভিতরে কোনো দুঃখের সমুদ্র নেই, মনে জমিয়ে রাখা অভিমান নেই, মৌন অভিযোগ নেই, নেই কোনো এটম বোমা ফাটার শব্দ ।
তবুও কেন আমরা শিশুদের ছোট ছোট ভালো লাগার অনুভূতি গুলো কে বুঝতে চাইছি না ! তাদের ছোট ছোট আবদার গুলো কে ধমোকের শব্দে থামিয়ে দিচ্ছি ! মাঝেসাঝে কেন শিশুর শিশুসুলভ আচরণ গুলো কে বিরক্তিকর মনে হচ্ছে ! আমরা কেন শিশুর মানসিক দিকটার দিকে খেয়াল রাখার বিষয়ে এতোটা উদাসীন !
আমার অবচেতন স্তর থেকে উঠে আসা এই কেন প্রশ্ন গুলোর মধ্যে একটি কেন প্রশ্নকে নিয়ে কি আমি কখনো দাঁড়িয়েছি আমার আমি-র -কাছে ? বা আপনি আপনার নিজের আমি -র – কাছে ?
এই কোভিড -১৯ আমাদের শিশুদের বঞ্চিত করছে কাছ থেকে সেন্হ, আদর, ভালোবাসা, মায়ের গায়ের মিষ্টি গন্ধ, বাবার ঘামের মিষ্টি গন্ধ, কাজ শেষে বাড়িতে নিয়ে ফেরা বাবার ভালোবাসা মাখানো চকলেট থেকে। এগুলো কি শিশুর মস্তিষ্ক ও মনকে প্রভাবিত করছে না?
কোভিড -১৯ এর কারণে আমাদের হাতে সময় ব্যাপক বিস্তর। এই সময়ের ব্যাপক বিস্তরের কারণে আমরা আমাদের শিশুদের অন্য শিশুর সাথে তুলনা করার পরিমাণও বাড়িয়ে দিয়েছি । এই তুলনা করার বিষয়টি একটি শিশুর কাছে করলার মতো গিলতে খুব তিতা মনে হয়। এই বিষয়টি কি কখনো একবার ভেবে দেখার চেষ্টা করেছি ?
কোভিড -১৯ থেকে প্রাপ্ত এই সময় বিস্তর কি আশীর্বাদ? না কি প্রতি ঘরে ঘরে প্রতিটি মানুষের মনের গহীনে চেপে রাখা মৌন আর্তনাদ? যার বাহিরে আমাদের শিশুরাও নয় !
আসুন আমরা সবাই নিজে নিজের , নিজেদের পরিবারের সকল সদস্য , বয়োঃজেষ্ঠ্য , ও শিশুদের শারীরিক যত্নের পাশাপাশি একে অপরের মনের খবর রাখতে ও বুঝতে চেষ্টা করি। সবাই সবার মনোবল শক্ত করে ধরে রাখতে একে অপরের পাশে থাকি ।
লেখক : আয়শা আখতার বানু ফেনসী, সাইকোলজিসট, মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগ, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।