রোমান পরিভাষায় ‘কোয়ারেন্তেনা’ শব্দের অর্থ ‘৪০ দিন’। প্লেগ মহামারির সময় সংক্রমণ এড়াতে ইউরোপীয় দেশগুলিতে জাহাজ এবং জাহাজের মানুষদের ৪০ দিন নোঙর না করিয়ে আলাদা রাখা হত। সেখান থেকেই ‘কোয়ারেন্টাইন’ শব্দের উৎপত্তি। কী করা উচিত কোয়রান্টিনে থাকার সময়, জেনে নিন কিছুটা
প্রশ্ন: ‘কোয়ারেন্টাইন’ কী?
উত্তর: রোগ সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য সম্ভাব্য সংক্রামিত মানুষ বা অন্য কোনও প্রাণীকে আলাদা করে রাখাকে ‘কোয়রান্টিন’ বলা হয়। যখন কোনও ব্যক্তিকে বাড়িতে কোয়রান্টিন করা হয়, তাকে ‘হোম কোয়ারাণ্টিন’ বলে।
উত্তর: ‘আইসোলেশন’ বা বিচ্ছিন্নকরণ এবং ‘কোয়ারেন্টাইন’ একই নয়। যদিও দু’টি ক্ষেত্রেই মুখ্য উদ্দেশ্য সংক্রমণ প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণ।
এখানে উল্লেখ্য যে , কোয়ারেন্টাইন করা হয় সেই ব্যক্তিকে যাঁর এখনও রোগের উপসর্গ দেখা দেয়নি। অপর দিকে, রোগের নির্দিষ্ট উপসর্গ দেখা দিলে তবেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে আইসোলেশনে রাখা হয়। আইসোলেশনের ক্ষেত্রে যেহেতু আক্রান্ত ব্যাক্তির চিকিৎসাও জরুরি, তাই তা সাধারণত কোনও হাসপাতালে করা হয়। কোয়রান্টিনে ব্যক্তির রোগের উপসর্গ দেখা দিচ্ছে কি না তা পর্যবেক্ষণ করা হয় এবং তা বাড়ির লোকও করতে পারেন।
প্রশ্ন: কোন ক্ষেত্রে ‘কোয়ারেন্টাইন’ প্রয়োজন?
উত্তর: কোভিড-১৯ এর ক্ষেত্রে বলা যায়, যে অঞ্চলে রোগ ছড়িয়েছে এমন জায়গা থেকে ঘুরে আসলে অথবা রোগাক্রান্ত বা সম্ভাব্য সংক্রামিত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসলে বা আসার সম্ভাবনা থাকলে সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের কোয়রান্টিনে থাকা প্রয়োজন।
এ প্রসঙ্গে বলা দরকার, রোগাক্রান্ত বা সম্ভাব্য সংক্রামিত ব্যক্তির সঙ্গে একই বাড়িতে থেকেছেন, তাঁর মল-মূত্র-থুতু-কফ-হাঁচি-কাশি ইত্যাদির সংস্পর্শে এসেছেন বা অন্য কোনও ব্যবহৃত জিনিস যেমন থালাবাসন, জামাকাপড়, বিছানা ব্যবহার করেছেন বা সংক্রামিত ব্যক্তির এক মিটার বা তার কম দূরত্বে সহাবস্থান বা যাতায়াত করেছেন, এমন সকলেরই (যাঁদের চিকিৎসা পরিভাষায় ‘কন্ট্যাক্ট’ বলে) কোয়রান্টিনে থাকা দরকার। তা হাসপাতাল না ঘরে হবে, তা চিকিৎসক ঠিক করবেন।
প্রশ্ন: সাধারণত কোয়ারেন্টাইন সময়সীমা কত দিনের হয়? রোগভেদে তা কি বদলাতে পারে?
উত্তর: কোভিড-১৯ এর ক্ষেত্রে কোয়ারেন্টাইনের সময়সীমা ১৪ দিন। রোগভেদে এই সময়সীমা বদলায়। যেমন, ইবোলা ভাইরাসের কোয়ারেন্টাইন সময়সীমা ২১ দিন আবার পীতজ্বরের ক্ষেত্রে তা ছ‘দিন।
কোয়ারেন্টাইনের সময়সীমা তত দিনই হয়, যত দিন রোগজীবাণুর সংস্পর্শে আসার পর থেকে উপসর্গ দেখা দিতে সর্বোচ্চ যে সময় লাগে। একে বলা হয় রোগের উন্মেষ পর্ব বা ‘ইনকিউবেশন পিরিয়ড’।
প্রশ্ন: করোনার ক্ষেত্রে কোয়ারেন্টাইন কি সব সময়ে ১৪ দিনেরই হবে?
