কোন কথায় কবিতা হয় আর কোন কথায় কবিতা হয় না, এর কোনো ব্যাকরণ নেই, সুনির্দিষ্ট মানদন্ড নেই। তবু হঠাৎ কখনো টের পাই, মনের মধ্যে বেজে ওঠে একটি কথা। কী কথা? কীভাবে বাজে? কীরকম শব্দে, সুরে?
সেই বেজে উঠা কথাটাই কি কবিতা? যে-কথা বাজে না কিন্তু নিঃশব্দে বয়ে চলে মনের মধ্যে, তা কি কবিতা হয়ে ওঠে না? কোনো কথা বাজে, কোনো কথা নেচে যায়, কোনো কথা আস্তে আস্তে দূরে চলে যায়। কোনো কথা শোনা মাত্রই মনের মধ্যে পুড়ে যায়, কথা জ্বলে ওঠে আগুনের মতো। কথার এত শক্তি! কথাই কি কবিতা? কথা আর কথা মিলে কয়েকটা বাক্য হয়ে সামনে দাঁড়ায়। তখন হয়তো কথা হয় বাক্যের সঙ্গে। মনে মনে। মনে মনে এইসব যে হয়, যে কবিতা পড়েছে, তার বাইরে আর কেউ জানতে পারেনা। ‘পাশে শুয়ে থাকা বধুটিও টের পায় না। সে কারণেই, আমি এর আগেও বলেছি এবং এখন আরেকবার বলব, কবিতা একটি অসুখের নাম। এই অসুখ কারো কারো হয়, তখন তারা কবিতা পড়ে। যে-যার মতো একা একাই পড়ে। পড়ে আর কবিতার রোদে পোড়ে। কবিতা পড়ে আর বিছানায় শুয়ে ঘরের মধ্যেই ভেজে। পাখি হয়ে আকাশে ডানা মেলে দেয়। যদিও মানুষের কোনো ডানা নেই। টোকন ঠাকুরের তিন লাইনের একটি কবিতা পড়েছিলাম পত্রিকায়। সেই কবিতার নাম-জাহাজি ভাবনা। কবিতাটি হচ্ছে, ‘যদি বন্দরে তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পাই/ জাহাজ ভেড়াব না/ অর্ডার করব, কাপ্তেন গভীর সমুদ্রে চলো।’ একবিতা পড়ার পর আমার মনে হলো, টোকন ঠাকুরের একটা জাহাজ আছে। অন্তত একজন কাপ্তেনও সেখানে চাকরি করেন। বন্দরে জাহাজ না ভিড়িয়ে তিনি গভীর সমুদ্রে চলে যাবার একটা হুমকি থ্রো করছেন। এসব ঘটছে, কিন্তু সবই মনে মনে ঘটছে। কবিতায় ঘটছে। ইচ্ছের মধ্য দিয়ে ঘটছে। ইচ্ছারাই তাই কবিতা। ইচ্ছেগুলো থাকে কোথায়? ইচ্ছেরা আমায় পায় কবিতায়। কবিতা গেঁথে যায় মনে। মনই বা থাকে কোথায়? মন কে? মন কি? মনের বাসা-বাড়ি কোন এলাকায়? মন ভেঙে যায় কীভাবে? মন উড়ে যায় কীভাবে? মন পুড়ে যাওয়া জানি, মন ঘোঁড়া হয় কীভাবে? আর মন নীল হতে হতে, সরে যেতে যেতে দূরে যেতে যেতে আকাশ হয়ে যায় নাকি? কবিতা ও এরকম আকানোর মতো, নীল? ছাপা তো হয় দেখি কালো কালির অক্ষরে, কিন্তু কবিতাটি কি ছাপানো অক্ষরের মধ্যেই আটকা পড়ে থাকে? নাকি পাঠক বা পাঠিকা তা পড়ামাত্রই ছাপানো অক্ষর থেকে উঠে আসে তার মনে! তখন দ্বিতীয়বার কবিতাটি মনের মধ্যে ছাপা হয়। যে পাঠক, যে পাঠিকা, তার মনে ছাপা হয়ে থাকা কবিতাটি অন্য কেউ আর পড়তে পারে না। মনে মনে ছাপা হয় কত কবিতা! কবিতায় ছাপা হয় মন, কালো কালো অক্ষরে। কিংবা কোনো অক্ষর-শব্দ-বাক্য ছাড়াই কিছু কবিতা ছাপা হয়। আমার মনেও সেরকম কবিতা আছে। মনে মনে লেখা, মনে মনে ছাপা হওয়া আমি সেই কবিতার একমাত্র পাঠক। যেমন কেউ আছে কোথাও, তার মত করে একমাত্র পাঠিকা। রাত জেগে, পরীক্ষার পড়া না পড়ে, সে হয়তো পড়ছে ‘জাহাজি ভাবনা’ কবিতাটি।
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।