বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস, ২০১৯: মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়ন ও আত্মহত্যা প্রতিরোধ

আজ ১০ অক্টোবর, বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। “মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়ন ও আত্মহত্যা প্রতিরোধ” এই স্লোগানকে সামনে রেখে সারা বিশ্বের মত বাংলাদেশেও নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পালিত হচ্ছে আজকের দিনটি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, মানসিক স্বাস্থ্য বলতে সুস্থতার এমন একটি অবস্থা বোঝায় যখন একজন মানুষ তার সক্ষমতাকে বুঝতে পারে, যাপিত জীবনের চাপকে সামলাতে পারে, উৎপাদনমুখী ও ফলপ্রসূ কাজ করতে পারে এবং তার সম্প্রদায়ে কার্যকরী অবদান রাখতে সক্ষম হয়। মানুষ যখন মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়, নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রন করতে ব্যার্থ হয়, তখনি আত্মহত্যার মত দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা তৈরি হয়।
মানব ইতিহাসের শুরু থেকেই আত্মহত্যা ছিলো, তবে বেশ কিছু জটিল বৈশ্বিক কারণে পৃথিবীর সকল প্রান্তে এটি দিন দিন বেড়েই চলেছে এবং গত কয়েক দশকে তা ভীতিকর পরিসংখ্যানে গিয়ে ঠেকেছে। তাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আত্মহত্যার মত অতি গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু উপেক্ষিত বিষয়কে এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় করেছে, যাতে মানুষ এ বিষয়ে আর সতর্ক হতে পারে এবং সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে একে প্রতিহত করতে পারে।