উত্তর: সাধারণত ১৪ দিনের হলেও বিশেষ ক্ষেত্রে তা পরিবর্তিত হতে পারে। সংক্রমিত অঞ্চল থেকে আসার পরে (যেখানে নির্দিষ্ট ‘কন্টাক্ট হিস্ট্রি’ নেই) বা নিশ্চিত কোভিড-১৯ সংক্রমণের ‘কন্টাক্ট’ হলে কোয়রান্টিন হবে ১৪ দিনের। দু’টি ক্ষেত্রেই কোয়ারেন্টাইনের সময়সীমা বাড়তে পারে, যদি এই সময়ে ব্যক্তিটি আবার নতুন করে কোনও করোনা সংক্রমিতের (নিশ্চিত বা সম্ভাব্য) সংস্পর্শে আসেন। সর্বশেষ সংস্পর্শের দিন থেকে আবার ১৪ দিন কোয়রান্টিনে থাকতে হবে।
সম্ভাব্য কোভিড-১৯ সংক্রমণের ‘কন্টাক্ট’ হলে কোয়ারেন্টাইন ১৪ দিনের আগেও শেষ হতে পারে, যদি ইতোমধ্যে পরীক্ষার মাধ্যমে জানা যায় যে, ‘ইন্ডেক্স কেস টী’ (যাঁর সংস্পর্শে আসার জন্য এই কোয়ারেন্টাইন), করোনায় সংক্রামিত নন।
প্রশ্ন: করোনার সংক্রমণের ক্ষেত্রে ‘হোম কোয়ারেন্টাইন’ গুরুত্বপূর্ণ কেন?
উত্তর: দেশে করোনার সংক্রমণ গোষ্ঠী স্তরে শুরুর মুখে বা হয়ত শুরু হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সম্ভাব্য ‘কন্টাক্ট’দের প্রত্যেকের কোয়ারেন্টাইন দরকার। পরস্পরের মাধ্যমে এখন সংক্রামিত ব্যক্তির সংখ্যা ফি দিনই উচ্চ হারে বাড়তে পারে। এঁদের বেশির ভাগের উপসর্গ নাও দেখা দিতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সংক্রমণ-শৃঙ্খলের এই ধারা আটকাতে না পারলে আগামী দু’সপ্তাহের মধ্যে দেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা অনেকটাই বেড়ে যাবে। রোগের সংক্রমণ যখন মহামারির রূপ নেয়, তখন কোয়ারেন্টাইন জন্য নির্দিষ্ট জায়গাগুলির অভাব দেখা দেয়। তাই হোম কোয়ারেন্টাইন দরকার হয়। তা ছাড়া, দেখা গিয়েছে হাসপাতালের কোয়ারেন্টাইনের তুলনায় হোম কোয়ারেন্টাইন মানসিক স্বাস্থ্য বেশি ভাল থাকে।
প্রশ্ন: ‘হোম কোয়ারেন্টাইন’-এর পরিবেশ কেমন হওয়া উচিত?
উত্তর: খোলামেলা, আলো-বাতাসযুক্ত ঘর হোম কোয়রান্টিনের জন্য উপযুক্ত। শৌচের ব্যবস্থা সঙ্গেই থাকা উচিত। একান্ত না থাকলে আলাদা শৌচালয়ের ব্যবস্থা করা দরকার, যা অন্য কেউ ব্যবহার করবেন না।
প্রশ্ন: ‘হোম কোয়ারেন্টাইন’-এ থাকা ব্যক্তির কী কী স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা আবশ্যক?
উত্তর: (১) ঘন ঘন সাবান বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধুতে হবে। (২) ঘুমনো, স্নান ও খাওয়ার সময় বাদে সারাক্ষণ মাস্ক পরে থাকতে হবে। সাধারণ ‘সার্জিক্যাল মাস্ক’ই যথেষ্ট। এন৯৫ মাস্কের প্রয়োজন নেই। (৩) কোনও অবস্থাতেই বাড়ির বাইরে বা কোনও জমায়েতে (যেমন-ক্লাব, বাজার, অনুষ্ঠানবাড়ি ইত্যাদি) যাওয়া চলবে না। বাড়িতে বয়স্ক ব্যক্তি, গর্ভবতী, ছোট বাচ্চা বা অন্য কোনও অসুস্থ ব্যক্তির কাছাকাছি যাওয়া নিষেধ।(৪) নিজেকে সুস্থ রাখতে ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা, নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখতে হবে। (৫) কোনও উপসর্গ (১০১ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা তার বেশি তাপমাত্রা, কাশি, গলা ব্যথা, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি) দেখা দিলে তৎক্ষণাৎ সংশ্লিষ্ট সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের আধিকারিক বা জাতীয় করোনা হেল্পলাইনে ফোন করা উচিত।
প্রশ্ন: ‘হোম কোয়ারেন্টাইন’-এ থাকা ব্যক্তির দেখভাল কি বাড়ির সদস্য করতে পারেন? করলে কী কী সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে?
