বুদ্ধিমত্তা এশটি আপেক্ষিক বিষয়। কারো বুদ্ধি কম, কারো বেশী। খুব ভাল ছাত্রটিকেও পাওয়া যায় বিষয় বুদ্ধিতে খুব কাঁচা। আবার অল্প শিক্ষিত কোনো ব্যক্তিও হতে পাওে বাস্তব বুদ্ধিতে খুব শাণিত। তাত্ত্বিকভাবে বুদ্ধিমত্তাকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে দু’টিভাগে-
১. বুদ্ধিগত ক্ষমতা ও
২. জীবন যাপনের দক্ষতা
বুদ্ধিগত ক্ষমতা হল এশটি মানুষের শেখার পারদর্শীতা, কারণ নির্ণয়, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সমস্যার সমাধান ইত্যাদি কার্যাবলীর সমন্বয়। অপরদিকে যার দ্বারা আমরা দৈনন্দিন জীবনে সঠিকভাবে একে অপরের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করি, যোগাযোগ রক্ষা করি এবং সর্বোপরি নিজের ও অপরের ভালো মন্দ বিচার করতে সক্ষম হই; সেটাই হল জীবনযাপনের দক্ষতা।
যদিও এই লেখার প্রথম বাক্যটিতে বলা হয়েছে বুদ্ধিমত্তা আপেক্ষিক, কিন্তু বস্তুত বুদ্ধিরও পরিমাপক রয়েছে। আইকিউ(ওছ) বা ইন্টেলিজেন্সি ক্যুশন্ট হল এমনই এশটি পরিমাপক। কিছু র্নিদিষ্ট পরীক্ষার মাধ্যমে মানব বুদ্ধিমত্তার পরিমাপ করে যে স্কোরিং বা সংখ্যামান হিসাব করা হয় তাই হল আইকিউ। এই স্কোরিং সিস্টেমে ৯০-১০৯ পর্যন্ত হল গড়পরতা বুদ্ধিমত্তার মাপ। ৮৫-৮৯ পর্যন্ত হল অনুগড় এবং আরো নীচে ৭০-৭৯ পর্যন্ত হল বর্ডাও লাইন বা সীমান্তবর্তী মাপ। আর যখনই আইকিউ ৭০এর নীচে নেমে আসে তখনই শুরু হয় বুদ্ধিও সমস্যা। অর্থাৎ যাদের আইকিউ ৭০ এর নীচে তারাই বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। আবার বুদ্ধি প্রতিবন্ধীদেরকেও আইকিউ এর মাত্রা অনুযায়ী মৃদু (৫০-৬৯), মাঝারী (৩৫-৪৯), তীব্র (২০-৩৪) এবং চরম (<২০) এই চারভাগে ভাগ করা হয়েছে। সাধারণভাবে দেখা যায় যে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী জনসংখ্যা মাত্র ১%, এর মধ্যে ৮৫% হল মৃদু শ্রেণীর।
বয়সভিত্তিক বুদ্ধিও সমস্যায় শিশু থেকে বৃদ্ধ যে কেউ আক্রান্ত হতে পারে। এমন অনেক রোগ রয়েছে যা মানুষের এই বুদ্ধিমত্তাকে ব্যহত কওে বা বুদ্ধি বিকাশে বাঁধা তৈরী করে। শৈশবকালীন বুদ্ধিগত রোগগুলি বেশিরভাগই জীনগত বা জন্মগত কারণে হয়। আর পরিণত বয়সের বুদ্ধিও সমস্যা হয় নির্দিষ্ট কিছু রোগ, বয়সজনিত ক্ষয়, পুষ্টির ঘাটতি-এরকম হরেক কারণে। আজ আমরা এসকল রোগ সম্পর্কে জানবো।
ক. প্রাপ্তবয়স্কদের বুদ্ধি সমস্যার কারণ:
অ্যালজেনমার‘স ডিজিস:এটি মস্তিষ্কের এশটি জটিল রোগ যা মস্তিষ্কের কোষগুলির ক্ষয়ের কারণে হয়। বয়স্কদের মধ্যে এটিই সবচেয়ে বুদ্ধিহানিকর রোগ।
পারকিনসন ডিজিস: দ্বিতীয় প্রধান কারণ হল পারকিনসন ডিজিস। এটিও মস্তিষ্কের কোষের ক্ষয়জনিত রোগ যা বুদ্ধিমত্তা, চলৎশক্তি ও ভারসম্যেও ব্যপক ব্যাঘাত ঘটায়।
