মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। নিজেদের প্রয়োজনেই গোষ্ঠীবদ্ধ জীবন বেছে নিয়েছিল আদিম মানুষ। সেই থেকে আজ অবধি মানব সভ্যতার বিকাশে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে সমাজ। সমাজের প্রয়োজনীয়তা তাই বিতর্কের অতীত। কিন্তু বর্তমানের বাংলাদেশে যে মাদকাসক্তির একটা ভয়াবহ প্রকোপ চলমান, তাতে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে সমাজ কী করছে? অথবা সমাজের ভূমিকা কী এখানে? সে ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত? বছর পনেরো আগেও বাংলাদেশে সমাজের কাছে সব মানুষের কিছুটা দায়বদ্ধতা ছিল, সমাজ কিছু কিছু ক্ষেত্রে জবাবদিহিতার ভূমিকা পালন করত। বড়োরা ছোটদের অন্যায়কে স্নেহপূর্ণ শাসনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেষ্টা করতেন শুধুমাত্র একই সমাজে বাস করছেন এই দাবিতে। বড়োদের সামনে ধূমপান করা বেয়াদবি হিসেবে গণ্য হতো, মাতলামি করা তো অনেক দূরের কথা। কোনো অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িত হতে যাচ্ছে দেখলে সমাজ জানান দিত তার পরিবারকে। তাঁরা তখন সতর্ক হয়ে যেতেন এবং পরিবারের সদস্যকে শোধরাতে বাধ্য করতেন। আগেও নেশা ছিল, অসামাজিক কার্যকলাপ ছিল। কিন্তু তা এত ব্যাপক আকারে ছিল না। এর পেছনে কি সমাজের কিছু ভূমিকাও ছিল? সে ভূমিকা এখন কেন নেই? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা নিয়েই মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনের ২০১৯ সালের জুন মাসের সংখ্যায় মনোসামাজিক বিশ্লেষণে ‘মাদকাসক্তি : সামাজিক ও পারিবারিক প্রেক্ষাপট’ বিষয়ে মতামত প্রদান করেন সাইকোলজিস্ট বেলাল হোসেন। তার সেই বক্তব্য তুলে ধরা হল:
এখন আমাদের সমাজের সর্বস্তরে মাদকের ছড়াছড়ি। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে মাদক নিয়ন্ত্রণে দুর্বল আইন ও আইনের যথার্থ প্রয়োগের অভাব রয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থায় যথাযোগ্য নৈতিকতা সম্পন্ন নাগরিক তৈরির ব্যবস্থা নেই। সেইসাথে রয়েছে মাদকের ভয়াবহতা ও পরিণতি সম্পর্কে পর্যাপ্ত জনসচেতনতার অভাব। আমাদের সমাজের অভিভাবকেরা সঠিকভাবে সন্তানের তদারকি করতে জানেন না বা সঠিক প্যারেন্টিং জানেন না। সেইসাথে পারিবারিক কলহ ও দাম্পত্য সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে সামাজিক অস্থিরতা। বাড়ছে অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহার আর ফেসবুক, পর্ন, ভিডিও গেম আসক্তি। যার ফলে বিষণ্ণতা ও উদ্বিগ্নতাসহ বিভিন্ন ধরনের মানসিক রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব কারণেই সামগ্রিকভাবে আমাদের সমাজে মাদকাসক্তির সংখ্যা বাড়ছে। তাদেরকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে দায়িত্ব নিয়ে পাশে দাঁড়াতে হবে, তাদেরকে সঠিক ও বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসার আওতায় আনতে হবে।
যেহেতু এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি ও বারবার ফিরে আসার রোগ, সেহেতু হাল ছেড়ে না দিয়ে চিকিৎসা প্রক্রিয়ার সাথে লেগে থাকা জরুরি। এইক্ষেত্রে চিকিৎসা খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার, কেননা খরচ কমাতে গিয়ে প্রায়শই অপচিকিৎসার শিকার হতে হয়। অনেকেই গড়িমসি করে চিকিৎসা শুরু করতে দেরি করেন, তাতে ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যায় এবং চিকিৎসার খরচ ও সময় স্বাভাবিকভাবেই বেশি লাগে। আর চিকিৎসার ভার শুধুমাত্র ডাক্তার ও কাউন্সিলরগণের ওপর ছেড়ে দিয়েই ক্ষান্ত না হয়ে নিজ এবং পরিবারকেও দায়িত্ব নিতে হবে। সুস্থতার জন্য ব্যক্তির নিজের এবং পরিবারের ভূমিকা অপরিসীম। আসক্তির পরবর্তী সুস্থতার জন্য ঐ ব্যক্তির জন্য উপযোগী কোনো কাজে যুক্ত থাকা জরুরি। বিভিন্ন নিয়ম মেনে চলা, যেমন- খাওয়া, ঘুম, দৈনন্দিন কাজ একটি নিয়মমাফিকভাবে করা উচিত। মনে রাখতে হবে, শুধু মাদকমুক্ত থাকাটাই সুস্থতা নয়। শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও আধ্যাত্মিকভাবে ক্রমান্বয়ে উন্নতি সাধনের চেষ্টা চালিয়ে যাওয়াই রিকভারি বা সুস্থতা। খেয়াল রাখতে হবে আসক্তির পাশাপাশি অন্য কোনো মানসিক বা গুরুতর শারীরিক রোগ আছে কি না। থাকলে পাশাপাশি সেটাকেও চিকিৎসার আওতায় আনা দরকার। তা না হলে শুধুমাত্র আসক্তির চিকিৎসা করে ভালো ফল পাওয়া যাবে না।
নিয়মিতভাবে চিকিৎসক, কাউন্সিলর,স্পন্সরের সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রাখা একান্ত প্রয়োজন। এছাড়াও এন এ, এ এ সহ বিভিন্ন ধর্মীয় ও সহায়তামূলক গ্রুপের সাথে যুক্ত থাকা সুস্থতাকে তরান্বিত করে। এক্ষেত্রে বীকন পয়েন্ট লিমিটেডও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই বীকন পয়েন্ট লিঃ দেশের প্রথিতযশা সাইকিয়াট্রিস্ট, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট, অ্যাডিকশন কাউন্সিলরসহ অভিজ্ঞ টিম দ্বারা আন্তরিকতার সাথে সেবা দিয়ে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটি আসক্ত ব্যক্তিকে সুস্থ করতে ও সুস্থতাকে ধরে রাখতে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করে আসছে তার মধ্যে রয়েছে-বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, কাউন্সিলর দ্বারা প্রয়োজনীয় ঔষধের পাশাপাশি ব্যক্তিগত, গ্রুপ ও পারিবারিক কাউন্সিলিংসেবা। আছে মাদককে মোকাবেলার জন্য দক্ষতার প্রশিক্ষণ, সমৃদ্ধ ব্যায়ামাগার, মেডিটেশন বা ইয়োগার ব্যবস্থা, ধর্মীয় শিক্ষক কর্তৃক শিক্ষা দানের ব্যবস্থা, দীর্ঘমেয়াদি সুস্থতার জন্য সাপোর্ট গ্রুপ। বীকন পয়েন্ট এক্ষেত্রে নারকোটিক অ্যানোনিমাস গ্রুপের সাথে সংযোগ করানোর জন্য নিয়মিত এন এ মিটিং এ অংশগ্রহণ করিয়ে থাকে, এখানে চিকিৎসা গ্রহণকারী ব্যক্তি আজীবন বীকন পরিবারের সদস্য হিসেবে যুক্ত হন এবং সাপোর্ট গ্রুপ প্রোগ্রাম, ফলোআপসহ অন্যান্য সকল প্রোগ্রামে যুক্ত থাকার সুযোগ পান। চিকিৎসায় একঘেয়েমি কাটানোর জন্য সাপ্তাহিক আউটিং, বিভিন্ন ধরনের সুস্থ বিনোদন ও ইনডোর গেমের ব্যবস্থা রয়েছে। মাসিক অভিভাবক পরামর্শ সভা ও মাদকবিরোধী সচেতনতামূলক বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়। সর্বোপরি চিকিৎসা গ্রহণকারী ব্যক্তির সাথে মর্যাদাপূর্ন মানবিক আচরণই বীকন পয়েন্টের চিকিৎসা সেবার প্রধান প্রতিপাদ্য।
সূত্র: মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন, ২য় বর্ষ, ৬ষ্ঠ সংখ্যায় প্রকাশিত।