উত্তর: নিম্নলিখিত শর্ত ও সাবধানতা অবলম্বন করে ‘হোম কোয়ারেন্টাইন’-এ থাকা ব্যক্তির দেখভাল বাড়ির সদস্য করতে পারেন-(১) শুধুমাত্র এক জন ব্যক্তিই পুরো ১৪ দিন দেখভাল করবেন।(২) কোনও বয়স্ক ব্যক্তি, গর্ভবতী বা অন্য কোনও অসুস্থ ব্যক্তি এই কাজের দায়িত্ব নিতে পারবেন না। (৩) কোয়ারেন্টাইন থাকা ব্যক্তির সঙ্গে একই ঘরে না থেকে পাশের ঘরে থাকলে ভাল। একই ঘরে থাকতে হলে অন্তত ২ মিটার দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। (৪) দেখভাল করা ব্যক্তি অবশ্যই ‘মাস্ক’ এবং ‘গ্লাভস’ ব্যবহার করবেন। (৫) প্রয়োজনীয় পরিচ্ছন্নতা মানতে হবে।
প্রশ্ন: ‘হোম কোয়ারেন্টাইন’-এ থাকা ব্যক্তির ঘর ও চারপাশ কী ভাবে পরিষ্কার রাখতে হবে?
উত্তর: (১) কোয়ারেন্টাইন থাকা ব্যক্তি যে মাস্ক ব্যবহার করবেন, তা পুনরায় ব্যবহার করা যাবে না। একটি মাস্ক ৮ ঘণ্টার বেশি ব্যবহার করা যাবে না অর্থাৎ প্রতি দিন অন্তত দু’টি মাস্ক ব্যবহার করতে হবে (গোসল, খাওয়া ও ঘুমনোর সময় বাদ দিয়ে)। ব্যবহার করা মাস্কগুলি প্রত্যেক দিন পুড়িয়ে ফেলতে হবে অথবা মাটির গভীরে পুঁতে দিতে হবে। তার আগে ওগুলিকে ব্লিচিং পাউডার মেশানো জল বা ১% হাইপোক্লোরাইট দ্রবণে ডুবিয়ে জীবাণুমুক্ত করে নিতে হবে। (২)কোয়ারেন্টাইন থাকা ব্যক্তির ঘরের মেঝে এবং বাথরুম প্রতি দিন ব্লিচিং পাউডার মেশানো জল বা ফেনলযুক্ত ‘বাথরুম ক্লিনার’ দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। (৩) কোয়ারেন্টাইন থাকা ব্যক্তির জামাকাপড়, বিছানাপত্র আলাদা ভাবে (বাড়ির অন্য লোকজনের জামাকাপড়ের সঙ্গে নয়) কাচাকুচি করতে হবে। সাধারণ ডিটারজেন্ট বা সাবান ব্যবহারই যথেষ্ট।
প্রশ্ন: বাড়ির অন্য সদস্যদের কী কী সাবধানতা নেওয়া দরকার?
উত্তর: (১) ৬৫ বা তার বেশি বয়সি মানুষ, গর্ভবতী, ছোট বাচ্চা বা অন্য কোনও অসুস্থ ব্যক্তি কোয়ারেন্টাইন থাকা ব্যক্তির সংস্পর্শে যাতে কোনও ভাবেই না আসে, তা নিশ্চিত করতে হবে। (২)এই সময়ে বাড়িতে কোনও অতিথি না আসাই বাঞ্ছনীয়। আসলেও রাত্রিবাস যেন না করেন। (৩) কোয়রান্টিনে থাকা ব্যাক্তির মানসিক অবসাদ, হতাশা, রাগ, অসহায়তা, অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। বাড়ির লোকেদের এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে যেন কোনও ভাবেই মানসিক দূরত্ব তৈরি না হয়।(৪) কোয়রান্টিনে থাকা ব্যক্তির কোনও উপসর্গ দেখা দিলে বাড়ির অন্য প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদেরও আলাদা আলাদা ভাবে হোম কোয়ারেন্টাইন থাকা শুরু করতে হবে।
প্রশ্ন: কোয়ারেন্টাইনপর্ব শেষ হওয়ার পরে কী করণীয়?
উত্তর: বিশেষ কিছু করণীয় নেই। তবে সাধারণ সাবধানতাগুলি অবলম্বন করা উচিত। আগেও যেমন বলেছি, সংক্রমণের কোনও লক্ষণ দেখা দিলে তৎক্ষণাৎ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যোগাযোগ করা উচিত। মাথায় রাখতে হবে, খুব ব্যতিক্রমী হলেও ১৪ দিন পার হওয়ার পরেও উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
প্রশ্ন: বিদেশ বা করোনা উপদ্রুত এলাকা থেকে কোনও ব্যক্তি বাড়ি এলে তাঁর এবং তাঁর পরিবারের কী করণীয়?
উত্তর: করোনা সংক্রমণের কোনও উপসর্গ থাকলে নির্দিষ্ট স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে স্বাস্থ্যপরীক্ষা করাতে হবে। কোনও উপসর্গ না থাকলে ১৪ দিন হোম কোয়রান্টিনে থাকতেই হবে। এই ১৪ দিনে কোনও উপসর্গ দেখা দিলে নির্দিষ্ট স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করাতে হবে আর বাড়ির অন্য ব্যক্তিদের হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে।
সব শেষে , আতঙ্ক নয়, সাবধানতা, একান্ত প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে না বেরিয়ে এবং অন্তত কিছু দিনের জন্য অন্যদের থেকে দূরত্ব বজায় রেখেই করোনার মোকাবিলা সম্ভব।
সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা