আমাদের চারপাশের ভৌত অবস্থা, জলবায়ু, জৈবিক এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক শক্তির সামষ্টিক রূপটিই হচ্ছে পরিবেশ। কোন ব্যবস্থা বা জীবের অস্তিত্ব বা বিকাশের জন্য তার উপর ত্রিয়াশীল কার্যকর বাহ্যিক প্রভাবকসমূহের সমষ্টিকে পরিবেশ বলে। জীবিত কিংবা নির্জীব যাই হোক না কেন পরিবেশের প্রতিটি উপাদানের দ্বারাই প্রতিটি প্রাণী এমনকি উদ্ভিদও প্রভাবিত হয়ে থাকে। মাটি,পানি,বায়ু,চন্দ্র,সূর্য, গাছ-পালা,পশুপাখি,নদী-নালা,খাল-বিল,রাস্তা-ঘাট,ঘর-বাড়ি, দালান-কোঠা ইত্যাদি তথা আমাদের চারপাশের সকল কিছুই পরিবেশের অংশ।
পাহাড়-পর্বত,গাছ-পালা,নদী এগুলো মানুষ তৈরি করতে পারে না, প্রকৃতি নিজে নিজে তৈরী করে বলে এসবগুলোই হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশের অন্তর্গত। আবার মানবসৃষ্ট পরিবেশকে বলে কৃত্তিম পরিবেশ যা মানুষ নিজের প্রয়োজনে তৈরী করে ও তার ভিন্ন ভিন্ন রূপ দেয়। যেমন: ঘরবাড়ি, দালানকোঠা, শহর-বন্দর, রাস্তা-ঘাট, হাসপাতাল ইত্যাদি। প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট এই দুই ধরণের পরিবেশের সমন্বয়েই সৃষ্টি হয়েছে আমাদের এই সুন্দর পরিবেশ।
এই পরিবেশের প্রতিটা উপাদানের সুসমন্বিত রূপই হলো সুস্থ পরিবেশ। একটি ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশের জন্য অজীব ও জীব প্রতিটি উপাদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভৌতিক, রাসায়নিক ও জৈবিক কারনে এ উপাদানগুলোর মধ্যে যে কোন একটির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটলে সামগ্রিক পরিবেশের উপর এর বিরুপ প্রভাব পরে এবং পরিবেশ দূষণ হয়। অর্থাৎ এই সুসমন্বিত রূপের ব্যতয়ই পরিবেশ দূষণ ঘটায় এবং এতে পরিবেশের স্বাভাবিক মাত্রার অবক্ষয় দেখা দেয়।
মানুষের অসচেতনতা এবং অনিয়ন্ত্রিত আচরণের কারণেই পরিবেশ দূষণ হচ্ছে ও জীব বৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে। বিভিন্ন কারণে উৎপাদিত মানবসৃষ্ট ক্ষতিকারক পদার্থ যেমন: গ্রীন হাউজ গ্যাস,তেজস্ক্রিয় পদার্থ,কলকারখানার রাসায়নিক বর্জ্য,জমিতে ব্যবহৃত
কীটনাশক,সীসা,আর্সেনিক,ধূলিকণা,দুর্গন্ধ,পলিথিন,ময়লা আবর্জনা ইত্যাদি মারাত্মকভাবে পরিবেশ দূষণ করে। তাছাড়া কলকারখানায় মেশিনের শব্দ,মাইকের শব্দ কিংবা যানবাহনের বিকট হর্ন শব্দ দূষণের একটি বড় কারণ।
বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে জনসংখ্যার বৃদ্ধিতে পরিবেশ দূষণ মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। জনসংখ্যার আধিক্য প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহারকে বাড়িয়েছে বহুগুণ, যার পরিণাম অধিক দূষণ। সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকায় বর্জ্যজনিত দূষণ দেশের একটি প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে বিপুল পরিমাণে কঠিন বর্জ্য জমা হয়। এসব বর্জ্য নিকটবর্তী নালা-নর্দমা বা নদীতে নিক্ষেপ করা হয়। এসব বর্জ্যর মধ্যে রয়েছে সালফিউরিক এসিড,ক্রোমিয়াম,অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইড ও সালফেট, ক্যালসিয়াম অক্সাইড ইত্যাদি। এগুলো পানির মাধ্যমে যেমন ছড়াচ্ছে তেমনি মাটিতে শোষিত হয়ে ভূ-গর্ভস্থ পানির দূষণও ঘটাচ্ছে। এছাড়া তীব্র দুর্গন্ধ বায়ুকেও দুষিত করছে। ফলে বায়ু,পানি,মাটি সবক্ষেত্রেই দূষণ মানুষের জীবনকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে।
একসময় বায়ুদূষণের র্শীষে ছিল ভারতের দিল্লি শহর। এবছরও দিল্লির বায়ু দূষণ এত বেশী ছিল যে ভারত বাংলাদেশের ক্রিক্রেট ম্যাচ আয়োজনও সংশয়ে পরে গিয়েছিল। তার অল্প কিছুদিন পরেই ঢাকার বায়ুদূষণ অসহনীয় পর্যায়ে চলে যায়। ঢাকা এখন বলতে গেলে বিশ্বের শীর্ষ বায়ুদূষণের শহরে পরিণত হয়েছে। বিশ্বে বায়ুদূষণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে বাংলাদেশ ও ভারতে।ভারতের দিল্লিতে প্রতি কিউবিক মিটার বাতাসে দূষিত ভারী বস্তু কণার পরিমাণ পাওয়া গেছে ১১৪ মাইক্রো গ্রাম। ঢাকায় এর পরিমাণ ১০০ মাইক্রোগ্রাম যা দিল্লির প্রায় সমান।
শহরাঞ্চলে যানবাহন ও কলকারখানার আধিক্য শব্দদূষণকে মারাত্মক করে তুলছে। শব্দদূষণ বাংলাদেশের জন্য এক ভয়ানক পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে বসতি এলাকায় দিনের বেলা শব্দের মাত্রা ৫৫ ডেসিবল ও রাতে ৪৫ ডেসিবল হওয়া উচিত। কিন্তু একাধিক জরিপে দেখা গেছে ঢাকা নগরীর শব্দ দূষণের মাত্রা ৬০ থেকে শুরু করে কোন কোন স্থানে ১০৬ ডেসিবল পর্যন্ত।
বিশ্ব ব্যাংক বলেছে দূষণের কারণে ২০১৫ সালে বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে ৮০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে বাংলাদেশে প্রতিবছর ২৮ শতাংশ মানুষ মারা যায় পরিবেশ দূষণ জনিত অসুখ বিসুখের কারণে। মালদ্বীপে এই হার ১১.৫ শতাংশ আর ভারতে ২৬.৫। কিন্তু সারাবিশ্বে এধরনের মৃত্যুর হার মাত্র ১৬শতাংশ। বিশ্ব ব্যাংকের কান্ট্রি-এনভায়রনমেন্টাল অ্যানালাইসিস (সিইএ) ২০১৮ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে বায়ুদূষণ জনিত মৃত্যু প্রায় ৪৬ হাজার।
মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে পরিবেশ দূষণ। বহুমাত্রিক এসব দূষণে কানে কম শোনা,হৃদরোগ,উচ্চ-রক্তচাপ, মাথাব্যথা,ক্ষুধামন্দা,অবসাদগ্রস্ততা,নিদ্রাহীনতাসহ নানাবিধ জটিল শারীরিক ও মানুষিক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। গবেষণা বলছে, পরিবেশের মধ্যে বায়ু দূষণে মানসিক সমস্যা দেখা দেয়ার সম্ভবনা বেশী থাকে। প্রানীর উপর গবেষণায় দেখা গেছে যে, যেকোন ধরণের দূষণই মুলত স্নায়ুবিক প্রদাহ তৈরি করার মাধ্যমে আমাদের মানসিক রোগ ঘটায়। তাছাড়া দূষণ ‘ডিএনএ’ তে পরিবর্তন ঘটিয়ে মস্তিষ্কের রাসায়নিকের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটায় যা মানসিক সমস্যার জন্ম দেয়।
বায়ুদূষণ এক অদৃশ্য ঘাতক। বায়ুদূষণে সবচেয়ে বেশী শিশুরা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। কারণ দূষিত বায়ুতে সীসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে অধিক মাত্রায় যা শিশুদের বুদ্ধিমত্তা বিকাশে এবং স্নায়ুবিক ক্ষতির কারণ। এমনকি অতিরিক্ত শব্দে শিশুর জন্মগত ত্রুটিও হতে পারে।তাছাড়া দূষিত বায়ু মাথা ব্যাথার একটি বড় কারণ।