২৬ জুন আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবস। এটি শুধু একটি দিন নয়, বরং একটি প্রতিজ্ঞা—মাদকমুক্ত সমাজ গঠনের অঙ্গীকার। আধুনিক সভ্যতার নানা অগ্রগতি সত্ত্বেও মাদক আজ আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক ভয়াবহ হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তরুণ সমাজ আজ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে। শুধু ব্যক্তিগত জীবন নয়, পারিবারিক বন্ধন, সামাজিক শান্তি ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাও মাদকের কারণে চরম সংকটে পড়ছে। তাই এই দিবসটিকে ঘিরে নতুন করে আমাদের ভাবতে হবে—কীভাবে মাদকমুক্ত ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে যাওয়া যায়।
দিবসটির ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট
আন্তর্জাতিকভাবে মাদকবিরোধী সচেতনতা গড়ে তোলার লক্ষ্যে জাতিসংঘ ১৯৮৭ সালে ২৬ জুনকে “International Day Against Drug Abuse and Illicit Trafficking” হিসেবে ঘোষণা করে। এই ঘোষণা আসে মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও চোরাচালানের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক লড়াইকে জোরদার করার অংশ হিসেবে।
এই প্রচেষ্টায় UNODC (United Nations Office on Drugs and Crime) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট থিমের মাধ্যমে দিবসটি পালিত হয়—যার মাধ্যমে জনসচেতনতা বাড়ানো ও রাষ্ট্রীয় নীতিমালার কার্যকর বাস্তবায়নের আহ্বান জানানো হয়।
মাদকের বৈশ্বিক প্রভাব
বিশ্বজুড়ে মাদকের বিস্তার এক ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। UNODC এর ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতি ১৮ জনের মধ্যে ১ জন কোনো না কোনোভাবে মাদকাসক্ত। আফগানিস্তানের আফিম উৎপাদন থেকে শুরু করে ল্যাটিন আমেরিকার কোকেন ব্যবসা—সবই আজ বিশ্ব অর্থনীতি, রাজনীতি ও নিরাপত্তাকে প্রভাবিত করছে।
মাদক সম্পর্কিত অপরাধ, সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন, সংঘাত সৃষ্টি, স্বাস্থ্যঝুঁকি, এবং পারিবারিক ভাঙন—সব কিছুই এই বিপর্যয়ের আওতাভুক্ত। এই বৈশ্বিক সংকটে উন্নয়নশীল দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মাদক সমস্যা
বাংলাদেশে মাদকের চিত্র ক্রমেই ভয়াবহ হয়ে উঠছে। ইয়াবা, ফেন্সিডিল, গাঁজা, আইস ও হেরোইনের বিস্তার রাজধানী থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও পৌঁছে গেছে।
বিশেষ করে সীমান্তবর্তী এলাকা ও চোরাচালান রুটগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এক ভয়ানক মাফিয়া চক্র। রাজনৈতিক প্রশ্রয়, প্রশাসনিক দুর্বলতা ও বিচারহীনতা এই সংকটকে আরও গভীর করেছে।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হচ্ছে—তরুণ ও শিক্ষার্থী সমাজের মধ্যে মাদকের ব্যবহার আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। আইন থাকলেও এর সঠিক প্রয়োগে রয়েছে ঘাটতি, ফলে অনেক ক্ষেত্রেই অপরাধীরা শাস্তি এড়িয়ে যাচ্ছে।
মাদকের সামাজিক ও পারিবারিক ক্ষতি
মাদক শুধু ব্যক্তি নয়, পুরো পরিবারকে ধ্বংস করে দেয়। একজন আসক্ত ব্যক্তির কারণে পরিবারে সৃষ্টি হয় অর্থনৈতিক সংকট, পারস্পরিক অবিশ্বাস ও সহিংসতা। অনেক সময় দেখা যায়, মাদকাসক্ত পরিবারের সদস্য আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে বা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। শিশু-কিশোরদের ভবিষ্যৎ হয়ে পড়ছে অন্ধকারাচ্ছন্ন। মানসিক স্বাস্থ্য হ্রাস, আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি ও সমাজবিচ্ছিন্নতা তৈরি করছে একটি বিপথগামী প্রজন্ম।
মাদক নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রের করণীয়
মাদক প্রতিরোধে কেবল আইন তৈরি করলেই হবে না, বরং তার কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। সীমান্ত এলাকায় নজরদারি বৃদ্ধি, চোরাচালান প্রতিরোধে প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবস্থা, এবং পুলিশের মধ্যে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়াতে হবে।
দেশে থাকা মাদক পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলো (Rehabilitation Centers)-এর মানোন্নয়ন, পরিকাঠামো উন্নয়ন ও কাউন্সেলিং সুবিধা বাড়ানো অপরিহার্য। এছাড়া, প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে মাদক সংশ্লিষ্ট দুর্নীতি নির্মূল করতে হবে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সামাজিক চাপ—এই দুইয়ের সমন্বয়ে গড়ে উঠতে পারে একটি কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা।
তরুণদের করণীয় ও সচেতনতার ভূমিকা
তরুণ সমাজ শুধু মাদকের শিকার নয়, বরং তারা হতে পারে এই যুদ্ধে প্রধান সৈনিক। সমাজে একটি সচেতন যুব আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার যেখানে তরুণরা নিজেরাই মাদকবিরোধী বার্তা ছড়িয়ে দেবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মিত সচেতনতামূলক কর্মসূচি, বিতর্ক, নাটক, এবং তথ্যচিত্র প্রদর্শনের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তোলা যেতে পারে। সামাজিক মিডিয়া, ইউটিউব ও গণমাধ্যমেও মাদকবিরোধী প্রচার চালানো দরকার, কারণ এই প্ল্যাটফর্মগুলো তরুণদের কাছে সবচেয়ে প্রভাবশালী।
সকলের প্রতি আহ্বান
মাদকের বিরুদ্ধে লড়াই কেবল সরকারের একার কাজ নয়—এটি একটি সম্মিলিত সামাজিক, পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। এই ভয়ংকর নেশাজাল থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করতে হলে এখনই সময় একসাথে কাজ করার। ২৬ জুন যেন শুধু একদিনের আনুষ্ঠানিকতা না হয়—বরং এটি হোক প্রতিদিনের অঙ্গীকার। পরিবারে শিশুদের সুরক্ষা, সমাজে সচেতনতা, রাষ্ট্রে কঠোরতা—এই তিনে মিলেই গড়ে উঠতে পারে একটি মাদকমুক্ত ভবিষ্যৎ।