লায়লা- মজনু’র কাহিনী জানেন তো সবাই? না জানলেও প্রেমের জন্য নিজের জীবন দিয়ে দিয়েছেন, এটা আমরা সবাই জানি। মূলত এটা আরব উপমহাদেশের কাহিনী.. যার কিছুটা সত্যতা আছে। পরবর্তীতে মধ্যযুগে লাইলী- মজনু কাব্যের মধ্য দিয়ে প্রচন্ড জনপ্রিয়তা পায় এই কাহিনী।
একই ভাবে আছে…রোমিও – জুলিয়েট,মার্ক এন্থোনি- ক্লিওপেট্রা, রামোস- থিইবী।এসব প্রেম কাহিনীর মূল থিম প্রেম এবং প্রেমের জন্য মৃত্যুবরণ অর্থাৎ আত্মহত্যা। প্রেম নিয়ে গল্প,উপন্যাস তো অনেক আছে,সব তো জনপ্রিয় হয় না। এসব উপন্যাস জনপ্রিয়তার কারণ.. বিশেষত গল্প -উপন্যাসের শেষ প্লটে নায়ক-নায়িকার প্রেমের কারণে “আত্মহত্যা” (বিয়োগান্তক প্রেম )। যুগে যুগে কিছু প্রেমকে মহিমান্বিত করা হয়ে গেল স্রেফ আত্মহত্যার কারনে।
১৭৭৪ সালে, গ্যোথের দ্য সরোজ অফ ইয়ং ওয়ার্থার ( The sorrow’s of young werthers) একটি উপন্যাস, যেখানে প্রেমের ব্যর্থতার কারণে নায়ক আত্মহত্যা করেছিলেন। পরে উপন্যাসটি অনেক ইউরোপীয় স্থানে নিষিদ্ধ হয়েছিল। কারণ এটি ইতালি, লাইপজিগ এবং কোপেনহেগেনের মতো জায়গায় আত্মহত্যার জন্য দায়ী হিসাবে বিবেচিত হয়েছিল।
এটাকে কপি ক্যাট (Copy cat) আত্মহত্যাও বলা যেতে পারে। যেখানে কোনো বিখ্যাত বা সাজেস্টিভ বা সেলিব্রেটির আত্মহত্যার খবরটি তরঙ্গের মতো ছড়িয়ে যায়,এবং মানব মনে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। এর আরও একটা বড় উদাহরন ছিলো বিখ্যাত চলচ্চিত্র তারকা মেরিলিন মনরো’র আত্মহত্যা। ১৯৬২ সালের আগস্টে তার আত্মহত্যার সময়, বা পর পর দেশব্যাপী আত্মহত্যার পরিমান অনেক বেড়ে গিয়েছিল।
তাছাড়া সোশ্যাল মিডিয়া,বর্তমানে সবচেয়ে বড় মিডিয়া…কি হচ্ছে না এখানে! কেউ একজন আত্মহত্যা করলো… এর পর থেকেই শুরু হয়ে যাবে প্রতিদিন এর আপডেট দেয়া। কিভাবে করেছে সুইসাইড, কি দিয়ে করেছে, কেন করেছে,বাপ-মা কি বলছে,পাশের বাড়ী কি বলে, পুলিশ কি বলছে তা পুংখানুপুংখ উপাখ্যান শুরু হয়ে যাবে। কেউ কেউ এক ডিগ্রী এগিয়ে। পারলে ঐ সময়ের ভিডিও আপলোড হয়ে যাবে, ভাইরাল হতে থাকবে।
এই যে এত কাহিনী,গল্প,উপন্যাস, কাহিনী,মুভি,মিডিয়ার রিপোর্ট…. এগুলোর ইমপ্যাক্ট কিভাবে পড়ে সাধারণ মানুষের ওপর? অথবা সবাই তো না, কেউ কেউ আত্মহত্যার বিষয়টি কেন ইমিটেট ( imitate) করে?
আজ শুধু এটা একটু দেখার চেষ্টা করি, আত্মহত্যায় মিডিয়ার প্রভাব আছে কি না? থাকলে কতটুকু?
বিভিন্ন স্টাডিতে দেখা গেছে….
✪ আত্মহত্যার ঝুঁকি যাদের আছে,এদের অনেকেই এমনভাবেই ভাবে…
যদি মেরিলিন মনরো / অথবা অন্য কোনো সেলিব্রিটি… তার সমস্ত খ্যাতি এবং ভাগ্য নিয়ে জীবনকে সহ্য করতে না পারে তবে আমার মত সাধারণরা “কেন করবে?”।
✪ গণমাধ্যমে আত্মহত্যার ঘটনার বিশদ বা ধারাবাহিক বিবরণঃ
সাধারণভাবে দেখা গেছে যে আত্মহত্যার গল্পের কভারেজ যত বেশি হবে, কিছু মানুষের তার কপি করার সম্ভাবনা তত বেশি হবে।
মিডিয়া কীভাবে আত্মহত্যার আচরণকে উস্কে দিতে পারে সে ব্যাপারে বড় কিছু প্রমান অতীতে আছে। যেমনঃ ওয়ার্থার এফেক্ট ( উপরে কারণ বর্নিত আছে), মেরিলিন মনরোর সুইসাইড ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে অনেক সময় আত্মহত্যার ব্যাপারটিকে অতিরঞ্জিত ভাবে উপস্থাপন করা হয়।
✪ হাইপোথিটিক্যালি, কিছু মানুষ, যেমন- খুব অল্প বয়স্ক, একাকীত্বে ভোগা, এবং কিছু বয়স্ক মানুষ ও উচ্চ আত্মহত্যার ঝুঁকির গ্রুপের মধ্যে পড়েন। তারা অন্যান্যদের তুলনায় প্রচারিত আত্মহত্যার গল্প/ কাহিনী গুলিতে বেশি রেসপন্স করতে পারে।
✪ আত্মহত্যার আচরণে মিডিয়ার প্রভাব সবচেয়ে বেশি সম্ভবত মনে হয় তখন ই যখন আত্মহত্যার কোনও পদ্ধতি নির্দিষ্ট করে বা বিশদভাবে উপস্থাপিত হয়। -অর্থাৎ নিহতের ছবি সহ বা বড় শিরোনামের ছবি সহ ডিটেইলিং…. স্পেশ্যালি সেলিব্রিটিদের আত্মহত্যার ব্যাপারে এটি বেশী দেখা যায়।
এখানেই অল্প বয়সী লোকেরা মিডিয়ার প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ । এবং এখানে আরেকটি বিষয় হ’ল মিডিয়া সেলিব্রিটি বা মডেল, বা গুরুত্বপূর্ণ কেও… যারা আত্মহত্যা করেছে…. এদের মধ্যে এবং সাধারণ মানুষ,যারা খবরটা জানছে…তাদের মধ্যে বয়স, লিঙ্গ এবং জাতীয়তার দিক থেকে যদি মিল থাকে,সেটাও একটা ইম্প্যাক্ট ফেলে।
✪ গণমাধ্যমে আত্মহত্যার উপস্থাপনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, সাধারণত মিডিয়া সাধারণ কারণগুলিকে হাইলাইট করে…যেমনঃ আর্থিক বিপর্যয়, সম্পর্ক জনিত বা পরীক্ষায় ব্যর্থতার মতো একক কারণ গুলোকে দায়ী করে। যেমনঃ
-শ্বশুর বাড়ির অত্যাচারিত হতে হতে আত্মহত্যা করলো,
-প্রেমিকের সাথে বিয়ে না হওয়ায়
-পরিক্ষায় ফেল করার পর
-স্ত্রীর সংগে ঝগড়া করে স্বামীর আত্মহত্যা
-শেয়ার বাজারে লক্ষ লক্ষ টাকা হারিয়ে আত্মহত্যা
উপরের সিনারিও গুলো কি পরিচিত মনে হচ্ছে? প্রায় সব সময়ই আমরা এভাবেই সংবাদ গুলো দেখি।এসব ক্ষেত্রে অনেক সময়ই মৃত্যুগুলোকে এসব কারন দেখিয়ে Emotive রূপ দেয়ার চেস্টা থাকে। অথচ, আত্মহত্যা বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই যে মানসিক অসুস্থতার কারনে হয়ে থাকে,এবং সবচেয়ে বড় কারনটা যে ডিপ্রেশন বা বিষন্নতা….. সেটা প্রায় সময়ই উপেক্ষা করা হয়।
✪ আত্মহত্যা সম্পর্কিত মিডিয়া প্রভাব- অনেক ক্ষেত্রেই সাধারণত সামাজিক শিক্ষার তত্ত্ব দিয়েও ব্যাখা দেয়া যায়। যেমন, একজন শিখেছে যে অস্থির লোকেরা বা কষ্টে থাকা মানুষরা আত্মহত্যার মাধ্যমে তাদের জীবনের সমস্যাগুলি সমাধান করে (উদাহরণস্বরূপ, বিবাহবিচ্ছেদ, টার্মিনাল ডিজিজ, অসম্মান)। তাই সমাজের মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তিরা আত্মহত্যার কাহিনী গুলোতে আপাতদৃষ্টিতে কষ্টে থাকা মানুষের আচরণের কপি করতে পারে।
✪আরেকটা ব্যাখ্যা হচ্ছে,আত্মহত্যার মূল থিম গল্পের/কাহিনীর বৈশিষ্ট্যগুলির সাথে পাঠক বা দর্শকদের মানসিক অবস্থা/মেজাজের বহিঃপ্রকাশ । যেমন-কোনো আত্মহত্যা জনিত ঘটনা/গল্প যখন প্রচারিত হয় তখন সামাজিক অস্থিরতা /অস্থিতিশীলতাও হয়তো চরমে (উদাহরণস্বরূপ-উচ্চ বেকারত্ব, উচ্চ বিবাহবিচ্ছেদের হার,আইনের ব্যবহার না হওয়া ইত্যাদি)। এক্ষেত্রে ও একটি কপিক্যাট প্রভাব পড়তে পারে।
এ তো গেলো মিডিয়ার প্রভাব। এখন প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই আসবে “তাহলে মিডিয়ার কোনো দ্বায়িত্ব আছে কি না,আত্মহত্যা প্রতিরোধে”। লেখা অনেক বড় হয়ে যাচ্ছে তাই আত্মহত্যা প্রতিরোধে Media Reporting এর ব্যাপারে শুধু WHO কর্তৃক নির্দেশনা গুলোর গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো উল্লেখ করবো।
মিডিয়ার দায়িত্বঃ
➤দায়িত্বশীল প্রতিবেদন আত্মহত্যা সম্পর্কে জনসাধারনের মধ্যে অনেক ভুল ধারণা এবং কল্পকাহিনী প্রচলিত। এগুলো দূর করতে মিডিয়া ভূমিকা নিতে পারে।যেমন- আত্মহত্যা কখনই একটি ফ্যাক্টর বা ঘটনার পরিণতি নয়। ব্যাপারটা জটিল, এবং অনেক ফ্যাক্টর বা ইভেন্ট এখানে কাজ করে।
মানসিক অসুস্থতা আত্মহত্যার সবচেয়ে বড় কারন। এছাড়াও অতিরিক্ত আবেগ তাড়িত হওয়াটাও একটা কারণ। মিডিয়া এসব ব্যাপারে হাইলাইট করতে পারে।
➤এমন ভাষা এড়িয়ে চলতে হবে, যা আত্মহত্যা ব্যাপারটিকে কোনো সমস্যার সমাধান হিসাবে উপস্থাপন করে জনগণের সামনে।
➤সুইসাইডের সংবাদ প্রকাশে সংবাদপত্রে গুরুত্বপূর্ণ স্থান নির্ধারণ এবং গল্পের অযৌক্তিক পুনরাবৃত্তি এড়ানো।
অর্থাৎ আত্মহত্যা সম্পর্কিত সংবাদপত্রের গল্পগুলি আদর্শভাবে হওয়া উচিত পৃষ্ঠার নীচের দিকে, ভিতরে পৃষ্ঠাগুলিতে।