বায়ু দূষণের কারণে ব্যক্তি মানসিক চাপে ভুগতে পারে এমনকি ব্যক্তির মধ্যে স্মৃতিশক্তি লোপজনিত সমস্যার ঝুঁকি বাড়ায়। বায়ুদূষণের কারণে মানুষের শরীরে যেমন নানা রোগ বালাই বাসা বাঁধছে, তেমনি মনেও জন্ম দিচ্ছে নানা রোগশোক। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাড়ছে মানুষের বিষণ্ণতা। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব মানুষ দূষিত বায়ুর সংস্পর্শে আসে, তাদের মধ্যে ১০ শতাংশ মানুষ বিষণ্ণতায় ভোগে। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া,সবকিছুতেই বিরক্তভাব দেখা যায় তার মধ্যে।এমনকি এদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাও বাড়তে পারে। বিশ্বস্বাস্থ্যসংস্থার মতে প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে ৭০ লাখ মানুষ অপরিণত বয়সে মারা যায় এই দূষিত বায়ুর কারণে।
বায়ু দূষণের মতই শব্দদূষণ শিশুদের স্বাভাবিক মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে।প্রতিবন্ধী শিশু জন্মের পেছনে অনেকগুলো কারণের মধ্যে এই শব্দদূষণও একটি কারণ। মাত্রাতিরিক্ত শব্দ বাচ্চাদের মেজাজ খিটমেটে করে তুলে। ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায়।পড়াশোনায় অমনযোগী হয়ে পড়ে তারা। তাদের আচরণেও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটায়। একসময় শ্রবণশক্তিও নষ্ট করে দিতে পারে। শুধু শিশুদের ক্ষেত্রেই নয় বড়দের ক্ষেত্রেও শব্দ দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব সমানভাবে পরতে পারে।
মানুষ দূষিত বায়ুর সংস্পর্শে এলে তা নিশ্বাসের সঙ্গে দেহের ভেতরে ও রক্তে প্রবেশ করে। রক্তের মাধ্যমে ২.৫ পিএম সাইজের দূষিত ভারী কণা মানুষে রমস্তিষ্কে প্রবেশ করে। এতে মস্তিষ্কে অক্সিজেনের ঘাটতি হয়, স্নায়ুর প্রদাহ হয়। তখন স্নায়ুগুলো ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। ফলে মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়,কোনো কাজে মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না এবং অস্থিরতাও সৃষ্টি হয়। এ অবস্থা চলতে থাকলে তাদের মধ্যে একসময় বিষণ্ণতা দেখা দেয়। বায়ু দূষণ আমাদের শারীরিক প্রদাহ বাড়িয়ে দেয় যা চাপজনিত হরমোনের নিঃসরণ ঘটায় যা দীর্ঘমেয়াদী ফলস্বরূপ মানসিক রোগের কারণ হয়।
পরিবেশ ও জীবন একে অপরের পরিপূরক। অনুকূল পরিবেশে সুস্থ জীবনচক্র অব্যাহত থাকে। কিন্তু দূষণের দোষে দূষিত হয়ে উঠছে চারপাশ,যার ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে জীববৈচিত্র্যের ওপর। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানুষ,পশুপাখি। ক্যান্সারসহ নানাবিধ শারিরিক ও মানসিক রোগের মাত্রা তাই দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। তাই ক্ষতির মাত্রা কমাতে দরকার সম্মিলিত চেষ্টা ও সদিচ্ছা। শুধুসরকারের উদ্যোগের জন্য অপেক্ষা করলেই চলবে না, সচেতন হতে হবে নাগরিককেও। নিজেদেরকে ও ভবিষ্যত প্রজন্মকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য দূষণ কমিয়ে আনা ছাড়া বিকল্প আর কোন রাস্তা নেই।
সূত্র: লেখাটি মনে খবর মাসিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত।
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে