ধর্ষণ সহ নারী নির্যাতনের ঘটনা যেন প্রতিনিয়ন বেড়েই চলেছে আমাদের দেশে। কোনোভাবেই যেন তা রোধ করা যাচ্ছে না। ধর্ষণ নিয়ে কি ভাবছে সমাজের নারীরা? ধর্ষণ নিয়ে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার নারীদের অবস্থান এবং বক্তব্য জানতে তিনদিন ব্যাপি বিশেষ আলোচনা সভার আয়োজন করে মনের খবর টিভি। ধর্ষণ কার জন্য লজ্জা শীর্ষক আলোচনার প্রথব পর্বে অন্যান্যদের সাথে অংশগ্রহণ করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাজরীন ইসলাম তন্বী। যিনি জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি ডিবেট অর্গানাইজেশন (জেইউডিও) এর সভাপতি। ধর্ষণ বিষয়ে তাজরীন ইসলাম তন্বী’র ভাবনা পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল:
ধর্ষণ কার জন্য লজ্জা এই প্রশ্নটি আসলে হওয়াই উচিত না। এরকম একটি প্রশ্ন হওয়া মানে আমরা এখনও সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি যে ধর্ষণের ঘটনায় লজ্জা কার। অনেক মানুষ ধর্ষণের জন্য পোশাককে দায়ী করে থাকেন, অনেক মানুষ বিভিন্ন সামাজিক বিধি নিষেধের প্রসঙ্গ তোলেন।
ধর্ষণের জন্য যদি পোশাক কিংবা নারীর চলাফেরা দায়ী হয় তাহলে চার মাসের শিশু কেনো ধর্ষণের শিকার হয়? যখন এরকম একজন শিশুকে ধর্ষণ করা হয় তখন আসলে আমরা নারীর পোশাক কিংবা দেহভঙ্গিকে দায়ী করতে পারি না। এর মানে হলে অতটুকু একটা বাচ্চাকেও যে ভোগের বস্তু হিসেবে দেখা যায় এরকম একটি দৃষ্টিভঙ্গি সমাজ থেকেই ধর্ষণকারীর মনস্ত্বত্ত্বে স্থির হয়ে আছে।
অনেক সময় নারীরা পরিবার থেকেও ধর্ষণের শিকার হয়। এক্ষেত্রেও বেশিরভাগ সময় পরিবার থেকেই ওই নারী বা শিশুকে ঘটনাটি চেপে যেতে বলা হয় এবং ধর্ষককে শেল্টার দেওয়া হয়।
ধর্ষণের ঘটনায় ধর্ষিতা দোষী করার কোনো সুযোগই আসলে নেই। কিন্তু একটি ধষর্ণের ঘটনা ঘটে গেলে ধর্ষণকারীকে নিয়ে নিয়ে আলোচনা না করে ধর্ষিতাকে নিয়ে আলোচনা করি। এইসব আলোচনা ধর্ষণের শিকার মানুষটির জন্য আরো বেশি দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।
ধর্ষণের ঘটনায় আসলে ধর্ষিতাকে নিয়ে নয়; ধর্ষককে নিয়ে বেশি বেশি আলোচনা হওয়া উচিত। সামাজিক কাঠগড়ায় ধর্ষককে দাঁড় করানো খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সে যে খুবই ঘৃণিত একটি কাজ করেছে, এরকম একটি ঘটনা ঘটানোর কারণে সমাজে সে নিন্দিত, তার সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা কমে গেছে সামাজিকভাবে এই বোধটি যখন তার ভেতরে ঢোকানো যাবে তখন তা ধর্ষণের ঘটনা কমাতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
সামাজিক, পারিবারিক মূল্যবোধ বাড়ানোর পাশাপাশি সুস্থ মানসিক বিকাশও ধর্ষণ প্রতিরোধের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক। আমাদের সমাজে সুস্থ বিনোদনের প্রচন্ড পরিমাণে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। মাঠের খেলাধুলা কমে গিয়েছে। মাঠে খেলাধুলা না করে শিশু কিশোররা ডিভাইসে সময় বেশি দিচ্ছে, পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে পড়ছে; যার ফলে তাদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। একজন মানুষ যখন নিয়মিত পর্ন দেখতে থাকে তখন সে তার আশেপাশের সকল নারীদেরকে কিন্তু স্বাভাবিকভাবে দেখতে পারে না। সবাইকে ঘিরে তার মাথায় যৌনচিন্তা কাজ করে। পর্ন আসক্তি কমাতে সুস্থ বিনোদন বাড়ানোর বিকল্প নেই। এর পাশাপাশি সেক্স এডুকেশন চালু করতে হবে, পরিবারে সেক্স নিয়ে আলোচনা হতে হবে, সেক্স নিয়ে ট্যাবু ভাঙতে হবে। আমাদের দেশে এয়ারপোর্টে স্বামীকে বিদায় দেওয়ার সময় স্ত্রীকে আলিঙ্গন করাটাকেও অস্বাভাবিকভাবে দেখা হয়। অথচ যেটি হতে খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। এইসব দৃষ্টিভঙ্গিও কিন্তু সমাজে যৌন প্রতিহিংসা বাড়াচ্ছে। আসলে ধর্ষণের মত ঘটনার পেছনে অনেকগুলি কারণ প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে। ধর্ষণ নির্মুল করতে হলে এই সবগুলি বিষয়ে পরিবর্তনের জন্য আমাদেরকে কাজ করতে হবে।
সাম্প্রতিক সময়ের ধর্ষণের ঘটনাগুলির দিকে যদি আমরা তাকাই তাহলে দেখি যে ইদানিংকালে এইসব ঘটনাগুলি ঘটানোর সাথে সংঘবদ্ধতা খুব বেশি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিশোর গ্যাং বা স্থানীয়ভাবে রাজনীতির সাথে যুক্ত গোষ্ঠী এই কাজগুলি করছে। এবং ঘটনার ভিডিওধারণ কিংবা ফেসবুকে লাইভে যেতেও তাদের মধ্যে কোনো সংকোচ কাজ করছে না। এটাকে তারা ক্ষমতা প্রদর্শনের মাধ্যম হিসেবেও বেছে নিচ্ছে। এর একটি বড় কারণ হলো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির উদাহরণ না থাকা।
আইনগত বা সামাজিকভোবে ধর্ষককে শাস্তি দেওয়ার উদাহরণ না থাকাতে ধর্ষকরা উৎসাহিত হচ্ছে। তাদের মনস্ত্বত্ত্বে এটা কাজ করছে যে ধর্ষণের ঘটনায় তাদেরকে নয়; বরং ধর্ষিতাকে বেশি দায়ী করা হবে। এই চিন্তা অপরাধ সংঘটনে তাদেরকে আরো বেশি উস্কে দিচ্ছে। পাশাপাশি অপরাধীর মনে এটাও কাজ করে যে, তাকে যদি পুলিশ আটক করেও তবে কার পলিটিক্যাল বড় ভাই কিংবা তার পরিবার তাকে ছাড়িয়ে আনবে।
সর্বোপরি, ধর্ষণের মত ঘটনা প্রতিরোধে সমাজের সকল শ্রেণি পেশার মানুষকে যৌথভাগে এগিয়ে আসতে হবে।
পুরো আলোচনাটি এই লিংকে দেখুন।
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে