সুস্বাস্থ্যের জন্য সুস্থ দেহ ও মন দুটিরই দরকার হয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আমরা নিজেদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে খুব একটা চিন্তা করি না। মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক ততটা গুরুত্ব দাবি করে যতটা আমরা আমাদের শরীরকে গুরুত্ব দেই।
উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আমাদের দেশেও মানসিক অসুস্থতা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। যে হারে বেড়েছে মানসিক রোগী, সে হারে বাড়েনি সচেতনতা। মানসিক সমস্যা যে কত রকমের হয় এবং কতভাবে আমাদের শরীরে বাসা বাঁধতে পারে সে ব্যাপারে আমরা অনেকেই অজ্ঞ।
নানা ধরনের মানসিক সমস্যার মধ্যে খুব সাধারণ ও পরিচিত একটি মানসিক সমস্যা হচ্ছে বিষণ্ণতা। বিশ্বব্যাপী তিনশ মিলিয়নের বেশি মানুষ বিষণ্ণতায় ভোগে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ২০৩০ সালে ‘ডিজিজ বার্ডেন’ তালিকায় বিষণ্ণতাই হবে প্রথম। বিষণ্ণতা রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির চিন্তা, আবেগ, অনুভূতি ও আচরণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে যা পরবর্তীতে গুরুতর মানসিক ও শারীরিক সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিষণ্ণতা শুধু যে শারীরিক কিছু সমস্যা তৈরি করে তা নয় বরং এটা কিছু কিছু শারীরিক রোগেরও কারণ হিসেবে কাজ করে শারীরিক রোগকে বাড়িয়ে তোলে। কারণ বিষণ্ণতা বিভিন্ন চাপ নিয়ন্ত্রণকারী হরমোন যেমন: করটিসল, এড্রেনালিনের বৃদ্ধি ঘটায়। তাছাড়া শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকেও দুর্বল করে দেয়। ফলে দীর্ঘমেয়াদি মানসিক চাপ, মনোযোগে সমস্যা, ঘুমের সমস্যা, স্মরণশক্তি হ্রাস ইত্যাদি মানসিক সমস্যার পাশাপাশি কিছু গুরুতর শারীরিক রোগ যেমন: ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও অন্যান্য হৃদরোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
অ্যাড্রেনালিনের কারণে হার্টবিটের হার বেড়ে যায়, শ্বাস-প্রশাস ঘন ঘন হয়, বকে ব্যথা করে, মাথা ঘোরে এবং পেশিতে টান পড়ে। সুতরাং যার আগে থেকেই হৃদরোগ আছে তার হৃদরোগের ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়। বিষণ্ণতায় রোগীদের ডায়াবেটিস ও হৃদরোগের পাশাপাশি মাদকাসক্ত হওয়ারও ঝুঁকি বেশি থাকে। মানসিক এ সমস্যার কারণে হাঁপানি বা শ্বাসকষ্টের রোগীদের বারবার ভর্তি হতে হয় হাসপাতালে। আবার দেখা যায় দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক রোগ যেমন: ডায়াবেটিস, আর্থাইটিস, শ্বাসকষ্ট, ক্যান্সার, স্ট্রোক, হৃদরোগ ও মৃগীর মতো রোগে যারা ভুগছেন, তাদের মানসিক রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা সাধারণ মানষের চেয়ে তিন থেকে চার গুণ বেশি।
মানসিক রোগগুলোর মধ্যে বিষণ্ণতার সাথে এসব অসংক্রামক রোগের রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। অর্থাৎ বিষণ্ণতা যেমন অনেক শারীরিক সমস্যাকে বাড়িয়ে তোলে ঠিক তেমনি অন্যান্য শারীরিক রোগেও মানুষ বিষণ্ণ হতে পারে। বিভিন্ন শারীরিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে এক তৃতীয়াংশ ক্ষেত্রে বিষণ্ণতার লক্ষণ দেখা যায় এবং দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ২৫ থেকে ৩০ ভাগ রোগীদের এর মাত্রা অনেক বেশি থাকে। ৬০টি দেশে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পরিচালিত গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, যারা একটি শারীরিক রোগে আক্রান্ত তাদের মধ্যে ৯.৩ থেকে ১৮ ভাগ বিষণ্ণতায় ভোগে আর যারা দুই বা ততোধিক শারীরিক রোগে ভুগছেন তাদের ভেতর ২৩ ভাগ রোগীদের মধ্যে বিষণ্ণতা পাওয়া গেছে। আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, ডায়াবেটিস রোগীদের ২৫ ভাগ, স্ট্রোকের রোগীদের ১০ থেকে ২৭ ভাগ, হৃদরোগীদের ১৮ থেকে ২০ ভাগ এবং দীর্ঘদিনের শারীরিক ব্যথায় আক্রান্ত রোগীদের ৩০ থেকে ৫৪ ভাগ বিষণ্ণতায় ভোগে ক্যান্সারের সঙ্গেও মানসিক রোগের সম্পর্ক রয়েছে। ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের বিষণ্ণতার প্রকোপও বেশি। বিষণ্ণতায় ভুগলে ক্যান্সারের কোষ বৃদ্ধির হার বেড়ে যায় দ্রুতগতিতে। রোগ নিশ্চিত হওয়ার পর জীবনের কোনো না কোনো সময় প্রতি ৪ জনে ১ জন ক্যান্সার রোগী বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হন। সামগ্রিকভাবে দেখা গেছে, ক্যান্সারের রোগীদের বিষণ্ণতায় ভোগার হার ১৫-২৫ শতাংশ।
অনেক সময় অন্যান্য শারীরিক রোগের সাথে বিষণ্ণতা পাশাপাশি থাকতে পারে। যেমন: হৃদরোগ, থাইরয়েডের সমস্যা, হাঁপানি, ডায়াবেটিস, কিডনির সমস্যা, ইত্যাদি।
এসব ক্ষেত্রে দেখা যায়, বিষণ্ণতার বিভিন্ন লক্ষণগুলো শারীরিক রোগের মধ্যে হারিয়ে যায়। বিষণ্ণতার লক্ষণ যেমন ঘুম, দুর্বলতা, ক্ষুধামন্দা অন্যান্য শারীরিক রোগেও থাকে। কিন্তু সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় করা জরুরি কারণ যখন একইসঙ্গে বিষণ্ণতা ও অন্য কোনো রোগ থাকে তখন উভয় রোগের চিকিৎসা এক সঙ্গেই করা প্রয়োজন। কারণ ঠিকমতো চিকিৎসা না হলে একটি আরেকটিকে বাড়িয়ে তোলে।
যেকোনো বয়সের যেকোনো ব্যক্তি যেকোনো সময় বিষণ্ণতা রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। তবে দারিদ্র্য, বেকারত্ব, সম্পর্কচ্ছেদ, শারীরিক রোগ, মাদকাসক্তি প্রভৃতি বিষণ্ণতার ঝুঁকি বাড়ায়। বয়ঃসন্ধি ও নারীদের সন্তান প্রসবের পর পর এবং ষাট বছরের বেশি বয়সে মানুষের বিষণ্ণতার ঝুঁকি বেশি। প্রসবের পর নারীর বিষণ্ণতা সন্তান লালন-পালনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাছাড়া নারীদের মাসিক অনিয়মিত করে, নারী-পুরুষ উভয়েরই যৌন আগ্রহ কমায় যা সন্তান জন্মদানেও তাদেরকে অক্ষম করে তুলতে পারে।
যেকোনো মানসিক সমস্যার মোকাবেলা করতে হলে আগে দরকার সমস্যার লক্ষণগুলো চিহ্নিত করা ও একে গুরুত্ব দেয়া। কিন্তু আমরা শারীরিক রোগের মোকাবেলায় বেশি ব্যস্ত থাকি। জানি না, ভুলে যাই বা মানতে চাই না যে ঐ শারীরিক রোগের সাথে বিষণ্ণতা
একই সুতোয় আটকে আছে, তাকে মুক্ত করতে হলে তার চিকিৎসার প্রয়োজন। বিষণ্ণতা দৈহিক স্বাস্থ্যের ওপর যেমন বাড়তি চাপ দিচ্ছে তেমনি মানুষকে করে তুলছে অকর্মণ্য, নির্ভরশীল করে তুলছে অন্যের ওপর। এতে একদিকে রোগের চিকিৎসা করা যেমন কঠিন হচ্ছে তেমনি বাড়ছে চিকিৎসা ব্যয়। শারীরিক এই লক্ষণগুলো দেখা দিলে এদের অবহেলা না করে বরং নিজের মানসিক অবস্থার সাথে বোঝাপড়া করার প্রয়াস চালাতে হবে এবং প্রয়োজনমতো বিশেষজ্ঞের পরামর্শও নিতে হবে।
এসব মানসিক রোগের কারণে শারীরিক অসস্থ রোগীরা নিজের যত্ন নিতে পারেন না; অন্যের ওপর নির্ভরশীলতা ও দীর্ঘদিনের রোগের কারণে অনেকেই চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। আর চিকিৎসায় অবহেলার কারণে বেড়ে যাচ্ছে মৃত্যুঝুঁকি, মৃত্যুহার। এই হার কমানো জরুরি। হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় আন্তঃবিভাগ যোগাযোগ ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের রোগীর প্রয়োজনে নিজেদের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদান বৃদ্ধি করতে হবে; সেইসঙ্গে প্রথমিক স্বাস্থ্যসেবা থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসাকেন্দ্র পর্যন্ত রেফারেল ব্যবস্থা উন্নত ও সহজ করতে হবে। সর্বোপরি নিজের প্রতি নিজের খেয়াল রাখতে হবে সবার আগে। কারণ, আপনার সচেতনতাই আপনার সুস্থ জীবনযাপনের চাবিকাঠি।
করোনায় স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
করোনায় সচেতনতা বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও বার্তা দেখুন: সুস্থ থাকুন সর্তক থাকুন