মস্তিষ্কের আঘাত বা হেড ইনজুরি: আঘাতজনিত কারণে মস্তিষ্কের কোষের ক্ষতি, মস্তিষ্কের ভেতর রক্তক্ষরণ ও বুদ্ধিনাশের কারণ হতে পারে। কনকাশন হল মস্তিষ্কের আঘাতজনিত এশটি অবস্থা যাতে কিছু সময়ের জন্য বুদ্ধি ও স্মৃতিশক্তি লোপ পেতে পাওে এবং পরবর্তীতে তা ধীওে ধীরে সেরেও ওঠে। বারংবার মাথায় আঘাত পাওয়া ও বুদ্ধিও সমস্যা দেখা দিতে পাওে যা সাধারণত বক্সারদের মধ্যে দেখা যায়।
ইনফেকশন বা প্রদাহ: বিভিন্ন ধরনের জীবানুর সংক্রমন যদি মস্তিষ্ক বা তার আবরণকে (মেনিনাজস) আক্রান্ত কওে তবে তা থেকেও বুদ্ধিও সমস্যা হয়। উল্লেখযোগ্য সংক্রমণগুলি হল নিউরোসিফিলিস ও এইচআইভি ইনফেকশন তথা এইডসের মারাত্মক সংক্রমণ।
মস্তিষ্কের টিউমার বা ক্যানাসার: নিরীহ টিউমার বা জীবনঘাতী ক্যানসার -হোক মস্তিষ্কের প্রাথমিক ক্যানসার বা দূরবর্তী অন্য কোনো অঙ্গের ক্যানসার হতে সংক্রমিত অবস্থা-সবগুলিই বুদ্ধিও সমস্যা তৈরী করতে পারে। এয়াড়া হানটিংটন ডিজিস, মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস ইত্যাদি মস্তিষ্কের রোগ ও বুদ্ধি সমস্যার কারণ।
বুদ্ধিও সমস্যা মানেই শুধুমাত্র মস্তিষ্কজনিত রোগ তা কিন্তু নয়। অন্যান্য আরো যে শারীরিক রোগগুলি বুদ্ধি ঘাটতি ঘটায়, তা হল-
অন্যান্য অঙ্গ বৈকল্য: ফুসফুস, কিডনী, লিভার বিকল হলে তার প্রভাব শরীরের আর সব অঙ্গের মত মস্তিষ্কের উপরও পড়ে আর তা থেকেই র্দীঘমেয়াদী প্রভাবে বুদ্ধিও সমস্যার উৎপত্তি হয়। আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে গ্রন্থিও কার্যকারিতার সাথে মানুষের বুদ্ধিমত্তা অনেকাংশে জড়িত তা হল; থাইরয়েড গ্রন্থি। এই গ্রন্থির কার্যকারিতা হ্রাস পেলে বুদ্ধিবৃত্তির নাশ ঘটে।
পুষ্টিহীনতা ও ঘাটতিজনিত কারণ: ভিটামিন বি ১২, ফলেট, আয়রন(লৌহ), আয়োডিন ইত্যাদিও ঘাটতিজনিত কারণে বুদ্ধির সমস্যা তৈরি হয়। আবার বিভিন্ন ধাতুর বিষক্রিয়া বুদ্ধিমত্তার উপর প্রভাব ফেলে, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-সীসার আধিক্য বা বিষক্রিয়া।
মানসিক রোগ:র্দীঘমেয়াদী মানসিক রোগ যেমন:অত্যাধিক উদ্বেগ, আতংক, দুঃশ্চিন্তা, অত্যাধিক মানসিক চাপ, গভীর বিষণ্ণতা, মানসিক বিকারগ্রস্থতা- এসবগুলিই বুদ্ধিমত্তার উপর প্রভাব ফেলে। এছাড়াও র্দীঘদিনের মাদকাসক্ত ব্যক্তি বিশেষত যারা গাঁজা, হেরোইন, ইয়াবা, অ্যালকোহল আসক্ত তাদের মধ্যে স্বাভাবিক বোধ ও বিবেচনা শক্তির ব্যাপক ঘাটতি ঘটে।
খ. শৈশব কালীন বুদ্ধি সমস্যার কারণ:
বুদ্ধির সমস্যার মূল কারণ নিহিত আছে জন্মগত ক্রটি গুলিতে, যা গর্ভকালীন সময়ে ঘটে অথবা প্রসবকালীন জটিলতার কারণেও হয়। আবার কিছু বিপাকীয় গোলযোগের জন্যও এর উৎপত্তি হয়ে থাকে। যেকারণেই হোক এমন ধরনের শিশুগুলিকে আমরা মানসিক বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বলে থাকি।
