গল্প বলতে কে না পছন্দ করেন? মানুষ গল্প পড়তে কিংবা শুনতে যতটা না পছন্দ করে, তার চেয়ে বেশি পছন্দ করে গল্প বলতে। আমাদের প্রত্যেকেরই বলার মতো নিজস্ব অনেক গল্প আছে। ফেইসবুক আসার আগে আমরা সেসব গল্প মানুষের কাছে বলে বেড়াতাম, এখন সেটা হয়তো ফেইসবুকে পোস্ট দিয়ে জানিয়ে দিই। মানুষ সেটাতে হাসি, দুঃখ, ভালোবাসার প্রতিক্রিয়া জানিয়ে আমাদের বুঝিয়ে দেন তারা আমাদের গল্প পড়েছেন। বেশি বেশি মানুষ রিয়েক্ট দিলে আমাদের গল্প বলার স্পৃহা বেড়ে যায়। আমরা নিয়মিত গল্প পোস্ট দিতে শুরু করি। এটা করেছি জীবনে, ওটা করেছি, এর সঙ্গে পরিচয় হয়েছে, ওর সঙ্গে একদিন দেখা হয়েছে, এসব বলতে বলতে একসময় আমাদের গল্প ফুরিয়ে যায়। গল্প না থাকার দরুন আমরা একসময় গল্প বলা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হই।
কিন্তু সবার ক্ষেত্রেই বিষয়টি এক ধরনের নয়। এভাবে নিজের গল্প বলতে বলতে অনেকে কবি, লেখক, সাহিত্যিক, মোটিভেশনাল স্পিকার পরিচয়ে উপনীত হন। নিজের উপস্থিতিকে আরও উজ্জ্বল করে রাখতে অনেকেই মিথ্যা বলাও শুরু করেন। রংচং মাখিয়ে একটি সাধারণ ঘটনাকে মানুষের সামনে গল্প আকারে উপস্থাপনেই তাদের সন্তুষ্টি নিহিত থাকে। এভাবেই তারা তাদের পরিচয়কে টিকিয়ে রাখতে সচেষ্ট হন। কিন্তু কেউ যদি তার আত্মজীবনী বা অভিজ্ঞতামূলক গল্পগুলোর মধ্যে থাকা অসংগতি প্রমাণসহ মিথ্যা বলে জনসম্মুখে প্রকাশ করে দেয়, তাহলে কী হতে পারে?
একজন স্বাভাবিক মানুষ তার ভুল স্বীকার করে নেবে- এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু একজন মিথোম্যানিয়া রোগীর জন্য এটি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। সে চেষ্টা করবে, সে যা নয়, কিন্তু বলতে গিয়ে সে নিজেকে যেভাবে উপস্থাপন করেছে, সেটা সত্যি বলে প্রমাণ করতে। সে জন্য যতটা মিথ্যে ঘটনা বানিয়ে বলতে হয়, সে বলবে। যতগুলো চরিত্র সে তার সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছে, সবগুলোকেই সে জীবন্ত দেখানোর চেষ্টা করবে। সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে, মিথ্যেকে সত্য বলে প্রকাশ করতে গিয়ে তাকে যদি মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়, সে পিছপা হবে না। তবু সে তার মিথ্যেকে জয় করেই ছাড়তে চাইবে। শুধু নিজেকে না, সে এ জন্য অন্য কাউকে খুন করতেও দ্বিধাবোধ করবে না!
মিথোম্যানিয়া নিয়ে প্রথম আলোচনা হয় ১৮৯১ সালে এন্টন ডেলব্রোকের চিকিৎসা-সংক্রান্ত বইয়ে। এই রোগে আক্রান্ত লোকরা প্রয়োজনে কিংবা প্রয়োজন ছাড়াও মিথ্যা বলে। তারা তাদের অতীত, ইতিহাস নিয়ে মিথ্যে বলে। নিজেকে তারা সব সময় অন্যদের চেয়ে বড় দেখাতে পছন্দ করে এবং অন্যদের মূর্খ জ্ঞান করে থাকে। তারা তাদের মিথ্যে নিয়ে আত্মবিশ্বাসী থাকে।
এই মিথ্যে বলার পেছনে আরও কারণ আছে। অনেক সময় দেখা যায়, অনেক লোকের সাধারণ কথা তাদের বন্ধুরা খুব একটা পাত্তা দেয় না। সে জন্য অনেকেই একটি সময় বন্ধুহীন হয়ে পড়ে। কিংবা অনেকেই কোনো সম্পর্কে স্থির হতে পারে না। সম্পর্ক ভেঙে যায় কিংবা কাউকে পছন্দ হলেও তার সঙ্গে জড়াতেই পারে না। এটি চলতে চলতে এমন পর্যায়ে উপনীত হয় যে, সে তার অস্তিত্বের শঙ্কায় পড়ে যায়। তারপর নিজের অস্তিত্বকে বাঁচানোর তাড়না থেকেই সে মিথ্যের আশ্রয় নেয়। এভাবে মানুষ তার নিজেকে অন্যদের কাছে প্রমাণ করতে গিয়েই নিজেকে মিথোম্যানিয়ার দুয়ারে ঠেলে দেয়।
ধরা যাক, সে একদিন গল্পচ্ছলে জানাল, তার সঙ্গে একটি দুর্ধর্ষ ডাকাত দলের সম্পর্ক আছে। সে তাদের আস্তানা চিনে। সে মাঝে-মাঝেই সেখানে যায়, তাদের সঙ্গে চা-নাশতা, গল্প-গুজব করে আসে। অনেকেই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে অবিশ্বাসের সঙ্গে তার গল্প বিশ্বাস করে ফেলল। কেউ কেউ তার গল্পে দ্বিমত প্রকাশ করল। একজন তো বলেই বসল, আমিই না কাল তোকে তাদের আস্তানার কথা বললাম? তুই এর ভেতরে তাদের চিনলি কী করে? আবার চা-নাশতাও! সেই লোকটি কিন্তু আসলেই এত কিছু জানে না। সে কালই শুধু জেনেছে ডাকাতদলের আস্তানার কথা। কিন্তু আগ বাড়িয়ে কথা বলতে গিয়েই তো বিপদে পড়ল। এবার সে বলল, আরে ওটা তো এমনি না জানার নাটক ছিল। আমি জানতে চাইছিলাম তোর মুখ থেকে, তুই সত্যি সত্যি জানিস কি না! ঘটনা এখানেই শেষ হতে পারত। কিন্তু সেই লোকটি দমে যাওয়ার পাত্র নয়। নিজেকে সে কোনোভাবেই হারতে দেবে না। সে তাদের জানাবে, চল আমার সঙ্গে, ওদের আস্তানায় গিয়ে ওদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে চা-নাশতা করে আসি। সেই মিথোম্যানিয়া লোকটি কিংবা তার বন্ধুদের কপালে ডাকাতদের আস্তানায় গিয়ে কী ঘটবে কিংবা ঘটতে পারে, সেদিকে আমরা না যাই। তার চেয়ে বরং আমরা একটু জেনে রাখি, এই রোগটি নারীদের বেশি হয়। এর কারণও খুব স্পষ্ট। নারীদের ‘জানেন ভাবি…?’ দিয়ে তাদের মিথোম্যানিয়ার যাত্রা শুরু হয়। তারপর সেটা যদি এ ধরনের পরিস্থিতিতে চলে আসে, তাহলে কী ঘটতে পারে, সেটা তো আর অনুমেয় করা কঠিন কিছু নয়।
লেখক: আসিফ রহমান, সূত্র: দেশ রুপান্তর