আত্মহত্যা হচ্ছে নিজেকে নিজে হত্যা করা অথবা ইচ্চছাকৃতভাবে পরিণতির কথা জেনে যেকোন ঝুঁকিপূর্ণ কাজের মাধ্যমে নিজের মৃত্যু নিশ্চিত করা। আত্মহত্যা সাধারণত দুই ধরনের, নির্ধারিত বা পরিকল্পিত, যা সাধারণত বিষণ্ণতা ও অন্যান্য মানসিক রোগের কারণে হয়ে থাকে। আত্মহত্যার আরেকটি ধরন হচ্ছে ইমপালসিভ বা হঠকারী আত্মহত্যা। এটা সাধারণত আন্তব্যক্তিক সম্পর্কের টানাপড়েন ও মাদকাসক্তি থেকে হয়ে থাকে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পৃথিবীতে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন, এবং সে হিসেবে প্রতিবছর প্রায় আট লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে। তরুণরা হচ্ছে আগামীর ভবিষ্যৎ, কিন্তু উদ্বেগজনক তথ্য হচ্ছে, ১৫-২৯ বছর বয়সীদের মধ্যে মৃত্যুর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কারণ আত্মহত্যা। বিভিন্ন গবেষকের প্রাপ্ত উপাত্ত মতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর ১০ হাজার মানুষ আত্মহত্যার শিকার। সে হিসাবে প্রতিদিন প্রায় ২৮ জন। প্রচলিত ধারনা অনুযায়ী, আত্মহত্যা শুধু বড়রাই করে থাকে, কিন্তু এখন আমাদের জানা উচিৎ অনেক শিশু কিশোররাও আত্মহত্যা করতে পারে, যার অন্যতম কারণ সহিংসতা, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন, বুলিং ও সাইবার বুলিং ইত্যাদি। আমরা কেউই আত্মহত্যার ঝুঁকির বাইরে নই, পৃথিবীর যেকোন প্রান্তের, যেকোন মানুষ, যেকোন সময় আত্মহত্যার মাধ্যমে নিজেকে শেষ করে দিতে পারে।
আশার কথা হচ্ছে, আত্মহত্যা প্রতিরোধযোগ্য। যেকোন জিনিস প্রতিরোধ করতে গেলে, সেটা সম্পর্কে বিস্তারিত  জানা জরুরি। তেমনি আত্মহত্যা সম্পর্কেও অতি জরুরি কিছু তথ্য জানতে হবে। প্রতি একটি সফল আত্মহত্যার বিপরীতে ৩০ টিরও বেশি নিজেকে জখম/ক্ষতি করার বা আত্মহত্যার চেষ্টার ঘটনা ঘটে থাকে। বিষণ্ণতা, মাদকাসক্ত ও অন্যান্য মানসিক রোগে আক্রান্তরা এরকম বেশি করে এবং তাদের মধ্যে আত্মহত্যা করার হার সাধারণের থেকে ৬০ থেকে ১০০ গুন বেশি থাকে।
বেশিরভাগ সফল আত্মহত্যাই পুর্বপরিকল্পিত। প্রায় ক্ষেত্রেই সতর্কতা অবলম্বন করা হয়, যেমন- এমন কোন নির্জন জায়গা অথবা এমন সময় নির্বাচন করা হয়, যখন অন্য কেউ যেনো সেখানে না থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আত্মহত্যার সতর্ক সংকেত দিয়ে থাকে। গবেষণায় দেখা যায়, যারা আত্মহত্যায় জীবনহানি ঘটান, তাদের দুই তৃতীয়াংশ কোন না কোন ভাবে আত্মহত্যার ইচ্ছা পোশন করে থাকে এবং এক তৃতীয়াংশ পরিষ্কারভাবেই তা করে থাকে। প্রায় এই সতর্ক সংকেত একের অধিক ব্যক্তির কাছে দিয়ে থাকেন। গবেষণার তথ্যমতে, শতকরা ৪০ ভাগের বেশি মানুষ যারা আত্মহত্যায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, তারা আত্মহত্যার পূর্বের সপ্তাহে কোন না কোন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন এবং শতকরা ২৫-২৯ ভাগ মানসিক রোগের চিকিৎসা নিয়ে থাকেন।
আত্মহত্যার চেষ্টা নারীরা বেশি করলেও, সফল আত্মহত্যার হার নারীদের থেকে পুরুষের তিনগুন বেশি। বিবাহিতদের থেকে অবিবাহিতদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি এবং তালাকপ্রাপ্ত ও বিধবাদের মধ্যে এ হার বাড়তে থাকে। এছাড়া বেকারদের মধ্যে আত্মহত্যার হার খুবই উচ্চ।
যারা বিভিন্ন মানসিক রোগে আক্রান্ত তাদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি থাকে, যেমন—বিষণ্ণতা, বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার, সিজোফ্রেনিয়া, পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার, মাদকাসক্ত, উদ্বেগে আক্রান্ত ইত্যাদি রোগীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার উচ্চ। গবেষণায় দেখা গেছে, পরিপূর্ন আত্মহত্যার  ৩৬-৯০% এর ক্ষেত্রে বিষণ্ণতা, ৪৩-৫৪% এর ক্ষেত্রে মদ আসক্তি বা অপব্যবহার এবং ৪-৪৫% এর ক্ষেত্রে অন্যান্য মাদকাসক্তি দায়ী।
একটি আত্মহত্যা শুধুমাত্র একটি জীবনের অবসান নয়, একটি আত্মহত্যায় একটি পরিবারের অনেক আশা ভরসার সমাপ্তি ঘটা, কোন কোন ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ভাবে পঙ্গু হয়ে যাওয়া, পরিবারের অন্য সদস্যদেরও দীর্ঘমেয়াদি মানসিক অবসাদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, রাষ্ট্র হারায় তার মূল্যবান মানব সম্পদ। তাই আমদেরকে আত্মহত্যা প্রতিরোধে সচেতন হতে হবে, জীবনের বিরূপ পরিস্থিতিতে মানসিক শক্তিকে কিভাবে কাজে লাগাতে হবে তার প্রায়োগিক শিক্ষা দিতে হবে। যারা আত্মহত্যার ঝুঁকিতে থাকবে, তাদের যখন সাপোর্ট দরকার, তখন তারা কোথায়, কিভাবে তা পাবে সেটা নিশ্চিত করতে হবে। পরিবার, স্কুল-কলেজ, ভার্সিটি, কর্মক্ষেত্র এবং চিকিৎসাক্ষেত্র, সকল ক্ষেত্রে এ বিষয়ে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে হবে।
পরিশেষে কিছু উপদেশ দিয়ে শেষ করতে চাই, যেগুলো আত্মহত্যার বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করবে। ইতিবাচক চিন্তা করুন, বিবাহ, সন্তান ও ভালোবাসাপূর্ণ পারিবারিক সম্পর্ক বজায় রাখুন, জোরদার সামাজিক সম্পর্ক তৈরি করুন, নিজ পেশায় বা কাজে নিয়োজিত থাকুন, নিজের সামাজিক অবস্থান নিয়ে সন্তুষ্ট থাকুন। এগুলোই আত্মহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক হিসেবে কাজ করবে বেশি।
 
সুস্থ্য থাকুন, সুস্থ্য বাঁচুন।

Previous articleবিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস আজ
Next articleআত্মহত্যা এবং মিডিয়া
ডা. মেজবাউল খাঁন ফরহাদ
সহকারি অধ্যাপক, মনোরোগ বিভাগ, ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ।

2 COMMENTS

  1. বেশ তথ্য সমৃদ্ধ সুন্দর লেখা। আশা করি সংশ্লিষ্ট প্রান গুলো আলোর পথ খুঁজে নেবে। ভালো থাকুক প্রতিটি আত্মা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here