একইভাবে সম্প্রচার মিডিয়াতে দ্বিতীয় বা তৃতীয় বিরতিতে আত্মহত্যা সম্পর্কিত খবর উপস্থাপন করা উচিত।
➤সুইসাইডের সম্পূর্ন বিবরণ,কি পদ্ধতিতে করেছে এটা বলা থেকে বিরত থাকতে হবে।
➤আত্মহত্যা করার স্থান সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সরবরাহ করা এড়িয়ে চলতে হবে,কারন কখনও কখনও কোনও অবস্থান একটি ‘আত্মঘাতী সাইট’ হিসাবে খ্যাতি বিকাশ করতে পারে
– যেমন, একটি সেতু, একটি উঁচু বিল্ডিং, একটি খাড়া বা রেল স্টেশন বা ক্রসিং ইত্যাদি।
➤আত্মহত্যাকালীন ফটোগ্রাফ বা ভিডিও ফুটেজ ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
➤সেলিব্রিটি আত্মহত্যা রিপোর্ট করার ক্ষেত্রে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে,কারন-
-সেলিব্রিটি আত্মহত্যাগুলি স্পষ্টতই সংবাদযোগ্য, এবং সেগুলি রিপোর্ট করা জনস্বার্থে প্রায়শই বিবেচিত। তবে, এর রিপোর্ট দূর্বল ব্যক্তিদের আচরণকে প্রভাবিত করতে পারে।
কোনও সেলিব্রিটির আত্মহত্যার রিপোর্টকে মহিমান্বিত (glorify) রূপ দেওয়া অজান্তেই এই সংকেত দিতে পারে যে, সমাজ আত্মঘাতী আচরণকে সম্মান করে এবং এভাবেই আত্মঘাতী আচরণকে প্রচার করতে পারে অন্যদের। এই কারণে, প্রতিবেদন করার সময় বিশেষ যত্ন নেওয়া উচিত।
➤আত্মহত্যার কারণে শোকাহত পরিবারের মানুষের প্রতি যথাযথ বিবেচনা প্রদর্শন করতে হবে।কারন প্রিয়জনের আত্মহত্যার ফলে পরিবারের শোকগ্রস্ত সদস্যের ও ঝুঁকি থেকে যায়।
তাদের গোপনীয়তা বজায় রাখা উচিত। এবং কোথায় সহায়তা চাইতে হবে সে সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করতে হবে। …..বোঝা গেলো, বেশ ভালোই দ্বায়িত্ব আছে মিডিয়ার। জানিনা, বাংলাদেশের প্রিন্ট – অডিও ভিজুয়াল মিডিয়া কি ভূমিকা রাখছে আত্মহত্যা প্রতিরোধে!
একটি আত্মহত্যা শুধু আত্মহত্যাকারীর নিজের মৃত্যুই নয়… সে সাথে করে তার প্রিয়জন দের আত্মাটাও শেষ করে দিয়ে যায়,ওরা বেঁচে থাকে জীবন্মৃত হয়ে। নিজের জীবন নিজেই শেষ করে সমাধানের চেস্টা নয়… সমস্যা মোকাবিলা করেই সমাধানের চেস্টা করতে হবে।
আপনার প্রিয়জন ডিস্টার্বড? খুব irritable? জিজ্ঞেস করুন,কথা বলুন।সে কি বিষন্নতায় ভুগছে কি না, নাকি নেশায় আক্রান্ত, না অন্য কিছু… সেটা বোঝার চেস্টা করুন।প্রয়োজনে সাইকিয়াট্রিস্ট এর হেল্প নিন।
মনের ডাক্তারের কাছে যাওয়া মানেই আপনি পাগল… তা কিন্তু না।এর মানে আপনি সচেতন।কারন আপনার মনটা ভালো থাকলেই… দিন শেষে আপনি প্রশান্তিতে থাকবেন।