কর্মব্যস্ততা প্রভাব ফেলে যৌনজীবনে

কর্মব্যস্ততা প্রভাব ফেলে যৌনজীবনে

অফিস থেকে ফিরে অবসাদে ঘুমিয়ে পড়া ছাড়া শফিকের আর তেমন কিছুই করার থাকে না। ঘুম ভেঙে উঠতে উঠতে রাত নয়টা বেজে যায়। তারপর ঘুম থেকে উঠে একটু বাজার-সদায়। রাত দশটায় ডিনার। ফেইসবুক, মেইল চেক করতে করতে আবার ঘুমিয়ে পড়া। না ঘুমিয়ে উপায় নেই। সাত-সকালে উঠে অফিসে যেতে হয়। একটুও এদিক সেদিক হওয়ার উপায় নেই। জ্যামে পড়লে বিশ মিনিটের পথ দেড় ঘণ্টায়ও যাওয়া যায় না। এই হলো শফিক আর মিলার প্রাত্যহিক রুটিন। এই রুটিন ভাঙার সামর্থ্য ওদের নেই। মিলার স্কুল কিংবা শফিকের কোম্পানি কেউ-ই ওদেরকে ছাড় দেবে না।

এই রুটিন শুধু শফিক আর মিলার নয়। নাগরিক জীবনের বেশিরভাগ দম্পতিরই প্রাত্যহিক জীবন এভাবেই চলছে। গার্মেন্টস কর্মী থেকে শুরু করে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির কর্মকর্তা সবার জীবনই এই ছকে বাঁধা। অর্থনীতির চাকা যত ঘুরবে আমাদের জীবনে ব্যস্ততা তত বাড়বে বৈ কমবে না। কোনো জরিপ ছাড়াই শুধুমাত্র রোগী দেখার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় আমাদের কর্মব্যস্ততা আমাদের যৌনজীবনের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। অনেক রোগীকেই বলতে শুনি অফিস আর রাস্তায় শক্তি খরচ করার পর দৈহিক মেলামেশার মতো যথেষ্ট শক্তি তাদের থাকে না।

১৮৮৬ সালের ৪ মে শিকাগোর হে মার্কেটে যে আট ঘণ্টা কাজের দাবি উঠেছিল তা শুধু শ্রমিকের জন্য নয়, সবার জন্যই প্রযোজ্য। সে সময়ের স্লোগান ছিল আট ঘণ্টা কাজ, আট ঘণ্টা বিনোদন আর আট ঘণ্টা বিশ্রাম। আজ যদি প্রশ্ন তুলি সত্যি কি আমরা তা উপভোগ করতে পারছি? তাহলে দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় আমরা তা পারছি না। আমাদের অফিস আওয়ার কাগজে কলমে আট ঘণ্টা থাকলেও সেটা কার্যত দশ ঘণ্টা বা কখনো কখনো তার চেয়েও বেশি সময় নিয়ে নেয়। দীর্ঘক্ষণ কর্মব্যস্ত থাকার ফলে যা হয় তা হলো-যৌন বিষয়ে আগ্রহ কমে যাওয়া। সেক্স ড্রাইভ কমে যাওয়ার পেছনে তাই সবসময় সম্পর্কের জটিলতা বা বিষণ্নতাকে দায়ী করা যায় না। শুধু যৌনাকাক্সক্ষা নয়, মানুষের সব ধরনের ইচ্ছারই বাড়তি কমতি থাকে। কখনো আমরা অনেক বেশি শারীরিক চাহিদা অনুভব করি আবার কখনো একদম পানসে।

সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরে চললে যৌন-চাহিদা স্বাভাবিক নিয়মেই কমে আসে। এই কমে আসার কারণ মূলত দুটি-এক. পরস্পরের কাছে নতুনত্ব কমে যায়, দুই. সময়ের সাথে সাথে হরমোনেরও পরিবর্তন হয়।

সম্প্রতি জার্নাল অব সেক্সুয়াল মেডিসিন-এ প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বয়স পঞ্চাশ অতিক্রম করলে দম্পতিদের মধ্যে যৌনমিলন লেস ফ্রিকুয়েন্ট বা মাঝে মধ্যে হয়। কিন্তু কর্মব্যস্ততার কারণে দেখা যাচ্ছে দীর্ঘকালীন সম্পর্ক বা বয়স পঞ্চাশ তো দূরের কথা বিয়ের ছয় মাস যেতে না যেতেই দৈহিক সম্পর্কের মাত্রা কমে আসে।

কারণ হিসেবে দেখা যায় :

  • মাত্রাতিরিক্ত ক্লান্তি
  • অতিরিক্ত কাজের চাপ
  • কাজের চাপে বিধ্বস্ত অবস্থা

বিশেষ করে যারা ফিনানশিয়াল সেক্টরে কাজ করেন। ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে আর্থিক অনিশ্চয়তা একটা বড় ব্যাপার। যারা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন তাদেরকে সব সময় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়। ফলে তাদের শরীরে অ্যাংজাইটি কেমিক্যাল অ্যাড্রেনালিন তুলনামূলকভাবে বেশি থাকে। এই অ্যাড্রেনালিন সেক্স ড্রাইভ কমিয়ে দেয়। আবার লিঙ্গোত্থান বা ইরেকশনেও সমস্যা দেখা দেয়। আপনি কোথায় কাজ করছেন সেটা বড় ব্যাপার নয়। আপনার কাজের চাপ কতটুকু সেটা গুরুত্বপূর্ণ।

কর্মব্যস্ততা আমাদের যৌনজীবনকে যেভাবে প্রভাবিত করছে :

  • সেক্স করার জন্য সময় কম পাওয়া
  • ক্লান্তি বা অবসাদের কারণে আগ্রহ কমে যাওয়া
  • যৌন উত্তেজনার চরমে উঠতে সমস্যা হওয়া
  • রিলাক্স হতে সমস্যা হওয়া
  • নারীর ক্ষেত্রে মিলনের আগে যথাযথ না ভেজা
  • পুরুষের ক্ষেত্রে লিঙ্গোত্থান সহজে না হওয়া
  • স্ট্রেস অনুভবের জন্য সঙ্গীর সঙ্গে রোমাঞ্চ এবং খুনসুটি করতে ব্যর্থ হওয়া
  • একঘেয়েমি
  • কর্মব্যস্ততার কারণে শারীরিক মিলনের সময় সঙ্গীর হতাশ অথবা বিরক্ত লাগা

এরকমভাবে চলতে থাকলে এক সময় সম্পর্ক ভেঙেও যেতে পারে। অথবা আপনার সঙ্গী পরকীয়া সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তে পারেন। তাহলে কী করবেন? কাজ তো আর ছেড়ে দেয়া যাবে না। বরং আপনার জীবনধারায় একটু পরিবর্তন আনুন। সকালের নাস্তায় এমন কিছু খান যা থেকে ধীরে ধীরে শক্তি পাওয়া যায়। দুপুরে লাঞ্চ অবশ্যই করবেন। লাঞ্চে সালাদ রাখবেন। পানি খাবেন পর্যাপ্ত পরিমাণে। চিকিৎসকরা পানি খেতে উৎসাহিত করেন বলে অনেকেই বেশি বেশি পানি খান। সেটা যেন না হয়। মনে রাখবেন প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি আপনার কিডনির ওপর কাজের চাপ বাড়িয়ে দেয়। এসবের পাশাপাশি ব্যায়াম করবেন। ব্যায়ামের জন্য আলাদা করে সময় বের করতে না পারলে অফিসে যাওয়ার সময় খানিকটা হাঁটুন।

আপনি হয়তো ভাবছেন ক্যারিয়ারের কথা ভাবতে গেলে এসবের সময় কোথায়? কিন্তু মনে রাখবেন জীবনে সবকিছুর সাম্যতা ফিরিয়ে আনতে না পারলে জীবনটাই অর্থহীন হয়ে যাবে। জীবনের শূন্যতা ব্যাংক ব্যালেন্সে পূর্ণ হবে কি?

সূত্র: লেখাটি মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত।

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

Previous articleশিশুদের ওসিডি অভিভাবকেরই দায় বেশি
Next articleমানসিক চাপ থেকেও বাড়ে রক্তচাপ
ডা. এস এম আতিকুর রহমান
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here