জীনগত কারণ: গর্ভকালীন বুদ্ধি নাশের কারণগুলি মূলত জীনগত। জীনগত ত্রæটির কারণে যে রোগগুলি হয় তার বেশীরভাগই খুব দাঁতভাঙা নামে পরিচিত যা সাধারন মানুষের জন্য খুব কঠিন। কিন্তু এসব রোগ বর্তমানে এতটাই ব্যাপক যে এই কঠিন নাম গুলির সাথেও মানুষ এখন বেশ পরিচিত। এরমধ্যে সবচেয়ে প্রচলিত রোগটি হল ডাউন সিনড্রোম। এয়াড়াও টার্নাও সিনড্রোম, এডওয়ার্ড সিনড্রোম, ফ্রেজাইল এক্স সিনড্রোম ইত্যাদিও নামগুলিও এখন কেউ না কেউ হয়ত শুনে থাকবেন।
পরিবেশগত কারণ: পরিবেশগত কারণগুলি মূলত শিশুর মস্তিষ্কে বাধা প্রদান করে। এই কারণগুলিকে আবার তিনটি ভাগে ভাগ করে বণর্না করা যায়:
- জন্মের পূর্বে/গর্র্ভকালীন (Prenatal)
- জন্মের সময়/প্রসবকালীন(Perinatal)
- জন্ম পরবর্তী (Post natal)
জন্মের পূর্বে/গর্র্ভকালীন কারণ: মা যদি গর্ভাবস্থায় রুবেলা, সিফিলিস, টক্সোপ্লাজমা ইত্যাদি ইনফেকশনে আক্রান্ত হয় অথবা সীসা বা অ্যালকোহল ইত্যাদি বিষক্রিয়ার স্বীকার হয় তাহলে গর্ভস্থ্য শিশুর বুদ্ধিও বিকাশ ব্যহত হতে পারে। এমনকি মা ও শিশুর রক্তের গ্রæপের গড়মিল থেকেও পরবর্তীতে শিশুর বুদ্ধিমত্তা প্রভাবিত হতে পারে।
প্রসবকালীন সময়ের জটিলতা: প্রসবকালীন সময়ে শিশুর মস্তিষ্কে আঘাত পাওয়া, নির্ধারিত সময়ের বেশি সময় যাবৎ প্রসব কালীন জটিলতা এবং সেজন্য শিশুর মস্তিষ্কে অক্সিজেনের স্বল্পতা হওয়া, নির্ধারিত সময়ের আগে শিশু জন্ম নেওয়া, শিশুর নাড়ী পেঁচিয়ে যাওয়া ইত্যাদি কারণে পরবর্তীতে শিশুর বুদ্ধিও সমস্যা দেখা দিতে পারে।
জন্ম পরবর্তী কারণ: জন্মের পরপর শিশুর খিঁচুনী, বিভিন্ন ইনফেকশন যেমন: মেনিনজাইটিস, হুপিং কফ, হাম ইত্যাদিতে আক্রান্ত হওয়া, পুষ্টিহীনতা, জন্মের পর কোনো কারণে মাথায় আঘাত পাওয়া, সীসার বিষক্রিয়া ইত্যাদি শিশুর বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হওয়ার কারণ।
এছাড়াও শিশুর বৃদ্ধিকালীন সময়ে পুষ্টিহীনতা, বিশেষ কওে আয়োডিনের ঘাটতি, খিঁচুনী রোগাক্রান্ত শিশু, দৃষ্টি বা শ্রবণপ্রতিবন্ধী শিশু পরবর্তীতে বুদ্ধিও ঘাটতিতে ভোগে। এমনকি শিশু যদি শৈশবকালীন সময়ে পর্যাপ্ত মানসিক উদ্দীপনা না পায় (Under stimulation), অযত্ন অবহেলায় বড় হয় (Child neglect), শিশু নির্যাতনের (Chid abuse) শিকার হয় এবং পর্যাপ্ত শিক্ষার সুযোগ বঞ্চিত হয়; তাহলেও কিন্তু তার মেধার বিকাশ ব্যহত হবে। তবে, এরপরও দুই তৃতীয়াংশ শিশুর বুদ্ধিহীনতার সঠিক কারণ এখনো অজানাই রয়ে গেছে।
প্রিয় পাঠক, বুদ্ধিহীনতা কোনো অভিশাপ নয়। আসুন আমরা বুদ্ধির সমস্যার কারণগুলি জানি, সচেতন হই এবং এতে আক্রান্ত ব্যক্তির প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে নিজ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিই।
সূত্র: লেখাটি মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত।
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে