ইনসুলিন কোমাথেরাপি

0
120

অনেকেই নিশ্চয় অস্কারজয়ী চলচ্চিত্র A Beautiful Mind ছবিটি দেখেছেন। অন্তত নাম শুনেছেন। সে ছবিতে রাসেল ক্রো প্রখ্যাত গণিতজ্ঞ নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. জন ন্যাশের নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন। সিজোফ্রেনিয়ার আক্রান্ত অসম্ভব মেধাবী একজন মানুেষর বায়োপিক এই ছবিটি। এই ছবিতে সিজোফ্রেনিয়ার তৎকালীন চিকিৎসা-পদ্ধতির চিত্রটি আমরা ভালোভাবে দেখতে পাই; যেখানে দেখানো হয় ড. ন্যাশরূপী রাসেল ক্রোকে হাসপাতালের বিছানায় শুইয়ে হাত-পা বেঁধে দেয়া হয়। তারপর তার বাহুতে একটি ইনজেকশন দেয়া হয়। চারপাশে ঘিরে থাকে ডাক্তার, নার্স ও অন্য স্টাফদের একটি দল। রোগীর নেতিয়ে পড়তে পড়তে একসময় শুরু হয় তীব্র খিঁচুনি। পরে অন্যান্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করে রোগী। এই চিকিৎসা পদ্ধতির নামই ইনসুিলন কোমা থেরাপি। আমাদের আজকের আলোচনা এটি ঘিরেই।
আবিষ্কার
অস্ট্রিয়ার তরুণ চিকিৎসক ডা. মেনফ্রেড স্যাকেল। ১৯২৫ সালে ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানে স্নাতক হওয়ার পর বার্লিনে যান উচ্চতর ডিগ্রির জন্য, ফিরে আসেন দুই বছর পর। ১৯২৭ সনে পুনরায় ভিয়েনাতে ফিরে এসে পুরোদমে প্র্যাকটিস শুরু করেন। তখন ঘটনাক্রমে একজন ডায়াবেটিক মানসিক রোগীকে ভলুক্রমে বেশি ডোজের ইনসুিলন প্রয়োগ করে দেখতে পান তার মানসিক উত্তেজনা অনেকটা কমে এসেছে। এই পর্যবেক্ষণ তাকে অনুসন্ধিৎসু করে তোলে। তিনি এরপর যেসব মানসিক রোগীর ডায়বেটিস নেই তাদেরকেও বেশি ডোজের ইনসুিলন দিয়ে পর্যবেক্ষণ করেন এবং বিস্ময়ের সাথে আবিষ্কার করেন অন্যদের ক্ষেত্রেও এটি কাজ করছে এবং মানসিক উপসর্গের তীব্রতা কমে আসছে। এরপর ডা. স্যাকেল ধারাবাহিকভাবে পূর্ণাঙ্গ গবেষণার উদ্দেশ্যে এই পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটান। এতে আশাতীত ফলাফল লাভ করেন এবং বুঝতে পারেন যে তিনি একটি যুগান্তকারী আবিষ্কারের দ্বারপ্রান্তে।
বিস্তার
কয়েক বছরের সকল গবেষণার পর ১৯৩৩ সনে ডা. স্যাকেল তার গবেষণালব্ধ ফলাফল প্রকাশ করেন এবং ইনসুিলন কোমাথেরাপি প্র্যাকটিস শুরু করেন। রীতিমত হৈচৈ পড়ে যায়। দলে দলে বিভিন্ন চিকিৎসকদের ভিড় লেগে যায় নতুন এই চিকিৎসা-পদ্ধতি দেখার এবং নিজেদের দেশে তার প্রয়োগ ঘটানোর জন্য। ১৯৩৫ সাল নাগাদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এর প্রয়োগ শুরু হয়। প্রায় একই সময় ব্রিটিশ মনোরোগবিদদের একটি দল ভিয়েনা সফর করে এবং এ-সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ নেয়। ১৯৩৮ সালে দেখা যায় গোটা যুক্তরাজ্যে প্রায় ৩১টি ইনসুলিন কোমাথেরাপি ইউনিট চালু হয়। এগিয়ে চলে জয়রথ। একপর্যায়ে ডা. স্যাকেল অভিবাসী হয়ে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে এবং পূর্ণোদ্যমে শুরু করেন ইনসুলিন কোমাথেরাপি।
পদ্ধতি
রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমে গেলে শরীরে কিছু উপসর্গ তৈরি হয়। যেমন : ঝিঁমুনি লাগা, হাত-পা কাঁপা, ঘেমে যাওয়া ইত্যাদি। যদি গ্লুকোজের মাত্রা খুব বেশি কমে যায় তবে তীব্র আকারে এইসব উপসর্গ দেখা দেয় এবং একপর্যায়ে রোগী অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। এই অবস্থাকে বলা হয় হাইপোগ্লাইসেমিক কোমা। উপযুক্ত সময়ের ভেতরে যদি রক্তের গ্লুকোজ স্বাভাবিক মাত্রায় ফিরিয়ে আনা যায় তবে রোগী সেই কোমা থেকে সম্পর্ণূ সুস্থ হতে পারেন। ডা. স্যাকেল এই পদ্ধতিকেই কাজে লাগান। তিনি বাইরে থেকে বেশি মাত্রায় ইনসুিলন দিয়ে কৃত্রিমভাবে একটি হাইপোগ্লাইসেমিক কোমা তৈরি করেন এবং নির্দিষ্ট সময় পর ইনজেকশন অথবা নাকের নলের মাধ্যমে শরীরে গ্লুকোজ প্রবেশ করিয়ে রোগীকে স্বাভাবিক করেন। ধারণা করা হয় মাঝখানে এই ‘কোমা’ অবস্থাটিই রোগীর মানসিক উপসর্গ কমানোতে ভূমিকা রাখে। মূলত সিজোফ্রেনিয়া চিকিৎসায় এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হতো। তবে অন্যান্য মানসিক রোগের চিকিৎসায়ও এই পদ্ধতি প্রয়োগের নজির রয়েছে। সাধারণত সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তদের সপ্তাহে ৫-৬ দিন করে অন্তত ২ মাস এই চিকিৎসা দিতে হতো। ক্ষেত্রবিশেষে আরো অধিক সময়ও দিতে হতো। তবে অন্যান্য নিউরোটিক রোগীদের ক্ষেত্রে আরো কম সময় লাগত।
উল্টোস্রোত
ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ওঠে এই পদ্ধতি। গত শতকের চল্লিশের দশকের শেষদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে প্রায় সব মানসিক চিকিৎসাকেন্দ্রে প্রয়োগ করা হতো এই পদ্ধতি। যে-কোনো প্রক্রিয়ার উত্থান যেমন আছে তেমনি আছে পতনও। ১৯৫২ সালে Chlorpromazine আবিষ্কারের পর মানসিক চিকিৎসার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। বাড়তে থাকে এর প্রয়োগ। প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যেতে থাকে ইনসুিলন কোমাথেরাপি। ১৯৫৩ সালে বিখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞান বিষয়ক জার্নাল ল্যানসেট প্রকাশ করে একটি আর্টিকেল যার নাম ‘The Insulin Myth’। শুরু হয় নানাবিধ বিশ্লেষণ। এই থেরাপির বিপক্ষে বৈজ্ঞানিক যুক্তি প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে। ১৯৫৭ সালে ল্যানসেট আরেকটি গবেষণাধর্মী রেনডমাইজড কনট্রোলড ট্রায়াল প্রকাশ করে যেখানে এক দলের ক্ষেত্রে ইনসুিলন প্রয়োগ করে কোমা তৈরি করা হয়। আর একটি দলে বার বিচুয়েট প্রয়োগ করে কোমা তৈরি করা হয়। দেখা যায় দইু গ্রুপে ফলাফল প্রায় একই। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠিত হয় চিকিৎসার ফলাফল পাওয়া যায় কোমা থেকে যেটা ইনসুলিন বা অন্য যে-কোনো কিছু দিয়েই তৈরি হোক না কেন। বদলাতে থাকে দশ্যৃপট। একদিকে নতুন নতুন ড্রাগ অন্যদিকে যথেষ্ট বৈজ্ঞানিক ভিত্তির অনুপস্থিতিতে কমতে থাকে এই পদ্ধতির প্রয়োগ। সত্তরের দশক নাগাদ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। যদিও তখনো চীন, রাশিয়ায় প্রয়োগ চলতে থাকে এই পদ্ধতির। পুরনো এক একটি চিকিৎসা পদ্ধতি আসলে এক একটি কালের স্বাক্ষর। বর্তমানকে জানতে হলে অবশ্যই ফিরে তাকাতে হবে অতীতের দিকে আর খুঁজতে হবে পদচিহ্ন-যে পথ ধরে অতীত থেকে এসে পৌঁছেছি বর্তমানে।
 
লেখক: ডা. তৈয়বুর রহমান রয়েল
রেসিডেন্ট, এমডি (সাইকিয়াট্রি)
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

Previous articleগুরুতর মানসিক উদ্বেগের ফলাফল কী হতে পারে
Next articleপার্কিনসন্‌স ডিসিস্‌ বা হাত পা কাঁপা এবং ডিপ্রেশন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here