“তাসলিম সাহেবের (৭২ বঃ) আজ খুব মন খারাপ। গত কয়েক দিনের মত আজো তিনি ফজর নামায পরে হাঁটতে বেরিয়েছিলেন। এই সময়টাতেই এলাকায় তাঁর বয়সি অন্যান্যদের সাথে দেখা হয়, গল্প হয়। ফিরে আসার পর থেকে বাড়ির কেউই আর তাঁর সাথে কথা বলছে না আজ। এমনকি যদি তিনি এভাবে বের হন, তার নাতিকেও নাকি কাছে আসা মানা! তাঁর হার্টে ২টা রিং পরানো আছে, ইনসুলিন ও নিয়মিত নিচ্ছেন, ইদানিং অ্যাজমার সমস্যাটাও বেড়েছে। বাড়ির লোকজন শুধুশুধুই বাড়াবাড়ি করে তাঁকে নিয়ে! কতবার মৃত্যুর হাত থেকে তিনি ফিরে এসেছেন আর এই “করোনা ভাইরাস” তাঁর কি করবে! একদিন তো মরে যেতেই হবে! বারান্দায় বসে দীর্ঘ্যশ্বাস ফেলে একাএকাই ভাবতে থাকেন তিনি।”
“করোনা ভাইরাস” আপদকালীন সময়ে আমাদের যাদের পরিবারে বয়ঃজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিরা আছেন, আমরা প্রত্যেকেই তাদের নিয়ে খুবই দুশ্চিন্তায় আছি আর তা হওয়াই স্বাভাবিক। কেননা স্বাস্থ্যগত কারনেই এই বয়সে তুলনামুলকভাবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়। সেক্ষেত্রে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মূখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে যা তাঁকে আত্নবিশ্বাসী করতে সাহায্য করবে। শারীরিক যত্নের পাশাপাশি মানসিক যত্ন-ও ভীষণভাবে গুরুত্বপূর্ন। তিনি যেন মনে না করেন যে সবাই শুধু তাঁকেই উপদেশ দিচ্ছে তাই বাড়ির সবাইকে নিয়ে এক সাথে বসে কথা বলতে হবে।
যা যা করতে হবেঃ
১. সহজ ভাষায় বুঝিয়ে বলা এটি একটি ছোঁয়াচে রোগ। এখন পর্যন্ত এর কোন চিকিৎসা নেই এবং এর সংক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য ঘরে থাকা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার গুরুত্ব কতখানি তা ব্যাখ্যা করা।
২. “করোনা” প্রতিরোধের প্রতিটি উপায়ের গুরুত্ব বুঝিয়ে বলা যেমন, ২০ সেকেন্ড সময় নিয়ে হাত ধোয়া, কনুই দিয়ে ঢেকে হাঁচি-কাশি দেয়া, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা, মাস্ক ব্যবহার ইত্যাদি।
৩. মৃত্যু ভয় কিম্বা হাঁচি কাশি হলেই “করোনা” আতঙ্ক যেন না হয় সেজন্য আগে থেকেই এ নিয়ে কথা বলা। ডিপ ব্রেথ অনুশীলন (অন্তত ৫মিনিট), মেডিটেশন, যার যার ধর্ম অনুযায়ি নিয়মিত প্রার্থনা করা।
৪. বাড়ির ভেতরেই তাঁর জন্য হাঁটার নির্দিষ্ট স্থান করে দেয়া।
৫. বয়ঃজ্যেষ্ঠদের-ও গৃহস্থালির টুকটাক কাজ দেয়া, এতে তাঁদের ফ্রি-হ্যান্ড এক্সারসাইস-ও হবে। যেমন, গাছে পানি দেয়া, পোষা প্রানী থাকলে খাবার দেয়া, নিজের কাপড়/ বুকশেল্ফ গোছানো (অবশ্যই ধূলা নয়) ইত্যাদি।
৬. ঘরে বসে লুডু, কেরাম, দাবা, চোর-পুলিশ, শব্দ-জব্দ খেলা, পাযেল বক্স মিলান, গল্পের বই পড়ে শোনান কিম্বা অন্য কোন খেলার ব্যাবস্থা করা। দুই জন করে দলে ভাগ হয়ে নেয়া যেতে পারে।
৭. পুরনো ছবির এলবাম বের করে একসাথে দেখা এবং স্মৃতিচারণ করা।
৮. সংসার জীবনের গল্প কিম্বা বিগত দিনের দুর্যোগকালিন সময়ের অভিজ্ঞতা স্মৃতিচারণ করা।
৯. পছন্দের খাবার, গান, বই, ম্যাগাজিন, টিভি দেখা কিম্বা তাঁর পছন্দের কাজগুলো দিয়ে একে একে দৈনিক এবং সাপ্তাহিক রুটিন করা।
১০. সম-বয়সি, আত্মীয়, প্রতিবেশিদের সাথে প্রয়োজনে ভিডিও কলের মাধ্যমে কথা বলার ব্যবস্থা করা।
১১. বাড়ির ছোটদের পড়ালেখার খোঁজ খবর নেয়া, পড়ার টেবিলে অন্তত ২০-৩০ মিনিট সময় দেয়া।
১২. হোম কোয়ারেন্টাইন সময় শেষ হলে কোথায় কোথায় বেড়ানো হবে সেই পরিকল্পনা করা।
১৩. অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা মাথায় রেখে খাবার নিয়ন্ত্রন ও পর্যাপ্ত পরিমান পুষ্টিকর খাবার যেমন, শাকশব্জি, ফলমুল, পানি এবং পানি জাতীয় খাবার গ্রহন।
১৪. নিয়মিত যে চিকিৎসককে দেখানো হত তাঁর সাথে কথা বলে রাখা যেন যে কোন প্রয়োজনে সহযোগিতা পাওয়া যায় এবং প্রয়োজনে দ্রুত স্বাস্থ্যসেবা নেয়া।
১৫. প্রয়োজনীয় ওষুধ, ইঞ্জেকশন, ইনহেলার জাতীয় জিনিস পর্যাপ্ত পরিমানে রাখা এবং শেষ হবার আগেই আনা।
১৬. পর্যাপ্ত ঘুম এবং বিশ্রাম হচ্ছে কিনা খেয়াল রাখা।
যা যা এড়িয়ে চলতে হবেঃ
১. সৃষ্টিকর্তা/ ধর্মীয় বিশ্বাস/ মূল্যবোধ-কে আঘাত করে এমন কিছু বলা।
২. বয়সের কারনে তিনি এই ভাইরাসে বেশি ঝুঁকির মাঝে আছেন সরাসরি বলা।
৩. কথা শুনতে না চাইলে চিৎকার চেঁচামেচি কিম্বা “আপনার জন্য আমরা সবাই মরব, আমাদের দিকে আপনার কোন খেয়াল নাই” এই রকম কথা বলা।
৪. একটি রুমে সারা দিনরাত একা থাকা এবং অতিরিক্ত শুয়ে-বসে থাকা।
৫. নিজেকে গুরুত্বহীন/ বোঝা মনে করেন এমন কিছু বলা বা আচরণ করা।
৬. “করোনা ভাইরাস” সংক্রান্ত অতিরিক্ত নেতিবাচক বা ভয়াবহ খবর দেয়া।
পরিশেষে একটি কথাই মনে রাখতে হবে তাঁর জীবনে অসংখ্য চড়াই-উতড়াই পেরিয়েই আজ তিনি এই অবস্থানে। তাঁর অভিজ্ঞতার ঝুলিটা আমার, আপনারচেয়ে অনেক বেশি তাই যথাযথ সম্মান নিয়েই যেন আমরা তাঁদেরকে এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে সাহায্য করি।
Home করোনায় মনের সুরক্ষা টিপস্ হোম কোয়ারেন্টাইন:পরিবারের বয়ঃজ্যেষ্ঠ ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন