বাংলাদেশের সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে জানানো, কিশোর বয়েসী ছেলেমেয়েদের মানসিক চাপ সামলানোর জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মনোবিদ নিয়োগ দেবার কথা ভাবা হচ্ছে। সম্প্রতি একটি সভায় শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মনোবিদ নিয়োগের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়েছে বলেও জানান।
এ বছরের শুরুতে দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, মাদরাসা ও স্কুলে পরামর্শক বা কাউন্সেলর ও মনোবিদ নিয়োগ দেয়ার নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না তা জানতে চেয়ে একটি রুল জারি করেছে হাইকোর্ট। সরকার বলছে, দ্রুতই আদালতের জারি করা রুলের জবাব তারা দেবে।
সম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম বিবিসি। সেটি মনের খবর পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল। ওই প্রতিবেদনে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বিবিসিকে বলেছেন, সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মনোবিদ নিয়োগের কাজটি করার জন্য যথেষ্ঠ আর্থিক সক্ষমতা এ মূহুর্তে সরকারের নেই।কিন্তু তা সত্ত্বেও উঠতি বয়েসী ছেলেমেয়েদের মানসিক স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাউন্সেলর এবং মনোবিদ নিয়োগের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে জানিয়ে মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেন “ইতিমধ্যে এ নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে একটি ফিজিবিলিটি ও প্রয়োজন যাচাই করে রিপোর্ট দেবার জন্য। সে রিপোর্ট পাবার পর এ নিয়ে কাজ শুরু হবে। এক্ষেত্রে সরকারের অর্থনৈতিক সামর্থও বিবেচনায় রাখা উচিত। হয়তো সব প্রতিষ্ঠানে এখনি আমরা নিয়োগ দিতে পারবো না, প্রয়োজন অনুযায়ী দেবার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। তবে, স্কুলে আইসিটি পড়ানো শুরুর সময় দেখা গিয়েছিল পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত শিক্ষক নেই, আস্তে আস্তে সক্ষমতা বাড়ছে আমাদের। এখানেও সেটা হবে।”
উপমন্ত্রী আরো বলেন, বর্তমান ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার চাপ কমানো এবং স্কুলের শিক্ষকদের মাধ্যমেই পড়াশুনার সাথে সাথে কাউন্সেলিং যাতে করা যায়, সেদিকে সরকার আরো নজর দেবে। সেজন্য শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও বাড়ানো হবে বলে তিনি জানিয়েছেন।
কেন মানসিক চাপে ভোগে ছেলেমেয়েরা?
বয়ঃসন্ধিকালে সারা পৃথিবীতেই ছেলেমেয়েরা নানা রকম মানসিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। আর হরমোনের নানা পরিবর্তনের সাথে সাথে যুক্ত হয় পরিবার ও সমাজের প্রত্যাশার চাপ। ভালো স্কুলে সুযোগ পাওয়া, ভালো ফল, সহ-শিক্ষা কার্যক্রমে সাফল্য এমনতর নানাবিধ চাপ তৈরি হয় ছেলেমেয়েদের ওপর। পড়াশোনার চাপ, ভালো ফলাফলের জন্য মাবাবাদের অতি প্রত্যাশা, ইভটিজিং ও বুলিয়িং ইত্যাদি নানাবিধ কারণে বয়:সন্ধিকালে ছেলেমেয়েরা মানসিক চাপে ভোগে। এছাড়া সমবয়েসী অন্য ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তুলনা, ইভটিজিং, এবং স্কুলে সিনিয়রদের কাছে বুলিয়িং শিকার হবার মত ঘটনাও ঘটে। এসব ঘটনাও কিশোর বয়েসীদের মনে প্রবল চাপ সৃষ্টি করে। সেই সঙ্গে হয়ত এ প্রজন্মের সঙ্গে আগের প্রজন্মের মানুষ মানে মা-বাবাদের সম্পর্কে ঘাটতির কারণে এক ধরণের দূরত্বও থাকে। দেখা যায় হয়ত এ কারণেই ছেলেমেয়েরা তাদের রোজকার জীবনের কথা পরিবারের কাছে খুলে বলতে চায় না। এ বিষয়টি অনেক মা-বাবাই থাকেন উদ্বিগ্ন।
ঢাকার একটি স্কুলের সামনে অপেক্ষমান কয়েকজন মা, যাদের সন্তানেরা সবাই বয়সন্ধিকাল পাড়ি দিচ্ছে, বিবিসিকে বলছিলেন, তাদের উদ্বেগের কথা। “অনেক কিছুই বলে না, চেপে যায়। এজন্য খুব টেনশন লাগে। আমাদের হয়ত ভয় পায় না, কিন্তু শেয়ার করতে চায় বন্ধুদের সঙ্গেই। যাদের একটির বেশি সন্তান, হয়ত দেখা যায় মেয়েটিকে সাথে করে সবখানে যাচ্ছি, কিন্তু ছেলের সাথে যে খারাপ কিছু হবে না, সে গ্যারান্টি তো কেউ দিতে পারবে না।”
সামাজিক ট্যাবু
বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি নিয়ে কথা বলার ক্ষেত্রে এক ধরণের সামাজিক ট্যাবু কাজ করে। বেশির ভাগ মাবাবা বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চান না। বিশ্লেষকেরা বলছেন, মাবাবাদের এই কথা না বলা বা বিষয়টি এড়িয়ে যাবার কারণে ছেলেমেয়েদের জীবনে ভয়াবহ দুযোর্গ নেমে আসতে পারে। অনেকেই না বুঝে ভুল সঙ্গে পড়ে বিপথগামী হয়, কেউ মাদকাসক্তিসহ নানা রকম অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে, কেউবা আবার আত্মহণনের পথ বেছে নেয়। ২০১৯ সালের শেষ দিনটিতে জেএসসি ও পিএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ হবার পরে, পরীক্ষায় আশানুরূপ সফলতা অর্জন হয়নি বলে দেশে তিনজন শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু সন্তানের ওপর নানাবিধ মানসিক চাপ ও তাদের ব্যাক্তিত্বে পরিবর্তনের বিষয়টি নিয়ে শহুরে মা-বাবার মধ্যে যতটা সচেতনতা আছে, গ্রাম বা মফস্বলের ছেলেমেয়েদের ক্ষেত্রে সেটি এখনো ততটা গুরুত্ব পায় না।
কাজে আসবেন মনোবিদ
পরিবার গুলোতে এক ধরণের সামাজিক ট্যাবুর কারণে যেহেতু অভিভাবকেরা বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চান না, অনেক সময় স্কুলের শিক্ষকদের কাছেও মনের কথা খুলে বলে না ছেলেমেয়েরা।এক্ষেত্রে পরিবার এবং শিক্ষকদের বাইরে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে একজন প্রশিক্ষিত কাউন্সেলর কিংবা মনোবিদ শিক্ষার্থীদের সাহায্য করতে পারেন।কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট নুজহাত রহমান ওই প্রতিবেদনে বলেন, যে কথা বাবামা বা শিক্ষককে খুলে বলা যাচ্ছে না, সেটি একজন মনোবিদ বা কাউন্সেলরের সঙ্গে আলোচনা করতে পারে ছেলেমেয়েরা।
“যারা সমস্যায় পড়ে তারা খোলামেলাভাবে আলোচনা করলে কিভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলা করবে, সেটা তারা মনোবিদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারে। আবার যারা পড়াশোনায় খারাপ করা বা ইভটিজিং কিংবা বুলিয়িং এমন কোন সমস্যায়ও পড়েনি, তাদের হয়ত কেবল মনোযোগী ও আস্থা রাখা যায় এমন একজন দায়িত্বশীল শ্রোতার আলোচনা করতে পারলেই সমস্যা মিটে যাবে।” অল্প বয়েসী ছেলেমেয়েদের সমস্যার কথা মন দিয়ে শোনাটা জরুরি বলে মনে করেন মিজ রহমান।
মনোবিদের সংখ্যা নগন্য
বাংলাদেশে মূল সমস্যা দেশে প্রশিক্ষিত মনোবিদের মোট সংখ্যা মাত্র তিনশ জনের মত। এছাড়া ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি অর্থাৎ মনোবিদ হবার জন্য যে বিশেষ প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয়, তার ব্যবস্থা রয়েছে একমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। মনোবিদ মিজ রহমান জানিয়েছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিবছর মাত্র ৩০ জন শিক্ষার্থী এ বিষয়ে পেশাদার সার্টিফিকেট নিয়ে উত্তীর্ণ হন। ফলে এই জায়গাতেও সরকারকে চিন্তাভাবনা শুরু করতে হবে দ্রুতই।
সূত্র: বিবিসি