সেরিব্রাল পালসিঃ পর্ব-২

0
37
বাবা-মা-রাই প্রথম লক্ষ্য করতে পারেন তাঁদের বাচ্চা বেড়ে ওঠার পথের কোনও ধাপ পেরোতে অসুবিধাতে পড়ছে কিনা। যদি কোনও ধাপ পেরোতে দেরী হয়, বাবা-মা-রা ভাবতে পারেন তাঁদের সন্তান দেরিতে শুরু করছে ও পরবর্তীকালে ঠিক শিখে যাবে। বাবা-মাকে অবশ্যই পেডিয়াট্রিসিয়ান বা শিশুরোগ বিশেষজ্ঞকে এই বিষয়ে অবগত করা উচিত কোনোরকম দেরী না করে।
সেরিব্রাল পলসিকে সারানো যায় না, কিন্তু এই রোগের উপসর্গগুলি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য অনেক চিকিৎসাপদ্ধতির সুবিধা লাভ করা যায়। যদিও, সেরিব্রাল পলসি তার ধরণ, আক্রান্ত স্থান বা অক্ষমতার জটিলতা অনুযায়ী আলাদা হতে পারে, একটা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দল একত্রে কাজ করে এই রোগে আক্রান্ত শিশুর বিস্তীর্ণ চিকিৎসা পদ্ধতি স্থির করেন।
পেডিয়াট্রিসিয়ান, ফিজিওথেরাপিস্ট, অর্থোটিস্ট (বিকলাঙ্গতা ও অস্থিসন্ধির অসামঞ্জস্যতা যিনি যন্ত্রদ্বারা দূর করতে পারেন), স্পীচ ও ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিস্ট, অক্যুপেশানাল থেরাপিস্ট বা পেশাদারী শিক্ষা প্রদানের বিশেষজ্ঞ, বিশেষ ধরণের শিক্ষক এবং মানসিক চিকিৎসক, সকলে একজোট হয়ে কাজ করেন জাতে শিশুটি তার সব অক্ষমতার সাথে মানিয়ে যতটা সম্ভব স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারে।

  • ফিজিওথেরাপিঃ যখনি একটা শিশু সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত ধরা পরে, সাথে সাথেই এটা শুরু করা উচিত। ফিজিওথেরাপির কাজ হল পেশি-গুলিকে দুর্বল হওয়া, ছোটো হয়ে যাওয়া বা তার কর্মক্ষমতা হ্রাস পাওয়া থেকে আটকানো। একজন ফিজিওথেরাপিস্ট বাচ্চাটিকে কিছু শারীরিক কসরত শেখান যা তাঁর পেশিকে মজবুত করে তুলবে। বিশেষ ধরণের হাত বা পা দেওয়া হয় যার ব্যবহারের ফলে পেশির প্রসারণ ও অঙ্গভঙ্গির উন্নতি ঘটে।
  • স্পীচ থেরাপিঃ এটা বাচ্চাদের যোগাযোগের ক্ষমতাকে বাড়ায়। শিশুদের কিছু এক্সারসাইজ সেখান হয় যা তাদের পরিষ্কারভাবে কথা বলতে সাহায্য করে।

কথাবলার জটিলতা যেখানে বেশি সেখানে বাচ্চাকে যোগাযোগের বিকল্প পদ্ধতি, যেমন ইঙ্গিতের দ্বারা যোগাযোগ, শেখান হয়। বাচ্চার যোগাযোগের জন্য বিশেষ যন্ত্র, যেমন কম্পুটারের সাথে যুক্ত ভয়েস্‌ সিন্থেসাইজার, পাওয়া যায়।

  • অক্যুপেশানাল থেরাপিঃ এই থেরাপিস্ট বাচ্চার রোজকার কাজ, যেমন খাওয়া, জামা কাপড় পরা, টয়লেটে যাওয়া, করতে কি কি অসুবিধা হয় তা চিহ্নিত করে তা থেকে বেড়িয়ে আসার কাজে সহায়তা করেন। অক্যুপেশানাল থেরাপিস্ট বয়োবৃদ্ধির সাথে সাথে আপনার বাচ্চার আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদা বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করেন।
  • প্লে থেরাপিঃ এটা হল একটা নতুন পদ্ধতি যেখানে খেলার মাধ্যমে বাচ্চারা আনন্দ পায় এবং এর ফলে তাদের মানসিক বৃদ্ধি সঠিকভাবে হয়। এটা একটা থেরাপিউটিক ও সাইকোলজিক্যাল পদ্ধতি যেটা বাচ্চাকে অন্যের সাথে যোগাযোগ স্থাপন ও সম্পর্ক স্থাপনে সাহায্য করে। প্লে থেরাপি বাচ্চার শারীরিক সক্ষমতা, সুস্থ স্বাভাবিক পরিবেশে মানসিক চাহিদা ও কাজ করার ক্ষমতা বাড়ায়। এই পদ্ধতি শুরু করা হয় যখন বাচ্চা খুবই ছোটো (০ -২ বছর), কিন্তু এটা বয়ঃসন্ধির সময়ও দরকার। যত তাড়াতাড়ি প্লে থেরাপি চালু করা হয়, বাচ্চা তত তাড়াতাড়ি উপকৃত হয়। প্রাথমিক অবস্থাতে শুরু করলে বাচ্চার ব্যবহার থেকে তার অন্যের সাথে যোগাযোগ সব কিছুরই উন্নতি ঘটায়।
  • কাউন্সেলিংঃ একজন কাউন্সিলার বা সাইকলজিস্ট বাচ্চা ও তার পরিবারের সাথে এই সব অক্ষমতার সাথে মানিয়ে নিতে সাহায্য করে।
  • বিশেষ ভাবে তৈরি শিক্ষা ব্যবস্থাঃ অক্ষমতা বা মানসিক প্রতিবন্ধকতা-যুক্ত বাচ্চাদের শেখানোর জন্য এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
    একটা বাচ্চার জন্ম হল একটা পর্ব যা অনেক আশা, উত্তেজনা, আনন্দ-উদ্দীপনাতে ভরপুর থাকে। কিন্তু যখন বাবা-মা জানতে পারেন যে তাঁদের বাচ্চার সেরিব্রাল পলসি হয়েছে তখন তা তাঁদের জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনে এবং সন্তানের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তাঁদের দূরদৃষ্টি একেবারেই পরিবর্তিত হয়ে যায়। এটা অবশ্যই সময় সাপেক্ষ ঠিকই, কিন্তু তাঁদেরকে এই পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে হবে। এর মধ্যে প্রথম হল বাচ্চার অবস্থা ঠিকমত বোঝা ও সেই মত ঠিক কি সাহায্য দরকার তা স্থির করে উপযুক্ত চিকিৎসা পদ্ধতি বা থেরাপির সাহায্য নেওয়া।
    সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত শিশুর প্রসঙ্গ উত্থাপন করা ও তার যত্ন নেওয়া খুবই কঠিন এবং তা মানুষকে হতবুদ্ধি করলেও সেখানে আশার আল অবশ্যই আছে। আপনি হচ্ছেন আপনার সন্তানের সব থেকে ভাল উকিল ও শ্রেষ্ঠ অবলম্বন। সেরিব্রাল পলসির বিষয় জ্ঞান-অর্জন আপনাকে সবরকম ভাবে নিজের সন্তানকে সাহায্য করার জন্য উপযুক্ত করে তুলবে। এই রোগের সাহায্যকারী কোনও দলে যোগ দিলে আপনি যেমন আপনার অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান অন্যদের সাথে ভাগ করে নিতে পারবেন, তেমনই তাঁদের থেকেও অনেক কিছু শিখতেও পারবেন।

    সেরিব্রাল পলসি উত্তরোত্তর ছড়িয়ে না পড়লেও এই রোগে আক্রান্তরা কোনদিনও সুস্থ হয় না। একজন মানুষ যিনি এই রোগে ভুগছেন তাঁকে অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় এবং তিনি কিভাবে নিজের সামর্থ্যকে কাজে লাগাতে হয় ও উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে সম্পূর্ণ করতে হয় তাও শিক্ষা লাভ করতে পারেন। এখন অনেক বিকল্প ব্যবস্থা ও সাহায্যকারী যন্ত্র এসে গেছে যা সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত শিশুদের লেখাপড়া সম্পূর্ণ করতে, হবি বা ভালোলাগার কাজ করতে এবং খেলাধুলা এমনকি অবসর বিনোদনেও সহায়তা করতে পারে।
    প্রাথমিক পর্যায় ধরা পড়ার পর সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত বাচ্চাদের অনেকদূর এগিয়ে যাবার প্রমাণও আছে। একটা বাচ্চা যে হাঁটতে পারত না বা হাঁটতে শেখেনি তাকেও পর্বতারোহণ করতে দেখা গেছে। যে কখনও কথা বলতে পারবে আশা করা হয়নি, সে বা তারাও কথা বলে, বই লিখে তাদের কথাতে ও অভিজ্ঞতা প্রকাশের দ্বারা অন্যদের অনুপ্রাণিত করেছে এরূপও দেখা গেছে।
    এক্ষেত্রে, বাবা-মা হলেন একটা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, যাঁরা নিজেদের বাচ্চাকে তার ভালোলাগার জায়গাটা খুঁজে নিয়ে প্রাথমিকভাবে বেঁচে থাকার সব উপকরণ দিয়ে তাকে একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেন।

    চার ধরণের সেরিব্রাল পলসি হয়:

    • স্প্যাস্টিক সেরিব্রাল পলসিঃ এটা বেশী সংখ্যক বাচ্চার ক্ষেত্রে দেখা যায় যদিও এই রোগের প্রখরতা সব সময় এক নাও হতে পারে। এই প্রতিবন্ধকতারও চারটে ভাগ আছেঃ
      • হেমিপ্লেজিয়া– একই দিকের হাত ও পা আক্রান্ত হয়; হাতই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
      • প্যারাপ্লেজিয়া- দুই পা এই রোগের আওতায় আসে; হাত খুবই সামান্য প্রভাবিত হয় বা একেবারেই রোগের আওতাতে আসে না।
      • কোয়াড্রিপ্লেজিয়া বা টেট্রাপ্লেজিয়া- দুটো হাত ও দুটো পা সমভাবে আক্রান্ত হয়।
      • ডাইপ্লেজিয়া- এটা হল প্যারাপ্লেজিয়া ও টেট্রাপ্লেজিয়ার মধ্যবর্তী অবস্থা; এক্ষেত্রে দুটো পা-ই সমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
    • আথেটয়ড বা ডিস্‌কাইনেটিক সেরিব্রাল পলসিঃ এর বৈশিষ্ট্য হল পেশির গঠন ও চলাচল খুবই কম এবং মাথা, হাত ও পায়ের অনিয়ন্ত্রিত ঝাঁকুনি, যা অনুভূতি বা টেনশন এর সাথে সাথে বাড়ে আর বিশ্রামের সময় কমে যায়।
    • আটাক্সিক সেরিব্রাল পলসিঃ এটা খুবই কম দেখা সেরিব্রাল পলসি যার বৈশিষ্ট্য হল দুর্বলতা, চলাফেরার অসুবিধা ও একই ভাবে না থাকতে পারা। ব্যাপক অর্থে, ফাইন মোটর স্কিলের অসুবিধা ও চলাফেরার সমস্যাটাই এখানে প্রধান।
    • বিভিন্ন সেরিব্রাল পলসির মিশ্র অবস্থাঃ বিভিন্ন ধরণের সেরিব্রাল পলসির সমন্বয়; যদিও স্প্যস্‌টিসিটি ও আথেটোসিস এই দুই প্রকারের সমন্বয়ই বেশি দেখা যায়।
Previous articleতাৎক্ষণিক মন ভালো করার কিছু উপায়
Next articleসন্তান একগুঁয়ে হলে কী করবেন?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here