আধুনিক বর্ষপঞ্জি অনুসারে ১৬৪৩ খ্রিস্টাব্দের ৪ জানয়ারিতে আইজ্যাক নিউটন জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মস্থান লিঙ্কনশায়ারের উলসথর্প ম্যানরে। তিনি পিতা আইজ্যাকের মৃত্যুর তিন মাস পর জন্ম নেন। তাঁর বাবা গ্রামের একজন সাধারণ কৃষক ছিলেন। জন্মের সময় নিউটনের আকার-আকৃতি ছিলখুবই ছোট। তাঁর মা হানাহ এইসকফ প্রায়ই বলতেন, ছোট্টবেলার সেই নিউটনকে অনায়াসে একটি কোয়ার্ট মগের ভেতর ঢুকিয়ে দেয়া যেত। তিন বছর বয়সে তাঁর মা আরেকটি বিয়ে করেন এবং নতুন স্বামী রেভারেন্ড বার্নাবাউস স্মিথের সঙ্গে বসবাস করতে থাকেন। এ সময় নিউটন তাঁর মায়ের সঙ্গে ছিলেন না। নানী মার্গারি এইসকফের তত্ত্ববধানে তাঁর দিন কাটতে থাকে। নিউটন তাঁর সৎ বাবাকে পছন্দ করতে পারেননি। তাঁর মা এই লোককে বিয়ে করেছেন বলে মায়ের প্রতি তাঁর কিছুটা ক্ষোভও ছিল।
নিউটন তাঁর ১৯ বছর বয়স পর্যন্ত করা পাপ কাজগুলোর একটি তালিকা প্রকাশ করেছিলেন। সেই তালিকা থেকে মায়ের প্রতি তাঁর এই ক্ষোভের প্রমাণ পাওয়া যায়। জনৈকা মিস স্টোরির সঙ্গে নিউটনের বাগদান হয়, কিন্তু পড়াশোনা ও গবেষণায় খুব বেশি নিমগ্ন থাকার কারণে নিউটন বিয়ে করেননি।
নিউটনের প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন হয় বাড়ির পাশের এক ক্ষুদ্রায়তন স্কুলে। ১২ বছর বয়সে তাঁকে গ্রান্থামের ব্যাকরণ স্কুলে পড়াশোনার জন্য পাঠানো হয়। সেখানে তিনি এক ঔষধ প্রস্তুতকারক ও বিক্রেতার বাড়িতে থাকতেন। এই স্কুলে নিউটন ছিলেন অপ্রতিদ্বনদ্বী, যা থেকে তাঁর মেধার পরিচয় পাওয়া যায়।
১৬৫৬ খ্রিস্টাব্দে নিউটনের সৎ বাবা মারা যান। এরপর তাঁর মা উলসথর্পে ফিরে এসে তাঁকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসেন। উদ্দেশ্য ছিল বাড়িতে ক্ষেত-খামারের কাজ শিখিয়ে ভবিষ্যতের বন্দোবস্ত করে দেয়া। কিন্তু শিগগিরই তিনি বুঝতে পারেন, খামারের কাজের দিকে নিউটনের কোনো ঝোঁক নেই। নিউটনের চাচা ছিলেন বার্টন কগলিসের রেক্টর। এই চাচার উপদেশ শুনেই পরিবার থেকে তাঁকে ক্যামব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে পড়াশোনার জন্য পাঠানো হয়। নিউটনের ছেলেবেলা বেশ কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে। জন্মের আগেই বাবা মারা যান। মা অন্য একজনকে বিয়ে করেন এবং তাঁর কাছ থেকে আলাদা হয়ে যান। তাছাড়া তিনি নিম্নবিত্ত পরিবারেই জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আচরণে বেশ অস্বাভাবিকতাও পরিলক্ষিত হয়। তিনি অন্যদের সহজে বিশ্বাস করতেন না। সুতরাং ছোটবেলায় তিনি বাবা-মা, পরিবার, বন্ধু, পারিপার্শ্বিকতা সবকিছু থেকে বেশ দূরেই থেকেছেন।
পরিণত বয়সেও তাঁর আচরণের খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। তিনি আগ্রাসী মনোভাবের ছিলেন, সহকর্মীদের প্রতি মোটেও হৃদয়বান ছিলেন না, নিজের মতের বিপরীতে অন্যের মতামতের প্রতি তাঁর সম্মান দেখানোর প্রবণতা ছিল না বললেই চলে। তিনি অন্যদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি ও রক্ষা করতে অসবিধার সম্মুখীন হতেন। বেশিরভাগ সময় তাঁকে নিরস- বিমর্ষভাবেই দেখা যেত। তিনি সবার কাছে অপছন্দনীয় ও বিরক্তিদায়ক ছিলেন। তাঁর কাছে খুব কম লোকই আসতেন, তিনিও খুব কম লোকের কাছে যেতেন। ঘুরতে যেতে বেশি পছন্দ করতেন না। সব সময় তিনি লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। নিজের সমালোচনা তিনি কোনোভাবেই নিতে পারতেন না, এমনকি ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়তেন। পোশাক-আশাকের প্রতি আকর্ষণ কম ছিল। অনেক সময় এলোমেলো পোশাক পরে তাঁকে জনসম্মুখে আসতে দেখা গেছে।
বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংস তার আ ব্রিফ হিস্টোরি অব টাইম গ্রন্থের পরিশিষ্টে নিউটনের একটি সংক্ষিপ্ত জীবনী সংযুক্ত করেছেন, যাতে নিউটনের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে বেশ কিছু সমালোচনা প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর প্রিন্সিপিয়া বই প্রকাশিত হওয়ার পর নিউটন বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তিনি রয়েল সোসাইটির সভাপতি নির্বাচিত হন এবং প্রথম বিজ্ঞানী হিসেবে নাইট উপাধি লাভ করেন। এর পরপরই নিউটনের সঙ্গে দু’জন জ্যোতির্বিজ্ঞানী, যাঁরা তাঁর প্রিন্সিপিয়া বই লেখার সময় তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছিলেন, তাঁদের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। এঁরা হলেন রয়েল এবং ফ্ল্যামস্টিড। সংঘর্ষের কারণ, নিউটন তাঁদের কাছ থেকে এমন কিছু তথ্য চেয়েছিলেন, যা তাঁরা দিতে সম্মত হননি। নিউটন কোনো ‘না’ সহ্য করতে পারতেন না। তিনি নিজেকে রয়েল মানমন্দিরের পরিচালনা পরিষদে অন্তর্ভুক্ত করে তার চাওয়া সেই তথ্য-উপাত্তগুলো অবিলম্বে প্রকাশের দাবি করেন। কিন্তু তিনি উপাত্তগুলো পাননি। এরই
ধারাবাহিকতায় তিনি ফ্ল্যামস্টিডের গবেষণাকর্ম তাঁর কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে এডমন্ড হ্যালির নামে প্রকাশের ব্যবস্থা করেন; অথচ হ্যালি ছিলেন ফ্ল্যামস্টিডের আজীবন শত্রু। সবিচারের আশায় ফ্ল্যামস্টিড আদালতের আশ্রয় নেন এবং বিচারের পর তাঁর কাছ থেকে চুরি করে নেয়া গবেষণাকর্মের প্রকাশনা বণ্টনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। প্রতিশোধ নেয়ার জন্য নিউটন তাঁর লেখা প্রিন্সিপিয়া বইয়ের পরবর্তী সংস্করণগুলোয় ফ্ল্যামস্টিডের নামে উল্লেখিত সব তথ্যসূত্র কেটে বাদ দিয়ে দেন।
নিউটনের সঙ্গে আরেকটি বড় ধরনের বিরোধ ছিল জার্মান দার্শনিক ও গণিতজ্ঞ গটফ্রিড লাইবনিজের। লাইবনিজ এবং নিউটন সম্পর্ণ স্বাধীনভাবে প্রায় একই সময়ে বিজ্ঞানের একটি নতুন শাখার উন্নয়ন ঘটান, যা ক্যালকুলাস নামে পরিচিত। আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম ভিত্তি হচ্ছে এই শাখাটি। যদিও আমরা এখন জানি নিউটন লাইবনিজের কয়েক বছর আগেই এটি আবিষ্কার করেছিলেন, তবে তিনি তা প্রকাশ করেছিলেন অনেক পরে অর্থাৎ ১৬৯৩ সালে; আর পূর্ণ বিবরণ প্রকাশ করেছিলেন ১৭০৪ খ্রিস্টাব্দে। অথচ লাইবনিজ তাঁর কাজের একটি পূর্ণ বিবরণ ১৬৮৪ সালেই প্রকাশ করেছিলেন। মূলত লাইবনিজের ব্যবকলন পদ্ধতিই পরবর্তীকালে মহাদেশজুড়ে গৃহীত হয়েছিল। কে আগে এটি আবিষ্কার করেছেন, তা নিয়ে তৎকালীন বিজ্ঞানী সমাজের মাঝে প্রবল বিতর্কের সূত্রপাত ঘটে। দু’জনের বিরুদ্ধে ও পক্ষেই অনেক লেখালেখি হয়। আশ্চর্যের বিষয়, নিউটনের পক্ষে লিখিত অধিকাংশ নিবন্ধই ছিল তাঁর নিজের লেখা এবং তাঁর বন্ধুদের নামে প্রকাশিত। বাগ্?বিতন্ডা চলতে থাকায় লাইবনিজ বিষয়টি রয়েল সোসাইটিতে উত্থাপন করেন। সোসাইটির সভাপতি নিউটনের সঠিক অনুসন্ধানের জন্য তার বন্ধুদের নিয়ে একটি পক্ষপাতিত্বমূলক কমিটি গঠন করেন। এই কমিটি পূর্ণ ক্ষমতায় কাজ শুরু করে ১৭১১ সালে। রয়েল সোসাইটির প্রতিবেদনে লাইবনিজকে গবেষণাকর্ম চুরির দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। এরপর নিউটন নাম গোপন করে এক সাময়িকীতে রয়েল সোসাইটির প্রতিবেদনের পক্ষেও লিখেছিলেন। লাইবনিজের মৃত্যুর পর নিউটন বলেছিলেন, লাইবনিজের মন ভেঙে দিয়ে তিনি খুব শান্তিপেয়েছেন।
নিউটন তার মেধা ও অনন্যসাধারণ আবিষ্কার- চিন্তাচেতনার জন্য সাফল্যের চূড়ায় উঠেছেন। যদিও যেকোনো সাধারণ মানুষের মতো তারও আচরণ-বিচ্যুতি ছিল। তাঁর জানার অশেষ আগ্রহ হয়তো তাকে অমর করে তুলেছে। তিনি লিখে গেছেন, ‘জ্ঞান সমুদ্রের সামনে নুড়ি নিয়ে খেলা করেছি মাত্র, সত্যের মহাসমুদ্র সম্মুখে অনাবিষ্কৃতই রয়ে গেল’।