পৃথিবীর আলো দেখার পরে একটা শিশুর সর্বপ্রথম পরিচয় হয় তার মা-বাবার সাথে। কাজেই শিশুর উপরে তাঁদের নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব থাকে সবথেকে বেশি। কিন্তু কখনও কখনও অভিভাবকরা নিজেদের জীবনের যাঁতাকলে এমন ভাবে জড়িয়ে পড়েন, যে তাঁরা নিজেদের অজান্তেই সন্তানের বিভিন্ন চাহিদাকে অবহেলা করতে শুরু করেন। একে অমনোযোগী বা অযত্নশীল অভিভাবকত্ব শৈলী বলা হয়।
অভিভাবকত্ব শৈলী
অভিভাবকত্ব ও তাঁর বিভিন্ন ধরণ নিয়ে বহুদিন ধরে গবেষণা চলে আসছে। ১৯৬০ সাল নাগাদ উন্নয়নমূলক মনোবিজ্ঞানী ডায়ানা বাওম্রিন্ড বিভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে অভিভাবকত্বকে তিন ভাগে ভাগ করেন: আধিকারিক, স্বৈরাচারী এবং প্রশ্রয়শীল। সাম্প্রতিক কালে অন্যান্য গবেষকরা চতুর্থ ধরণ, অর্থাৎ অযত্নশীল অভিভাবকত্বকে এই তালিকায় যোগ করেন।
অযত্নশীল অভিভাবকত্বের বৈশিষ্ট্যগুলি হল:
- সন্তানের থেকে মানসিকভাবে বিচ্ছিন্ন থাকা এবং তার প্রতি কোনও আবেগ অনুভব না করা। সন্তানের আবেগগত চাহিদা যেমন প্রশংসা, নিরাপত্তা, ভালবাসা, আদর-যত্নকে উপেক্ষা করা।
- সন্তানের দিকে কোনও নজর না দেওয়া
- সন্তানকে তার প্রাপ্য স্নেহ-ভালবাসা না দেওয়া
- সন্তানের থেকে পড়াশুনায় বা চালচলনে কোনও উন্নতি আশা না করা
একজন শিশুকে অযত্নশীল অভিভাবকত্ব কীভাবে প্রভাবিত করে?
অভিভাবকদের দ্বারা করা অবহেলা সন্তানের ভবিষ্যৎ জীবনের উপরে সাংঘাতিক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ধরা যাক, একটি ছোট্ট বাচ্চা খেলতে খেলতে আরেকটি বাচ্চার হাত থেকে খেলনা কেড়ে নিল। তার অভিভাবক সেটা দেখেও কিছু বললেন না। একটা ছোট্ট শিশুর পক্ষে তার এই আচরণের নৈতিকতা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। সে হয়ত বুঝবেই না যে তার আচরণে আরেকজনের মনে আঘাত লাগতে পারে। অযত্নশীল অভিভাবকত্বের ফলাফল স্বরূপ নিম্নলিখিত পরিস্থিতিগুলি সৃষ্টি হতে পারে:
- নিজেকে উপেক্ষিত মনে করা: আশৈশব সন্তানের নিজেকে অপ্রয়োজনীয় বা অবাঞ্ছিত মনে হয়, ফলে তারা কোনও সম্পর্কের গুরুত্ব বুঝতে শেখেনা। তারা নিজেই নিজের মূল্য বুঝতে পারে না, যা তাদের ভবিষ্যতের সম্পর্কের ভিতকে নাড়িয়ে দেয়।
- কারোর প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়ার আতঙ্ক: যেহেতু এই ধরণের পরিস্থিতিতে বাচ্চারা ছোট থেকেই নিজেরটা নিজে বুঝতে শিখে যায়, তাই পরবর্তী জীবনে অনেক সময় তারা কারও প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়ার আতঙ্কে ভোগে। বিশেষত নতুন কোনও সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই মানসিকতা এক বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে উঠতে পারে।
- সামাজিক যোগাযোগ: শিশুদের মনে সামাজিক আচরণ সম্পর্কে ধারণা তাদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ থেকেই গড়ে ওঠে। কিন্তু শৈশব থেকেই বাড়িতে অবহেলিত হওয়ার কারণে তাদের মধ্যেও অন্যকে উপেক্ষা করার মতন মানসিকতা তৈরি হয়। বিভিন্ন গবেষণায় এটা দেখা গিয়েছে যে এই রকম পরিবেশে তাদের মধ্যে অসামাজিক ব্যাক্তিত্বের বিকাশ ঘটে, যার ফলে তারা স্বাভাবিক ভাবে কারও সাথে মিশতে পারে না।
- বুলিইং (নিপীড়ন): বাচ্চাদের মধ্যে বুলিইং আটকাতে মা-বাবার এক বিশাল ভূমিকা রয়েছে। কারণ একমাত্র তারাই পারেন সন্তানকে নিপীড়ন সম্পর্কে সঠিক শিক্ষা দিতে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে যেই সব বাচ্চারা অবহেলার মধ্যে বেড়ে ওঠে, তাদের সঙ্গী-সাথীদের বা বড় ভাই-বোনদের দ্বারা নিপীড়িত হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে, কারণ অভিভাবকেরা বাচ্চাদের জীবনের এবং বেড়ে উঠার সাথে নিজেদের জড়াতে পারেন না এবং সঠিক ব্যবহার শেখাতে উদ্যোগী হন না।
- মাদকাসক্তির সম্ভাবনা: নিজের পরিবারের সমর্থন বাচ্চাদের মধ্যে পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা বিকশিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে মা-বাবার দ্বারা করা অবহেলা অনেক ক্ষেত্রেই বাচ্চাদের মধ্যে নেশা করার প্রবণতা এবং আসক্তির সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে তোলে। এমনকি এটা শিশুর আচার-আচরণকেও ভীষণভাবে প্রভাবিত করে।
- লেখাপড়ায় অবনতি: যেহেতু বাড়ির তরফে সন্তানের কাছে কোনও প্রত্যাশা থাকে না, তাই তাদের মধ্যে জীবনে সাফল্য অর্জন করার কোনও আগ্রহ তৈরি হয়না। বিভিন্ন সমীক্ষায় বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেছেন যে এই রকম পরিস্থিতিতে বেড়ে উঠা বাচ্চাদের লেখাপড়ার প্রতি চূড়ান্ত অনাগ্রহ থাকে যা তাদের পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরে প্রতিফলিত হয়।
অভিভাবকরা কেন অবহেলা করেন?
মা-বাবারা কখনই নিজের সন্তানকে স্বেচ্ছায় অবহেলা করেন না। বাড়ির এবং আশেপাশের পরিস্থিতি যেমন আর্থিক অনটন, দাম্পত্য কলহ, বা পরিবারের কারও মৃত্যুর মত কঠিন সময়ে সন্তানের উপর সঠিকভাবে মনোযোগ দেওয়া সম্ভব হয়না। দুর্ভাগ্যবশত সন্তানের উপর এর প্রভাব মারাত্মক হতে পারে।
আমি কীভাবে বুঝব যে আমি সন্তানকে অবহেলা করছি?
- সন্তানের ব্যাক্তিগত ও পেশাদারী জীবনে কি চলছে সেটা না জানা।
- বাড়িতে সন্তানকে মন খুলে কথা বলার সুযোগ না দেওয়া বা তার সমস্যা নিয়ে কথা বলার পরিস্থিতি না রাখা।
- সন্তানের সঙ্গে যথেষ্ট সময় না কাটানো বা তাদেরকে অনেকটা সময় বাড়িতে একলা ছেড়ে দেওয়া।
- সন্তানের বন্ধু-বান্ধব বা শিক্ষক-শিক্ষিকা সম্পর্কে কোনও ধারণা না থাকা।
- সন্তানকে যথেষ্ট সময় না দেওয়ার জন্য স্কুলে বা আত্মীয়দের সামনে নানা রকম অজুহাত দেওয়া।
কী করা যেতে পারে?
যদি আপনি দেখেন যে আপনার সন্তান অগোছালো থাকছে, স্কুল যাচ্ছে না, অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে অথবা সব সময় আলাদা বা বিচ্ছিন্ন থাকার চেষ্টা করছে তাহলে তার জীবনের সাথে নিজেকে আরও বেশি করে জড়ানোর চেষ্টা করুন। আপনি হয়ত তার পড়াশুনা দিয়েও ব্যাপারটা শুরু করতে পারেন। তার পছন্দ-অপছন্দ সম্পর্কে আপনার একটা স্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন।
যে সমস্ত মা-বাবারা এই ধরণের পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের অবিলম্বে মনোবিদের সাথে যোগাযোগ করা উচিত, যাতে তারা সুস্থ অভিভাবকত্বে ফিরতে পারেন। এমনকি সংশ্লিষ্ট শিশুরও কাউন্সেলিং প্রয়োজন। সবার আগে প্রয়োজন সমস্যার অস্তিত্বকে স্বীকার করা। যদি আপনার মনে হয় যে আপনার জীবন সাথী আপনাদের সন্তানকে পর্যাপ্ত সময় দিচ্ছেন না, তাহলে তার সাথে এই নিয়ে কথা বলুন। তার পরে আপনারা ডাক্তার, কাউন্সেলর অথবা থেরাপিস্টের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন যাতে সন্তানের প্রতি অবহেলা এড়ানো যায়।
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে চিকিৎসকের সরাসরি পরামর্শ পেতে দেখুন: মনের খবর ব্লগ
করোনায় মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক টেলিসেবা পেতে দেখুন: সার্বক্ষণিক যোগাযোগ
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
করোনায় সচেতনতা বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও বার্তা দেখুন: সুস্থ থাকুন সর্তক থাকুন