মায়ের মানসিক স্বাস্থ্য

মায়ের মানসিক স্বাস্থ্য
মায়ের মানসিক স্বাস্থ্য

বিশ্বে গর্ভাবস্থায় প্রতি ১০০ জনে ১০ জন এবং সন্তান প্রসবের পর প্রতি ১০০ জনে ১৩ জন নারী যে মানসিক রোগে ভোগেন তা হল বিষণ্ণতারোগ। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এর হার আরও বেশি, গর্ভাবস্থায় প্রতি ১০০ জনে প্রায় ১৬ জন এবং সন্তান প্রসবের পর প্রতি ১০০ জনে প্রায় ২০ জনের এ সমস্যা হয়।
মাতৃত্বজনিত বিষণ্ণতারোগে মায়ের দৈনন্দিন কাজে ব্যাঘাত ঘটে, শারীরিক স্বাস্থ্যের অবনতি হয়, রোগের তীব্র পর্যায়ে আত্মহত্যার ঝুঁকি বেড়ে যায় এবং সর্বাপরি মাতৃমৃত্যুর হার বেড়ে যায়। তাছাড়া, সন্তানের বৃদ্ধি এবং বিকাশে এ রোগটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

গবেষণায় দেখা গেছে, গর্ভাবস্থায় মায়ের বিষণ্ণতা এবং উদ্বেগজনিত রোগ থাকলে প্রিম্যাচিউর বেবি অর্থাৎ নির্দিষ্ট সময়ের আগেই সন্তান জন্ম নিতে পারে আবার তাদের জন্মকালীন ওজনও কম হতে পারে যা পরবর্তীকালে ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। সন্তান প্রসবের পর মায়ের বিষণ্ণতা রোগ হলে তা মা এবং শিশু উভয়ের জন্য ক্ষতিকর। কারণ, যখন মা তার নিজের যত্নই নিতে পারেন না, তার সন্তানের পরিচর্যা করার কথা বলাই বাহুল্য। তখন সন্তানকে বুকের দুধ পান করানোর মেয়াদকাল কমে যায় অথবা মা তাগিদ অনুভব করেন না। মা এবং সন্তানের মাঝে বন্ধন খুব দৃঢ় হয় না। সঠিক পরিচর্যার অভাবে সন্তানটির বিভিন্ন প্রকার শারীরিক রোগ যেমন ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া,পুষ্টিহীনতার ঝুঁকি বেড়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে এ রোগটি এতটা তীব্র হয় যে, মা আত্মহত্যা করে ফেলেন অথবা করার চেষ্টা করেন। আবার কখনও নিজের সন্তানের ক্ষতি করার চিন্তা করেন, সন্তানকে আঘাত করেন, মেরেও ফেলেন।

গর্ভাবস্থায় এবং প্রসব পরবর্তী ১ বছর : এই সময়ে হরমোনের ব্যাপক তারতম্য, মায়েদের মাঝে বিভিন্ন ধরনের মানসিক রোগের প্রধান কারণ। তাছাড়া, গর্ভধারণ এবং প্রসব ও তার পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন প্রকার মানসিক চাপ, পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব, পূর্বে মানসিক রোগের ইতিহাস, পরিবারে অনুরূপ মানসিক রোগের ইতিহাস, দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক অসুস্থতা যাদের থাকে তাদের মাঝে এ ধরনের সমস্যা বেশি দেখা যায়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেয়া সংজ্ঞা অনুযায়ী একজন মাকে সুস্থ তখনই বলা যাবে যখন শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি মানসিকভাবেও সুস্থ থাকবেন। অর্থাৎ, তিনি তার নিজস্ব ক্ষমতা এবং দায়িত্ব সম্পর্কে অবগত থাকবেন, জীবনে বিভিন্ন প্রকার মানসিক চাপ মোকাবিলা করতে পারবেন, প্রতিকূল পরিবেশে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারবেন, উৎপাদনশীল কাজ করবেন এবং সমাজে অবদান রাখতে পারবেন।

তাই, একজন সুস্থ মা পেতে হলে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র প্রত্যেকের ভূমিকা অপরিসীম।

ব্যক্তি পর্যায় : প্রথমত, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রতিটি ব্যক্তির উচিত মায়ের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করা এবং সংশ্লিষ্ট দায়িত্ব পালন করা। দ্বিতীয়ত, একজন মা যিনি সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন তার উচিত বিষয়টি সম্পর্কে তার নিকটজন যারা আছেন তাদের অবহিত করা এবং মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের অধীনে চিকিৎসা নেয়া।

পরিবারিক পর্যায় : অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, একজন নতুন মা তার নবজাতকের পরিচর্যায় এতটাই মগ্ন থাকেন যে, সে অনুধাবনও করতে পারেন না তিনি কতটা সংগ্রাম করছেন বা তার কিছু মানসিক সমস্যা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে তার জীবনসঙ্গী, পরিবারের অন্য কোনো সদস্য, কোনো বন্ধু যারা বিষয়টি লক্ষ্য করছেন তারা মায়ের মানসিক সমস্যা হলে দ্রুত শনাক্তকরণ, ওষুধ ও মনোসামাজিক চিকিৎসা প্রদান এবং দ্রুত নিরাময়ের ব্যবস্থাগ্রহণে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারেন। এ ক্ষেত্রে জীবনসঙ্গী বা স্বামীকে সবার আগে এগিয়ে আসা উচিত।

পরিবারের সদস্যদের বুঝতে হবে যে, শুধু নবাগত সন্তানটিরই নয়, মায়েরও বিশেষ পরিচর্যা, বিশ্রাম ও স্বস্তির প্রয়োজন। তাদের দায়িত্ব মা এবং শিশুর বন্ধন দৃঢ় করতে মাকে সচেতন করা ও সহায়তা করা। দাম্পত্য সম্পর্ক উন্নত করা, সন্তান প্রতিপালনের ক্ষেত্রে মা এবং বাবা দু’জনে কাজ ভাগ করে নেয়া, একে অন্যের প্রতি সহমর্মী হওয়া, পরিবারের অন্য সদস্যদের সচেতন হওয়া এবং সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসা, সহিংসতা বন্ধ করা, লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণ ইত্যাদিও পারিবারিক দায়িত্বের মাঝে পড়ে।

সামাজিক পর্যায় : মহিলাদের জন্য সামাজিক সহায়তা বাড়ানো, লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণ, সহিংতা বন্ধ করা, কুসংস্কার দূরীকরণ।

রাষ্ট্রীয় পর্যায় : মায়ের মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ও পরিচর্যার অন্তর্ভুক্ত করা। নারীর ক্ষমতায়ন, নারী-পুরুষের সমানাধিকার নিশ্চিত করা, নারীদের জন্য বিভিন্ন পেশামূলক এবং বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, জনগণকে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন করা, স্বাস্থ্যকর্মীদের মায়ের মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রদান করা, তদুপরি সবার জন্য মানসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা ইত্যাদি রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত।

সূত্র: লেখাটি মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত।

মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন ক্রয়ের বিশেষ অফার

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে

 

Previous articleডায়ালেকটিক্যাল বিহেভিয়ার থেরাপি: ডিবিটি
Next articleবাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব সাইকিয়াট্রিস্ট এর নতুন কমিটির দায়িত্ব গ্রহণ
ডা. সাইফুন নাহার সুমি
সহকারি অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here