কোভিড-১৯ যেমন সাধারণ মানুষদের মধ্যে স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করেছে তেমনি স্বাস্থ্যকর্মীদের মাঝেও নানা ধরণের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে যা স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের জীবন ও তাদের সেবা প্রদানকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
করোনা মহামারী যে শুধু সাধারণ মানুষের জীবনকেই দূর্বিষহ করে তুলেছে তা নয়। এই মহামারীর সময়ে আমাদের সব থেকে বড় বন্ধু এবং নিঃস্বার্থ ভাবে আমাদের সব সমস্যায় সেবা প্রদানকারী ব্যক্তিরাও বিভিন্ন সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছেন। এখনো প্রতি দিন লক্ষ লক্ষ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে এবং অগণিত মানুষ মৃত্যুবরণ করছে। আর এই অসম্ভব খারাপ পরিস্থিতির সাথে সামনে থেকে লড়াই করে যাচ্ছেন যারা তারা হলেন আমাদের স্বাস্থ্যকর্মী গণ। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম আমাদের সুস্থ থাকার প্রেরণা যোগায়। তাদের স্নেহপূর্ণ সেবা শুশ্রূষা অসুস্থ রোগীর মনে সুস্থ হওয়ার আত্মবিশ্বাস যোগায়।
কিন্তু এই অসুস্থ পরিস্থিতির সাথে লড়াই করতে করতে এসব মানব সেবায় নিয়োজিত মানুষেরাও আজ ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন। চোখের সামনে প্রতিষেধকের অভাবে হাজার হাজার মানুষের অসহায় মৃত্যু তাদের মাঝেও চরম হতাশা এবং বিষণ্ণতা সৃষ্টি করেছে। চেষ্টা করেও তারা পীড়িত মানুষদের কোন সহায়তা করতে পারছেন না। চোখের সামনে হাজার হাজার মানুষের অসহায় মৃত্যু তাদের দেখতে হচ্ছে। এই অসহায়তা তাদের মাঝে চরম মানসিক চাপ এবং হতাশার জন্ম দিয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে অনেকের মাঝে এই মানসিক সমস্যা গুলো এতোটাই গুরুতর হয়ে উঠছে যে তাদের মাঝে অন্যান্য সমস্যার সাথে সাথে আত্মহত্যার মত প্রবণতাও অনেকাংশেই বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই এই সমস্যাগুলোর অতি দ্রুত সমাধান করা প্রয়োজন যাতে আমাদের সমাজ বাঁচার আশা জিয়িয়ে রাখতে পারে।
স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারী চিকিৎসকগণ এই পেশায় আসার পূর্ব থেকেই নিজেদের মানসিকভাবে প্রস্তুত রাখেন যে তাদের অনেক কঠিন সময়ের মোকাবেলা করতে হবে। কিন্তু কোভিড-১৯ এই মানসিক প্রস্তুতিকেও যেন ছাপিয়ে গেছে। কোভিড-১৯ তাদের সেই স্বাভাবিক মানসিক চাপের সীমার উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করেছে। তারা প্রত্যহ নিজেদের সংক্রমণের সাথে সাথে তাদের থেকে তাদের পরিবার পরিজন এবং কাছের মানুষদের সংক্রমিত হয়ে পড়ার আশঙ্কায় রয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রেই এটা বোঝা সম্ভব হচ্ছেনা যে কারা সংক্রমিত এবং কারা সংক্রমিত নয়। তাই স্বাস্থ্য সেবা প্রদান করতে গিয়ে সকল সময় এক মানসিক চাপের মাঝে থাকতে হচ্ছে যা তাদের স্বাভাবিক কাজে বাধার সৃষ্টি করার সাথে সাথে তাদের মাঝেও বিভিন্ন মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করছে। তাদের মাঝে সব মানসিক চাপ সহ্য করার ধারণা এবং এই নতুন সৃষ্ট মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো একে অপরের সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে উঠেছে।
আমাদের সমাজে একটি ধারণা প্রচলিত আছে যে চিকিৎসকদের কোন রোগ ব্যাধি হয়না বা হলেও তারা নিজেরাই নিজেদের সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম। তাদেরও যে সহায়তার প্রয়োজন হতে পারে এটা যেন এক অভাবনীয় বিষয়। আর এ কারণেই অধিকাংশ চিকিৎসকই তাদের এই মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না আবার অনেকে ভাবছেন এই সমস্যা তারা নিজেরাই সমাধান করতে পারবেন। এই মানসিকতাই তাদের মধ্যে উৎপন্ন নানা ধরণের মানসিক সমস্যা গুলো সমাধানের পথে প্রধান অন্তরায়। কিন্তু করোনা কালে বাড়তে থাকা মানসিক সমস্যা ধীরে ধীরে তাদের সমস্যা আরও বাড়িয়ে তুলছে এবং এই সমস্যাগুলো তাদের শরীরের উপরেও প্রভাব ফেলছে। সব মিলে তাদের পেশা এবং জীবনের উপর এর চরম নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এক দিকে তারা তাদের মানসিক সমস্যার সমাধানে ব্যর্থ হচ্ছেন আবার অন্য দিকে নিজেদের পেশাগত কাজেও সমস্যার মুখে পড়ছেন। তারা সামাজিকতা বজায় রাখতে গিয়ে নিজেদের এবং একইসাথে তাদের রুগিদেরকেও ঝুঁকির মাঝে ফেলছেন যা একেবারেই কাম্য নয়।
স্বাস্থ্যকর্মীরাও যে আমাদের মতোই রক্ত মাংসে গড়া মানুষ এই মানসিকতা আমাদের সবার মাঝে গড়ে তুলতে হবে। তাদেরও আমাদের মত সব ধরণের মানসিক ও শারীরিক সমস্যায় সেবা নেওয়ার অধিকার এবং প্রয়োজন রয়েছে। তাই এর সুষ্ঠু সমাধান অতি আবশ্যক। তাদের জটিলতাগুলো নিয়ে খোলামেলা আলোচনার প্রয়োজন যাতে তারা তাদের মানসিক সমস্যাগুলোকে স্বাভাবিক ও ইতিবাচক ভাবেই দেখতে পারেন, সমস্যাগুলো প্রকাশ করতে উৎসাহিত হন এবং সমাধানের চেষ্টা করেন। তাদের মানসিক ও শারীরিক ভাবে সুস্থ থাকার উপর অনেকাংশেই আমাদের ভালো থাকা নির্ভর করছে। তাই স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারীদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো নিবারণে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
সূত্র: https://www.psychologytoday.com/intl/blog/view-the-mist/202009/healing-our-healers
অনুবাদ করেছেন: প্রত্যাশা বিশ্বাস প্রজ্ঞা
করোনায় স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে