একজন মানুষের জীবনে বয়ঃসন্ধি পর্যায়ের শুরুতে তার শরীর, মন (আবেগ-অনুভূতি), দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ, বুদ্ধি এবং সম্পর্কের ক্ষেত্রে বহু পরিবর্তন ঘটতে দেখা যায়। এসব পরিবর্তনের সঙ্গে নিজের সম্পর্কে কিশোর-কিশোরীদের ধারণা, অভিভাবক, পরিবারের সদস্য ও প্রিয়জনদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক, অভিভাবক এবং শিক্ষকদের কাছে থেকে আসা লেখাপড়ার চাপ এবং মিডিয়ার প্রভাব তাদের মানসিক সুস্থতার উপর পড়ে। নীচে এমন কয়েকটি মানসিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হল যা একজন অল্পবয়সি মেয়ে বা কিশোরীর মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও প্রভাব বিস্তার করে।
দুর্বল বা ঠুনকো আত্মবিশ্বাস: একজন বয়ঃসন্ধির মেয়ের আত্মবিশ্বাস, আত্মনির্ভরতা বা মানসিক সুস্থতা প্রায়শই তার দৈহিক গড়ন বা বাহ্যিক গঠন অথবা প্রিয়জন বা বন্ধুদের চোখে তাকে কেমন দেখতে তার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই বয়সের মেয়েদের আত্মবিশ্বাস বাড়া বা কমার পিছনে নানারকম কারণ রয়েছে, যেমন- তাদের দৈহিক বিকাশ, হরমোনের পরিবর্তন, কাছের মানুষজনের সঙ্গে পারস্পরিক আদানপ্রদান এমনকী, অভিভাবক এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কর্তৃত্বস্থানীয় মানুষের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক প্রভৃতি। দৈহিক ওজন এবং বাহ্যিক গঠনের জন্য এই বয়সের মেয়েদের আত্মনির্ভরতা তলানিতে পৌঁছতে পারে। আর এই সমস্যা যদি ঠিক সময়ে চিহ্নিত করা না যায় তাহলে তার থেকে মানসিক বা অনুভূতিগত বিপর্যয় ঘটতে পারে।
লেখাপড়া এবং ক্যারিয়ার নিয়ে গভীর চিন্তা বা উদ্বিগ্নতা: লেখাপড়ার কৃতিত্ব একজন বয়ঃসন্ধির মেয়ের নিজের পরিচয় গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। পড়াশোনার অত্যধিক চাপ বা এ বিষয়ে নিজের, অভিভাবক বা শিক্ষকদের পাহাড়প্রমাণ প্রত্যাশা তাদের মানসিক সুস্থতার উপর প্রভাব ফেলে। যদি কোনও মেয়ে পড়াশোনায় খুব ভালো হয় তাহলে চাপ ও প্রত্যাশার জেরে সে দিশাহারা বোধ করতে পারে। এর ফলে তার মধ্যে মানসিক উদ্বেগও জন্মাতে পারে। আর যদি কোনও মেয়ে লেখাপড়ায় তেমন ভালো না হয় তাহলে তার মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার বোধ এবং নিজের ও কেরিয়ার সম্পর্কে অনিশ্চয়তা দেখা দিতে পারে।
লিঙ্গ এবং যৌন সত্ত্বাকে ঘিরে অস্পষ্টতা: যৌন-পরিচয়কে কেন্দ্র করে মানুষের মনে নিজস্ব সত্ত্বার ধারণা গড়ে ওঠে। যদি কারোর মধ্যে নিজের যৌন সত্ত্বা নিয়ে সন্দেহ জন্মায় তাহলে তাদের আত্মবিশ্বাসে প্রবলভাবে চিড় ধরতে পারে। কাউন্সেলরদের মতে এই জন্য একজন মেয়ের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাও জন্মায়। মেয়েটির মধ্যে নিজের লিঙ্গ এবং যৌন সত্ত্বা নিয়ে ধন্ধ থাকার ফলে সে ক্রমশ পিছিয়ে পড়তে থাকে। সেই সঙ্গে এই বিষয়ে ইন্টারনেট পড়ার ঝোঁক তাদের মধ্যে বাড়তে থাকে। এই পরিস্থিতি মেয়েটির বাবা মেনে নিতে পারেন না এবং এই ঘটনাকে তিনি অস্বাভাবিক বলে মনে করতে শুরু করেন। তাই বয়ঃসন্ধির মেয়েদের নিজেদের নিয়ে স্বস্তিতে থাকা এবং নিজের মতো করে নিজেকে মেনে নেওয়া একান্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
প্রয়োজন স্বাধীনতা, নিজের মতো থাকা এবং আত্মপরিচয়ের বিকাশ: বয়ঃসন্ধির মেয়েরা যদি স্বাধীনতা পায় তাহলে নিজেদের চেনা-জানা ও বোঝার ক্ষেত্রে তারা অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ থাকতে পারে। যখন অভিভাবকরা নিজেদের চিন্তাভাবনা, মূল্যবোধ, মতামত জোর করে বয়ঃসন্ধির ছেলে-মেয়েদের উপর চাপিয়ে দেয় তখন সন্তানরা তাদের কাছে থেকে ক্রমশ দূরে সরে যেতে থাকে এবং তারা নিজেরাও ক্রমশ পিছিয়ে পড়তে শুরু করে। এ কারণে সন্তানদের বয়ঃসন্ধির কালকে অভিভাবকদের গুরুত্ব সহকারে সম্মান জানানো একান্ত জরুরি।
পারস্পরিক সম্পর্কের বদল: বয়ঃসন্ধির মেয়েরা তাদের জীবনের পারস্পরিক সম্পর্কগুলোকে, বিশেষ করে প্রিয়জনের সঙ্গে সম্পর্ককে খুবই মূল্য দেয়। এই বিষয়টা একজন বয়ঃসন্ধির মেয়ের জীবনে লক্ষ্য বা শপথ গড়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। রানি মৌমাছি বা স্ত্রী মৌমাছিদের সঙ্গে এই ধারণার মিল রয়েছে। বয়ঃসন্ধির মেয়েদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠার নেশা অভিভাবকদের চোখে প্রায়শই ধরা পড়ে না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় একটা মেয়ে তার ঘরে ঢুকতে যাচ্ছে এবং সেই ঘরে তখন অন্য একটা মেয়ে তাকে নিয়ে কথা বলছে। এর ফলে যে মেয়েটিকে নিয়ে কথা হচ্ছে সে ভাবতে পারে যে সে বোধহয় অন্যদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। বয়ঃসন্ধির মেয়েদের জীবনে এই জনপ্রিয়তার বিষয়টা নির্ভর করে কোনও পার্টিতে নিমন্ত্রিত হওয়া, গোপন কথা আদানপ্রদান করা প্রভৃতির উপর। স্ত্রী বা রানি মৌমাছিদের সঙ্গে এই ধারণাটার মিল হল যে কোনও কৈশোর বয়সের মেয়ে যদি দলবদ্ধ হয়ে থাকে তাহলে সে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ এবং জনপ্রিয়তা অর্জন করতে চায়। তবে বাস্তবে স্ত্রী বা রানি মৌমাছিদের মধ্যে নিজস্ব একধরনের নিরাপত্তাহীনতা থাকে। তাই বয়ঃসন্ধিকালের একজন মেয়ের নিরাপত্তার সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য দরকার হয় অন্যান্য মেয়েদের সাহচার্য।
সাংস্কৃতিক বা সামাজিক প্রথা ও প্রত্যাশাগুলোকে ঘিরে থাকা অনমনীয় মনোভাব: অনেকসময়ে সাংস্কৃতিক বা সামাজিক আচার, প্রথা বয়ঃসন্ধির মেয়েদের মনে চাপ এবং উদ্বেগ সৃষ্টির কারণ হয়। আর এর ফলে তাদের মধ্যে নানারকম বদল ঘটতে পারে। সাধারণত একটা মেয়ে যখন বয়ঃসন্ধির দিকে পা বাড়ায় তখন নানারকম সামাজিক কারণে তার চারদিকে অতিরিক্ত পরিমাণে রক্ষাকবচের ব্যবস্থা করা হয় এবং তার হাঁটাচলা, জামাকাপড় বা আচার-আচরণের উপর বহু নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়ে থাকে। এই ধরনের সামাজিক বা সাংস্কৃতিক বিষয়গুলো ছেলে-মেয়ের মধ্যে ব্যবধান বাড়াতেও সাহায্য করে। এই পরিস্থিতিতে একজন বয়ঃসন্ধির মেয়ের জীবনে ঘটতে থাকা বদলগুলো অভিভাবকদের কাছে খোলাখুলি বলার ক্ষেত্রেও অনেক প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়। যদিও এই পরিস্থিতিতে একান্ত জরুরি হল মেয়েদের মনের কথা, আবেগ-অনুভূতি অভিভাবকদের সঙ্গে আদান-প্রদান করা।