যখন আপনি কিংবা আপনার পরিবার কোনও বিবাদের মুখোমুখি হবেন তখন আপনি কি করবেন?
এই পরিস্থিতিতে সমস্যা সমাধানের উপায় হিসেবে পারিবারিক থেরাপি প্রযোজ্য। পারিবারিক থেরাপির সাহায্যে পরিবারের বিভিন্ন সম্পর্কগুলোর মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগের অভাব মেটানো হয়। একজন পারিবারিক থেরাপিস্ট পরিবারের ভিতরের বিবাদের কারণ সন্ধান করে তা থেকে সৃষ্ট সমস্যার সমাধানে সহায়তা করে থাকে। থেরাপিস্টের লক্ষ্য থাকে পরিবারের সদস্য যেমন- স্বামী-স্ত্রী বা অভিভাবকদের সঙ্গে সন্তানদের অথবা পরিবারের অন্যান্য সম্পর্কগুলোর মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগের উন্নতি করা।
একটা পরিবারের অভ্যন্তরীণ নানারকম সমস্যার মোকাবিলার জন্য এই থেরাপি জরুরি-
- অভিভাবকত্বের সমস্যা
- পরিবারের বয়ঃসন্ধিকালীন ছেলে-মেয়ে ও শিশুদের আচরণগত সমস্যা
- পরিবারের প্রিয়জনের মানসিক অসুস্থতা দূর করতে এবং কীভাবে তার সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলা উচিত সে বিষয়েও এই থেরাপি সাহায্য করে। প্রিয়জনের মানসিক অসুখের বিরুদ্ধে মোকাবিলা করার জন্য একটা পরিবারের সদস্যদের অনেক লড়াই করতে হয়। এই লড়াই করার সঠিক রাস্তা দেখানোর জন্য পারিবারিক থেরাপি খুবই কার্যকরী।
- পরিবারের সদস্যদের যৌন অভিমুখ ও সমকামী সম্পর্কগুলো বোঝার ক্ষেত্রেও পারিবারিক থেরাপি সহায়তা করে
- বিয়ের পর দম্পতিরা যেসব সমস্যার মুখোমুখি হয় যেমন- পারিবারিক ভূমিকার বদল, ঘনিষ্ঠতাজনিত সমস্যা, দু’জনের মধ্যে সুদৃঢ় যোগাযোগ গড়ে তোলার জন্য থেরাপি দরকার
- এই থেরাপির সাহায্যে কোনও পরিবারের মধ্যে বিয়ের আগে পাত্র-পাত্রীর সম্পর্কের মধ্যে হস্তক্ষেপ করা যায়
- মাঝবয়সি দম্পতিদের মধ্যে একপ্রকার শূন্যতার বোধজনিত সমস্যার (এম্পটি নেস্ট সিনড্রোম) সমাধানের জন্যও পারিবারিক থেরাপি জরুরি
”কিন্তু আমার পারিবারিক থেরাপির কোনও প্রয়োজন নেই!”
অনেক মানুষই পরিবারের থেরাপিস্টের কাছে নিজেদের সমস্যার কথা বলতে দ্বিধা বোধ করে। কারণ তারা মনে করে যে একজন বাইরের লোকের সঙ্গে পরিবারের খুঁটিনাটি আলোচনা করা কখনোই ঠিক নয়।
আবার অন্য এমন কিছু মানুষ থাকে যারা থেরাপিস্টের সামনে পরিবারের সমস্যার কথা আলোচনা করতে ইচ্ছুক থাকে না সে ক্ষেত্রে তাদের সচেতনতার অভাব এবং কলঙ্কের বোধই প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে আবার এমন অনেক পরিবার থাকে যারা থেরাপির সাহায্য নিয়ে পরিবারের ভিতরের জটিলতাগুলোকে বোঝার চেষ্টা করে এবং নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নতি ঘটাতে চায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে থেরাপি সংক্রান্ত ভয় ও খোলা মনে একে গ্রহণ না করার মানসিকতা থেকেই পারিবারিক থেরাপি নিয়ে মানুষের মনে অনেক মিথের
জন্ম হয়েছে।
কীভাবে পারিবারিক থেরাপির প্রক্রিয়া চলে?
পারিবারিক থেরাপির মাধ্যমে পরিবারের প্রতিটি সদস্যের মনস্তাত্ত্বিক বিচার-বিশ্লেষণ করে তাদের সমস্যার কারণ খোঁজার এবং একটা পরিবারের গঠন বোঝার চেষ্টা করা হয়। সেই সঙ্গে পারিবারিক সমস্যার মূল কারণ খোঁজার ব্যবস্থাও করা হয়। এই প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপগুলো হল:
১. গুরুত্ব নির্ণয় ধাপ- এই ধাপে থেরাপিস্টের কাছে জানতে চাওয়া কয়েকটি প্রশ্নের উত্তরের মধ্য দিয়ে থেরাপি সম্পর্কে একটা পূর্ণাঙ্গ ছবি আমাদের সামনে ফুটে ওঠে, যেমন-
- কতক্ষণ এই পর্যায় চলবে?
- থেরাপি করতে কত সময় লাগবে?
- থেরাপি চলাকালীন কার উপস্থিতি একান্ত প্রয়োজনীয়?
- কীভাবে তথ্য গোপন রাখা হবে?
- কতটা অভিজ্ঞতা থেরাপিস্ট লাভ করলেন? অতীতে এই একই ধরনের কোনও সমস্যার মুখোমুখি থেরাপিস্ট হয়েছেন কি?
এই পর্যায়ে একজন থেরাপিস্ট পরিবারের কোনও একজন ব্যক্তি বা অনেক সদস্য মিলে গঠিত একটা দলের সঙ্গে প্রথমবার মুখোমুখি হন এবং ওই পরিবারের চলমানতা বা গতিময়তা বিষয়ক গুরুত্ব নির্ধারণ করেন। একটা পরিবারের পূর্ণাঙ্গ ধারণা বা গুরুত্ব কতগুলো বিষয়ের উপর নির্ভরশীল, যেমন- সীমারেখা, তার বংশপরম্পরাগত অবস্থান, সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয় প্রভৃতি। সীমারেখা বলতে বোঝায় পরিবারের সদস্যদের মধ্যে গড়ে ওঠা পারস্পরিক বিধিনিষেধ। এই সীমারেখা থাকতে পারে পরিবারের অভিভাবকের, যারা একরকম পারিবারিক নিয়মকানুন গড়ে তোলে (একে সাবসিস্টেমও বলে), তাদের সঙ্গে ওই পরিবারের পরবর্তী প্রজন্ম বা পরিবারের দূর সম্পর্কের আত্মীয়দের মধ্যে। বংশপরম্পরাগত অবস্থান হল পরিবার তথা পারিবারিক সদস্যদের মধ্যে ক্ষমতার বিন্যাস, যার প্রভাব সদস্যদের পারস্পরিক যোগাযোগ এবং কার্যকলাপের উপরেও পড়ে। যেমন- সাধারণত পিতৃতান্ত্রিক পরিবারে বংশপরম্পরাগতভাবে বাবারাই ক্ষমতার শীর্ষে থাকে।
একজন থেরাপিস্ট পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে অথবা যৌথভাবে ওই পরিবারের চলমান সমস্যা নিয়ে কথাবার্তা বলে পারিবারিক দ্বন্দ্বের কারণটা বোঝার চেষ্টা করে। এর সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের পারস্পরিক যোগাযোগের ধরনটাও তারা বোঝার চেষ্টা করে। এভাবেই থেরাপিস্ট মূল সমস্যা চিহ্নিত করার পথ খোঁজে।
পরিবারের সব সদস্য যদি পারিবারিক থেরাপির বিষয়ে আগ্রহী না হয় তাহলে ওই পরিবারের কোনও একজন সদস্য হিসেবে কেউ পারিবারিক সমস্যা সমাধানের জন্য বিশেষজ্ঞের সাহায্য চাইতে পারে।
২. প্রবেশ পর্ব- প্রথম পর্যায় অর্থাৎ গুরুত্ব নির্ধারণ পর্ব থেকে সংগৃহীত তথ্যের উপর নির্ভর করে থেরাপিস্ট একটা তত্ত্ব গড়ে তোলার চেষ্টা করে এবং সেই অনুযায়ী সুপারিশ করতে পরিবারের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে।
সমস্যার চরিত্রের উপর নির্ভর করে থেরাপিস্ট নানা উপায়ে তা সমাধান করার জন্য চেষ্টা করে। কগনিটিভ বিহেভায়রল থেরাপির নীতি ব্যবহার করে এক্ষেত্রে তারা তাদের চিন্তাভাবনা ও সমস্যার মূল্যায়নের বিষয়ে বদল আনতে চায়। এই পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে থেরাপির দ্বারা যে সমাধান সূত্র পাওয়া যায় তা পরিবারের সদস্যদের সাহায্য করে।
একটা আদর্শ পরিবারের মিথ বা প্রবাদ
আমরা সামাজিক জীব এবং আমাদের জীবনযাপনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত থাকে প্রতিবেশি,বন্ধুবান্ধব বা আমাদের ভাই-বোনদের পরিবার, পরিজনরা। আমাদের স্বাভাবিক চিন্তাভাবনা হল আমাদের পরিচত, পরিজনরা যাতে ভালো থাকে, খুশিতে থাকে এবং তারা জীবনে যা চায় তা সবকিছুই যেন তারা পায়। বিশেষজ্ঞদের মতে এটাই হল একটা আদর্শ পরিবারের মূল মন্ত্র বা মিথ। আদর্শ পরিবার বলতে সেইসব পরিবারকেই বোঝানো হয় যেখানে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগের কোনও সমস্যা থাকে না, তাদের পরস্পরের মধ্যে মতের অমিল থাকে না। তারা সবসময়ে একে অপরের সঙ্গে আনন্দে, খুশিতে মেতে থাকে।
এমন অনেক মানুষ রয়েছে যারা পারিবারিক থেরাপির সাহায্য নেয়, কারণ তারা বিশ্বাস করে যে এর ফলে তাদের পরিবার আদর্শ পরিবার হয়ে উঠবে। কিন্তু এই ধারণা ঠিক নয়। যদি পরিবারের মধ্যে সদস্যদের চিন্তাভাবনা বা মতামতের সহাবস্থান না থাকে এবং পারস্পরিক যোগাযোগের অভাব থাকে তাহলে পারিবারিক থেরাপির সাহায্য নিয়ে আগে সেইসব সমস্যার সমাধান করা জরুরি। এই সমাধানের মধ্য দিয়েই একটা পরিবার আদর্শ পরিবার হয়ে উঠতে পারে।
পারিবারিক থেরাপির বাইরে আর কী ধরনের সমাধান আমরা প্রত্যাশা করতে পারি?
অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে ধরে নেওয়া হয় যে পারিবারিক থেরাপি পরিবারের সদস্যদের মধ্যে থাকা সব সমস্যার স্থায়ী সমাধান করে দিতে পারে। কিন্তু এই ধারণা ঠিক নয়। এর জন্য আর কী প্রয়োজন-
- পেশাদার থেরাপিস্টের সাহায্য নিতে হবে যে আপনার সমস্যার কথা সহানুভূতি সহকারে শুনবে এবং এক্ষেত্রে নিজস্ব মতামতকে তেমন গুরুত্ব দেবে না
- পরিবারের অপরাপর সদস্যের কাছ থেকে নিজেদের কথপোকথন গোপন রাখতে হবে
- পারস্পরিক কথাবার্তা গঠনমূলক হওয়া জরুরি
- পরিবারের প্রত্যেক সদস্যকেই সমানভাবে কথা বলার সুযোগ দিতে হবে
- থেরাপিস্টদের কোনও একটা পক্ষ অবলম্বন না করে নিরপেক্ষভাবে কাজ করা প্রয়োজন এবং পারিবারিক দ্বন্দ্বের কারণ খুঁজে বের করে তা সমাধান করার চেষ্টা করা দরকার
এহেন থেরাপির কার্যকারিতা থেরাপি চলাকালীন পরিস্থিতির কতখানি উন্নতি ঘটছে তার উপর নির্ভর করে।
সূত্র: এই প্রবন্ধটি ভারতের নিমহ্যান্সের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ডঃ বীনা সত্যনারায়ণ এর লেখা থেকে নেওয়া হয়েছে।
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে চিকিৎসকের সরাসরি পরামর্শ পেতে দেখুন: মনের খবর ব্লগ
করোনায় মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক টেলিসেবা পেতে দেখুন: সার্বক্ষণিক যোগাযোগ
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
করোনায় সচেতনতা বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও বার্তা দেখুন: সুস্থ থাকুন সর্তক থাকুন