ভুটান দক্ষিণ এশিয়ার ছোট্ট একটি দেশ। দক্ষিণে ভারত এবং উত্তরে চীন। মোট জনসংখ্যা ৭,৯৭,৭৬৫ জন। দেশটিকে আধুনিকায়ন করার লক্ষ্যকে সামনে রেখে ১৯৬১ সালে প্রম পাঁচ বছরের পরিকল্পনার আওতায় আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র চালু হয়। আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা চালু হওয়ার আগপর্যন্ত ধর্মীয় রীতি এবং স্থানীয়ভাবে প্রচলিত সনাতনী চিকিৎসা ও ওষুধ ছিল চিকিৎসার প্রধান মাধ্যম। আশির দশকের মাঝামাঝি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের মাধ্যমে ভুটানে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিসেবা চালু হয়। দেশটিতে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা চালু করতে ভুটান সরকার ১৯৯৬ সালে মিয়ানমারের নাগরিক ও মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. উ থুটাকে নিয়োগ করেন। প্রাথমিকভাবে তিনি থিম্পু জেনারেল হাসপাতালে কাজ করেন। পরে সমাজসেবা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। উল্লেখ্য, ভুটানে স্বাস্থ্যসেবা সমাজসেবা মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হয়। ডা. উ থুটা একজন পুরুষ নার্স তেন্দিং সায়গলকে ভারতে পাঠান ‘সাইকিয়াট্রিক নার্সিং’-এর ওপর ডিপ্লোমা করার জন্য। এক বছর পর তেন্দিং সায়গল ভুটান ফিরে আসেন এবং মেন্টাল হেলথ প্রোগ্রামের প্রম প্রোগ্রাম অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
এদিকে ডা. চেঞ্চো দর্জি ১৯৯৯ সালে প্রম ভুটানি হিসেবে শ্রীলঙ্কার একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনোরোগবিদ্যায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ডা. উ টুন্ডা থেকে জিগমে দর্জি ওয়াংচুক ন্যাশনাল রেফারাল হাসপাতালের মানসিক রোগ বিভাগের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং মানসিক স্বাস্থ্যের প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিসেবা চালু করেন। তিনি সাধারণ চিকিৎসকদের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পদ্ধতি মোতাবেক সাধারণ মানসিক রোগগুলোর ওপর প্রশিক্ষণ প্রদান শুরু করেন। ২০০২ সালে তিনি দেশটির তিনটি জেলায় মানসিক রোগের ওপর একটি জরিপ পরিচালনা করেন। জরিপে দেখা যায়, পরিবারগুলোর মধ্যে ৬০% পরিবার কোনো না কোনো মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের মধ্যে মানসিক ব্যাধি পরিলক্ষিত হওয়ায় তিনি দেশে আরো মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করেন। মনোরোগবিদ্যায় স্নাতকোত্তর শিক্ষার জন্য তিনি কয়েকজন ডাক্তারকে উদ্বুদ্ধ করেন। এছাড়াও তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দানকারী স্বেচ্ছাসেবী নিয়োগের ব্যবস্থা করেন। ‘হেলথ ভলেন্টারি ওভারসিজ’ যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। ২০০৮ সাল থেকে এই সংগঠনটি ভুটানে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে আসছে।
বর্তমানে মানসিক রোগ বিভাগের প্রধান ও ভুটানের দ্বিতীয় মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. দাম্বের কুমার নিরোলার তত্ত্বাবধানে দেশটির নিম্নাঞ্চলের মানুষদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়াও ওপিডি-এর অধীনে তিনজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ কাজ করে যাচ্ছেন। এখানে মানসিক রোগের জন্য ২০ শয্যাবিশিষ্ট একটি পৃথক ওয়ার্ড রয়েছে। মানসিক রোগের চিকিৎসক ছাড়াও এখানে ৮ জন সাইকিয়াট্রিক নার্স, ১ জন মানসিক স্বাস্থ্য কাউন্সিলর এবং একজন এডিকশন কাউন্সিলর রয়েছে।
সেবাগুলো
মানসিক রোগীদের ফার্মাকোলজিক্যাল চিকিৎসা
ইলেক্ট্রোকনভালসিভ থেরাপি (ইসিটি)
মাদক ও অ্যালকোহলে আসক্ত রোগীদের আসক্তি দূরীকরণ
কাউন্সিলিং এবং রিলাক্সেশন ট্রেনিং
সপ্তাহে তিন দিন গ্রুপ কার্যক্রম
সপ্তাহে একদিন অ্যাংজাইটি ক্লিনিক
সপ্তাহে একদিন আর্ট থেরাপি
সপ্তাহে একদিন ড্যান্স থেরাপি
সপ্তাহে একদিন মেডিটেশন
রিক্রিয়েশনাল অ্যাক্টিভিটি সপ্তাহে একদিন
সোশ্যাল ওয়ার্ক সপ্তাহে একদিন
পরামর্শক এবং নার্সদের ওয়ার্ডে পাঠানোর আগে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা
ইউনিভার্সিটি অব মেডিক্যাল সায়েন্স অব ভুটানের অধীনে কাউন্সিলিং ট্রেইনিদের কন্ডাক্ট ক্লাস
জেলা শহরের রোগীদের টেলি কাউন্সিলিং প্রদান
অ্যালকোহল ও মাদকাসক্তদের চিকিৎসার জন্য পুনর্বাসন কেন্দ্র
অন্য ওয়ার্ডে ভর্তি রোগীদের মানসিক রোগ থাকলে তাদের পরামর্শ প্রদান
মানসিক স্বাস্থ্য ও আত্মহত্যা নিয়ন্ত্রণের টেকনিক্যাল সাপোর্ট
মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে এমন সংস্থাগুলোকে টেকনিক্যাল সাপোর্ট। যেমন- ভুটান নারকোটিক কন্ট্রোল এজেন্সি, ইয়ুথ ডেভেলপমেন্ট ফান্ড, আরইএনইডপ্লিউ, চিতুন পেন্ডি অ্যাসোসিয়েশন, অ্যাবিলিটি ভুটান সোসাইটি, ডিপার্টমেন্ট অব ইয়ুঅ্যান্ড স্পোর্টস, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ন্যাশনাল রেফারাল হাসপাতালের বহির্বিভাগের রেকর্ড থেকে দেখা যায়- ১৯৯৯ সাল থেকে ৭০০০-এর অধিক রোগী মানসিক চিকিৎসা গ্রহণ করে।
লেখক: অধ্যাপক ডাম্বার কুমার নিরলা।
অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ জিগমে দর্জি ওয়াংচুক ন্যাশনাল রেফারাল হসপিটাল অ্যান্ড খেসার গাল্প ইউনিভার্সিটি অব মেডিক্যাল সায়েন্স অব ভুটান, থিম্পু।