“কী যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে
কভূ আশীবিষে দংশেনি যারে।”
কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার অনেক আগেই বলে গিয়েছেন জীবন দর্শনের সত্য কথন। মানসিক স্বাস্থ্যের যত্নের ব্যাপারে আমাদের সমাজে যে বিশাল উদাসীনতা তা দেখে এই কবিতার লাইনদুটো মনে পড়লো।
রুপান্তর রোগ বা কনভারসন ডিসঅর্ডার নিয়ে এখনো সমাজে এবং অনেক চিকিৎসকদের মধ্যে ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। চিকিৎসক বিজ্ঞান দিয়ে প্রমাণিত তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে রোগের চিকিৎসা করেন।
আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে রোগ এবং রোগী দুটোই চিকিৎসার বিষয়। সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে পুরো সমস্যা মাথায় নিয়ে চিকিৎসা চলে। রোগীর অভিনয় করা, রোগ সম্পর্কে মিথ্যা বলা আর রুপান্তর রোগ কিন্তু এক নয়। আমি যখন শিক্ষানবিশ চিকিৎসক ছিলাম তখন রুপান্তর রোগ বা কনভারসন ডিসঅর্ডার আমরা লিখতাম না। হিসটিরিয়া লিখে রাখতাম ফাইলে খুব বড় করে। আমাদের এক বন্ধু তার এডমিশান ডিউটির সময় প্রায়ই মজা করে বলতো আজ ১০ টা রোগীর চিকিৎসা করেছি আর ৫ টা হিসটিরিয়ার রোগী পেয়েছি। সে এটা এজন্যে বলতো কারণ সে মনে করতো হিসটিরিয়া আবার কোন রোগ নাকি।
আমাদের হাসাহাসি কিংবা কথার বিনোদনের খোরাক যোগানো রোগীগুলোর মানসিক অবস্থা তখন বুঝতাম না।অনুশোচনা হয় এখন। এ রোগ সম্পর্কে আমাদের অধিকাংশের ধারণা ছিলো কম। অনেক চিকিৎসককে বলতে শুনেছি এটা অভিনয়। একবার শ্বাসকষ্ট নিয়ে এক রোগী ভর্তি হলো। কুষ্টিয়া থেকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। আমার উপর দায়িত্ব ছিলো রোগীটি রিসিভ করে চিকিৎসা দেবার। সরকারি হাসপাতালে যা হয়, আমাদেরও সেই অবস্থা ছিলো। প্রচুর রোগী আর যুদ্ধের ময়দানের মতো হুড়োহুড়ি, চিল্লাচিল্লি চলছে। আমাদের সহকারী রেজিস্ট্রার ছিলেন খুবই ব্যস্ত। আমি তার কাছে পরামর্শ নিতে গেলে তিনি বললেন স্যালাইন দিয়ে নাকে নল দেওয়ার ভয় দেও ঠিক হয়ে যাবে। আসলে তখন জানতাম না কিংবা বলা যায় বুঝতে পারিনি যে মানসিক দ্বন্দ্বে, চাপে দিশেহারা অসুস্থ মানুষের জন্যে ভয় দেখানো কোন চিকিৎসার মধ্যে পরে না।
আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে রোগীর চিকিৎসায় সবসময়ই মানবিক হবার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ঠিক যেমনটা আমরা দেখেছি মুন্না ভাই এমবিবিএস সিনেমার কথোপোকথনে। আমার দেখা সেই রোগীটির পারিবারিক কলহ এবং বিবাদের কথা আমি পরে জানতে পারি। আমরা হাসপাতাল থেকে তাকে ছুটি দেওয়ার দুইমাস পরে সে আত্নহত্যার চেষ্টা করেছিলো বলে শুনেছি।
আসলে রুপান্তর রোগের সাথে আরও কিছু রোগ একইসাথে থাকতে পারে। বিষণ্ণতা, অস্থিরতা, ব্যক্তিত্বের রোগ সহ আরও অনেক কিছু। আধুনিক গবেষণায় উঠে এসেছে আরও ভয়াবহ তথ্য। কনভারসন ডিজঅর্ডার এর রোগীদের মধ্যে পরবর্তীতে নিউরোলজিকাল ডিজিজ (রোগ) হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি। বাংলা চলচ্চিত্রের বিখ্যাত উক্তি ছিলো গায়ের জোরে প্রেম হয় না। ঠিক সেভাবেই বলি গায়ের জোরে চিকিৎসা হয় না। বকুনি দিয়ে, সুইয়ের ভয় দেখিয়ে কিংবা নাকে নল দিয়ে কষু দিলেই কনভারসন ডিসঅর্ডার ভালো হয় না।
কনভারসন ডিসঅর্ডারের রোগীদের মধ্যে দেখা যেতে পারে খিচুনি, অস্বাভাবিক চলন, মাথা ঘুরে পরে যাওয়া, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, হাত পা অবশ হয়ে যাওয়া, কথা বলতে না পারা, চোখে দেখতে না পারা, কানে শুনতে না পারা, বমি, ডায়রিয়া, শ্বাসকষ্ট কিংবা প্রস্রাব আটকে যাওয়ার মতো উপসর্গ।
চিকিৎসায় মানবিক এবং বৈজ্ঞানিক ধারণা সমুন্নত রাখা প্রয়োজন। যদি সকল প্রকার যাচাই-বাছাই এবং পরীক্ষার পরে রোগীর রুপান্তর রোগ ডায়াগনোসিস হয় সেক্ষেত্রে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের দিক নির্দেশনা অনুসারেই চিকিৎসা চলবে। কাউন্সেলিং, সাইকোথোপির ভূমিকা এখানে অনেক বেশি। ঔষধের ভুমিকাও আছে কিন্তু অপ্রয়োজনীয় ঔষধ দেওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। এবং আমাদের চিকিৎসকরা, আগামী প্রজন্মের স্বাস্থ্যসেবা খাতের আইকনরা যেনো এ ব্যাপারে সজাগ থাকে, রুপান্তর রোগ সম্পর্কে জানে সে চেষ্টাও অব্যহত রাখা প্রয়োজন।
মানুষের মানসিক দ্বন্দ্ব এবং চাপের থেকে অবচেতন মনে যেহেতু এ রোগের উৎপত্তি তাই এ রোগের চিকিৎসায় সামাজিক এবং পারিবারিক সমস্যার ব্যাপারেও আলাপ করতে হবে, কাউন্সিলিং করতে হবে এবং সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। এটি সাধারণত ১০ থেকে ৩৫ বছর বয়সে বেশি হয়। আরও বেশি হয় টিনেজারদের। মেয়েদের এই রোগে আক্রান্ত হবার পরিমাণ ছেলেদের থেকে অনেক বেশি। ক্ষেত্রবিশেষে প্রায় দশগুণ বেশি। স্বল্প শিক্ষিত, স্বাক্ষর জ্ঞাণহীন, গ্রাম্য দরিদ্র, বৈবাহিক জীবনে অসুখী এবং চাওয়া পাওয়ার চিন্তায় মগ্ন মানুষের ক্ষেত্রে এ সমস্যা অনেক বেশি।
মানসিক স্বাস্থ্য আপনার আমার সকলের জীবনের সকল উপাদানকে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগানোর কথা বলে।বিজ্ঞান প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হয়, নতুন তথ্য দেয়। নতুন নতুন আবিষ্কার নিয়ে আসে। আমরা এখনো রুপান্তর রোগের অনেক কিছুই জানি না। কিন্তু এই রোগ যে ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারি তা জানি। একইসাথে এটা জানি যে চিকিৎসায় এ রোগ প্রায় একশত ভাগ ক্ষেত্রে ভালো হয়। আগামীর পৃথিবীর জন্যে, সুস্থ জীবনের জন্যে রুপান্তর রোগের সুচিকিৎসার জন্যে সবার কাছে একটু সতর্কতা আশা করতেই পারি।
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে